কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ভয় পাচ্ছেন 'গডফাদার অব এআই' হিন্টন
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার 'ব্যাপক আগ্রাসন' নিয়ে ভয় পাচ্ছেন প্রযুক্তি বিশ্বে 'গডফাদার অব এআই' বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঈশ্বর হিসেবে পরিচিত জিওফ্রে হিন্টন। দীর্ঘ এক দশক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করার পর এখন এর 'অন্ধকার দিক' নিয়ে কথা বলতে চান তিনি। আর তাই গেল সপ্তাহে গুগল থেকে ইস্তফা দিয়েছেন এই এআই জায়ান্ট।
সোমবার (১ মে) যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস-কে তথ্যটি নিশ্চিত করে হিন্টন জানিয়েছেন, "তিনি যে প্রযুক্তির বিকাশে সহায়তা করেছিলেন তার 'ঝুঁকি' সম্পর্কে কথা বলার জন্য তিনি গুগল ছেড়ে দিয়েছেন।"
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা পরিচালিত বর্তমানের অনেক পরিসেবায় ব্যবহৃত নিউরাল নেটওয়ার্কে হিন্টনের অবদান ব্যাপক। টেক জায়ান্ট গুগলের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়ন কাজে তিনি প্রায় এক দশক ধরে খণ্ডকালীন হিসেবে কাজ করেছেন, কিন্তু এখন তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং এটিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
হটাৎ করে এআই থেকে সরে আসা নিয়ে এবং এআই সম্পর্কে অনুশোচনা করে নিউ ইয়র্ক টাইমস-কে হিন্টন বলেছেন, 'আমি স্বাভাবিক অজুহাত দিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দেই এই বলে যে, যদি আমি এটি না করতাম তাহলে অন্য কেউ করত।'
সোমবার এক টুইট বার্তায় হিন্টন লিখেছেন, 'গুগলের উপর কেমন প্রভাব পড়বে তা বিবেচনা করা ছাড়াই যেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভয়ঙ্কর দিক নিয়ে কথা বলতে পারি সেজন্য আমি গুগল ছেড়েছি। তবে গুগল অবশ্য খুব দায়িত্বশীলভাবে কাজ করছে।'
গুগলে হিন্টনের এক দশকের অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে গুগলের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জেফ ডীন বলেছেন, হিন্টন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় মৌলিক সাফল্য এনেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ সংস্থা সিএনএন-কে দেওয়া এক বক্তব্যে ডীন বলেছেন, 'আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য একটি দায়িত্বশীল পদ্ধতির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সাহসিকতার সাথে উদ্ভাবন করার পাশাপাশি আমরা ক্রমাগত উদীয়মান ঝুঁকিগুলি বুঝতে শিখছি।'
নিউ ইয়র্ক টাইমস-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হিন্টন দুটো বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, একটি হল মানুষের চাকরিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা ও অপরটি হল এমন এক বিশ্ব তৈরি হওয়া যেখানে আসল সত্য কি সেটা কেউই জানতে পারবে না।
হিন্টন বলেন, 'কিছু মানুষের বিশ্বাস ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আসলে মানুষের চেয়েও অধিকতর বুদ্ধিসম্পন্ন হতে পারে। অধিকাংশদের মতে তা অনেক দূরের পথ। আমিও ভেবেছিলাম তা আসলেই অনেক পরে হবে। আমি ভেবেছিলাম হয়তো ৩০ বা ৫০ বছর বা আরও পরে। কিন্তু এখন আর তা মনে করি না।'
এমনকি গুগল থেকে সরে যাওয়ার আগেও জনসমক্ষে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সৃষ্ট ক্ষতির পাশাপাশি ভাল সম্ভাবনা সম্পর্কে কথা বলেছিলেন হিন্টন।
