কুমিল্লার সাফল্যে নাফিসার রেসিপি
২০১২ সালে বিপিএলে মাঠে গড়িয়েছে। পার করেছে এক দশকেরও বেশি সময়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাঠামোর মাঝে দাঁড়াতে পারেনি। এর প্রভাব পড়েছে সর্বত্র। যে কারণে এক একবার নতুন নতুন ফ্রাঞ্চাইজি আসছেন। আবার চলে যাচ্ছেন। ব্যতিক্রম কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের ক্ষেত্রে। ২০১৫ সাল থেকে দলটির দায়িত্ব নিয়েছেন নাফিসা কামাল। এখন পর্যন্ত আছেন দলের সঙ্গে। যার সুফলও তারা পাচ্ছেন। ছয় আসরে খেলে চারবারই চ্যাম্পিয়ন।
দলটির মালিকানা ‘ফিক্সড’ হয়ে যাওয়াতে অন্য অনেক ক্ষেত্রেও অনেক কিছু ‘ফিক্সড’ হয়ে গেছে। যেমন কোচ সালাহউদ্দিন আছেন সেই ২০১৫ সাল থেকে। অধিনায়ক ইমরুল কায়েসও একই সময় থেকে। শুধুমাত্র প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সময় তিনি ছিলেন দলের একজন সদস্য। অধিনায়ক ছিলেন মাশরাফি। এর পরের তিনবার কুমিল্লা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তার নেতৃত্বেই।
শুধু কোট কিংবা কোচিই ‘ফিক্সড’ হননি। কোচিং স্টাফের অনেকেই একই রকম ‘ফিক্সড’ হয়ে আছেন দলের সঙ্গে। এমন কি বিদেশি কোটায় সুনিল নারিনও খেলছেন সেই ২০১৫ সাল থেকে। এভাবে অনেক কিছুই ‘ফিক্সড’ হওয়াতে দলটি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা করে এগুতে পারছে। হুট করে কোনও ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে না। কুমিল্লার এমন সাফল্যের ‘রেসিপি’ জানিয়েছেন দলটির চেয়ারপার্সন নাফিসা কামাল। যিনি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালের মেয়ে।
ফাইনাল খেলা শেষ। শেষ হয়েছে আতশবাজি, আর লেজার শোও। পর্যায়ক্রমে শেষ হয়েছে পুরস্কার বিতরণীও। খেলা শেষে সাধারণত চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ দলের অধিনায়ক অথবা প্রতিনিধিরা সংবাদ সম্মেলনে এসে থাকেন। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার ক্ষেত্রে দেখা গেল ব্যতিক্রম। অধিনায়ক ইমরুল কায়েস ও কোচ মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনের সঙ্গে দেখা গেল নাফিসা কামালকেও।
বিপিএল আসলেই তিনি সংবাদ মাধ্যমে বিভিন্ন সময় কথা বলে থাকেন। কিন্তু এবার তাকে খুব একটা কথা বলতে দেখা যায়নি। বলা যায় ফাইনাল শেষেই আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি প্রথম কথা বলেন। সেখানেই তিনি কথা বলার ঝুপরি খুলে বসেন দলকে নিয়ে। দলের সাফল্যের রহস্য বলতে গিয়ে তিনি জানান, ‘আমি একা এই সাফল্যের অংশ নই। ২০১৫ সাল থেকে কোচ, অধিনায়ক দুজনই আমাদের সঙ্গে আছেন। সুনীল নারাইনও আছে একই সময় থেকে। শুধু তারাই নন, কোচিং স্টাফ, টিম স্টাফ সবাই আমাদের সঙ্গে আছেন অনেক দিন থেকেই। এটা ব্যতিক্রম এবং টিম ব্র্যান্ডিং। যা বিপিএলে আমাদের উপস্থিতিকে অনেক শক্ত করে তুলেছে।’
এভাবে লম্বা সময় একত্রে থাকার সুফল উল্লেখ করে নাফিসা বলেন, ‘ অন্য দলগুলোর সঙ্গে আমাদের এখানেই পার্থক্য। তিনি বলেন,‘ শুধু টাকা থাকলেই যে বিদেশি খেলোয়াড় পাওয়া যায়, তা কিন্তু নয়। আমরা বিদেশি খেলোয়াড়দের কাছ থেকে অনেক সাড়া পাই। আমরা অনেক লম্বা চিন্তা করি। আমাদের নেটওয়ার্ক এখন অনেক শক্ত। যে কারণে বিদেশি ক্রিকেটাররা অন্য দলের তুলনায় অনেক আগে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।’ এবারের বিপিএলে বিদেশি ক্রিকেটারদের অক্টোবরে সাইন করানোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি অক্টোবর মাসে খেলোয়াড় সাইন করেছি। এটা অন্য দলগুলো হয়তো ভাবতেও পারবে না। আজকেই যেমন আমি আগামী বিপিএলের জন্য দুই জন খেলোয়াড়ের সঙ্গে কথা বলেছি।’