২০২১ সালে ভারতের মুম্বাইয়ে 'ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনলজি বোম্বে'তে কমেন্সমেন্ট অ্যাড্রেসে বক্তব্য দেওয়ার সময় হিন্টন বলেছিলেন, 'আমি বিশ্বাস করি যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত অগ্রগতি সমাজকে এমনভাবে রূপান্তরিত করতে চলেছে যা আমরা পুরোপুরি বুঝতে পারি না এবং এর সমস্ত প্রভাব ভাল হতে চলেছে না।
তিনি উল্লেখ করেছেন, কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা স্বাস্থ্যসেবায় ব্যাপক উন্নতি ঘটাবে আবার একই সঙ্গে প্রাণঘাতী মারাত্মক অস্ত্রের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তুলবে।
হিন্টন বলেছেন, আমি দেখতে পাচ্ছি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে সম্ভাবনা তৈরি করেছিল রোবটরা গ্রহণের চেয়ে তা আরও অনেক বেশি তাৎক্ষণিক ও ভয়ঙ্কর। আমি মনে করি এ সম্ভাবনা অনেক দূরের পথ অতিক্রম করবে।
এমন এক সময়ে হিন্টন এ সিদ্ধান্ত নিলেন যখন 'কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালিত চ্যাট-বট গুলোর কারনে ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়া এবং মানুষের চাকরিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা' সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক আইন প্রণেতা, অ্যাডভোকেসি গ্রুপ এবং প্রযুক্তির অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিরা শঙ্কা জাগিয়েছেন।
গেল বছরের শেষ দিকে ওপেন এআই এর চ্যাট-বট চ্যাট জিপিটি, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটি অদৃশ্য অস্ত্র প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করে দেয়। যার ফলে সবাই অনুরূপ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালিত পরিসেবার বিকাশ ঘটাতে শুরু করে। ইতোমধ্যে ওপেন এআই, মাইক্রোসফট এবং গুগল এ প্রতিযোগিতার পুরোধা। তবে এর বাইরে আইবিএম, অ্যামাজন, বাইদু এবং টেনসেন্টও এ প্রযুক্তি নিয়ে কাজ শুরু করেছে।
চলতি বছরের মার্চে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অবাধ বিচরণকে 'সমাজ এবং মানবতার জন্য গভীর ঝুঁকি' উল্লেখ করে কমপক্ষে ছয় মাসের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী এআই সিস্টেমের প্রশিক্ষণ বন্ধ করে রাখতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ল্যাবগুলোর প্রতি দেওয়া একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন প্রযুক্তি বিশ্বের খ্যাতিমান কয়েক বিশিষ্টজন।
চিঠিটি প্রকাশ করেছিল বিশ্বের অন্যতম ধনকুবের ও প্রযুক্তি পুরোধা ইলন মাস্কের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান 'ফিউচার অব লাইফ ইন্সটিটিউট'। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালিত ওপেন এআই-এর নতুন শক্তিশালী চ্যাট-বট চ্যাট জিপিটি ফোর অবমুক্ত করার ঘোষণা দেওয়ার দুই সপ্তাহের মাথায় এই চিঠিটি প্রকাশিত হয়। ওপেন এআই-এর নতুন এই চ্যাট-বটটি পরীক্ষামূলক ব্যবহারের সময় দেখা গেছে এটি মামলার খসড়া তৈরি, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের একাডেমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া এবং হাতে আঁকা স্কেচ থেকে একটি কার্যকরী ওয়েবসাইট তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রতি লাল কার্ড দেখানো প্রথম গুগল কর্মী কেবল জিওফ্রে হিন্টন নন। গেল বছরের জুলাই মাসে কর্মসংস্থান এবং ডেটা সুরক্ষা নীতি লঙ্ঘনের অজুহাত দিয়ে গুগল তাদের এক প্রকৌশলীকে চাকরিচ্যুত করেছিল। সেই প্রকৌশলী দাবি করেছিলেন, একটি অপ্রকাশিত এআই সিস্টেম সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করা অনেকেই এখন সেই প্রকৌশলীর বক্তব্যকে জোরালোভাবে তুলে ধরছেন।
/এএস