এবারের বিপিএলে সমস্যার নাম ছিল বিদেশি ক্রিকেটার। পাকিস্তানি ক্রিকেটার ব্যতীত মান সম্পন্ন বিদেশি ক্রিকেটার পাওয়া ছিল কঠিন। যে কারণে পুরো মৌসুমে কাউকে পাওয়া সম্ভব ছিল না। এই সমস্যার কথা উল্লেখ করে নাফিসা বলেন, ‘এবার সব দলই বিদেশি খেলোয়াড় নিয়ে সমস্যা মোকাবেলা করছে। কিন্তু আমরা প্রথম থেকে জানতাম কোন সময় আমাদের কোন খেলোয়াড় আসবে, যাবে। সে জন্য আমাদের তেমন কোনো সমস্যা হয়নি।’ এর সুফল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ বিদেশি ক্রিকেটার নিয়ে ভাবনা না থাকায় আমাদের চিন্তাটা অন্য দিকে যায়নি। খেলার মধ্যেই ছিল। আমাদের এজেন্ডা একটাই ছিল, কাপ জেতা।’
কুমিল্লা এবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে প্রথম ৩ ম্যাচ হারের পর। এরপর তারা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর্যন্ত টানা জিতেছে ১১ ম্যাচ। ফিরে আসার গল্প শুনিয়ে নাফিসা বলেন, ‘ প্রথম ৩ ম্যাচ হারে পরও ‘আমাদের বিশ্বাস ছিল আমরা চ্যাম্পিয়ন হব। কীভাবে হব, তা নিয়ে আমাদের নতুন করে পরিকল্পনা করতে হয়েছে। চট্টগ্রামে আমরা সবাই বসি। সেখানে ঠিক করা হয় লক্ষ্য। কী করলে লক্ষ্য পূরণ হবে, সেটা নিয়ে কাজ করেছি আমরা।’
বিপিএলে বিদেশি ক্রিকটোর নিয়ে আসার ক্ষেত্রে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস যেমন চমক দেখিয়েছে, তেমনি একইভাবে এক সময় চমক দেখাতেন নাফিসার পিতা অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। আইসিসি ও বিসিবির সাবেক সভাপতি মোস্তফা কামাল এক সময় আবাহনীর ক্রিকেট কমিরিও চেয়ারম্যাও ছিলেন। তার সময়ে তিনি আবাহনীর হয়ে খেলার জন্য ওয়াসিম আকরাম, নেইল ফেয়ারব্রাদারের মতো বিশ্ব সেরা ক্রিকেটারদের নিয়ে আসে আবাহনীর হয়ে খেলতে। এ সব খুব কাছ থেকে দেখেছেন নাফিসা। আর শিখেছেন। যা তিনি কাজে লাগাতে পারছেন বিপিএলে।
স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘ওয়াসিম আকরাম, নেইল ফেয়ারব্রাদাররা আব্বুর দলে যেমন খেলে গেছেন; তেমনি রাসেল, সুনিল নারিনেদের মতো ক্রিকেটাররা আমাদের দলে খেলেন। আমি আব্বুর কাছ থেকেই এই উৎসাহটা পেয়েছি। তিনিই প্রথম ওই সময় আবাহনীতে খেলার জন্য ভালো মানের বিদেশি খেলোয়াড় নিয়ে আসেন। শহীদ আফ্রিদি তার সময়েও খেলেছে, আমিও নিয়ে এসেছি।’ তিনি আরও বলেন,‘ওয়াসিম আকরাম, ফেয়ারব্রাদার থাকতেন আমাদের বাসয় । আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ করতাম, ডিনার করতাম। ওনাদের সঙ্গে অনেক গল্পও করতাম। আব্বুকে দেখেছি ওনাদের নিয়ে কীভাবে কাজ করেছেন। এতে করে আমার কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেছে। না হলে আমি একজন মেয়ে আমি এখানে কেন আসব? অবশ্যই আব্বুর জন্য। যে কারণে চারটি ট্রফি নিয়ে আমি আজ এখানে আসতে পেরেছি।’
কুমিল্লার মেয়ে নাফিসা তাই কুমিল্লার জন্য বাবার মতো সব সময় নিজের অবস্থান থেকে কিছু একটা করে যেতে চান। বিপিএলে অন্য কোন দল কিনলে একই রকম হতো না বলেও জানান তিনি। নাফিসা বলেন, ‘ সব সময় কুমিল্লার জন্য আমার একটা টান কাজ করে। অবশ্য অন্য কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি কিনলে এটা হতো না। আমার বাবা কুমিল্লার জন্য যে ভূমিকা পালন করেন, যে সম্মানটা কুমিল্লায় পান, আমার বাবার মেয়ে হিসেবে, কুমিল্লার মেয়ে হিসেবে কুমিল্লার প্রতি অবশ্যই আমার অন্য রকম একটা ভালোবাসা কাজ করে।’
নাফিসা চান বিপিএলকে লাভজনক করে তুলতে। এ জন্য প্রয়োজনে তিনি তাদের সঙ্গে বসতেও চান। যদিও তারা এখন পর্যন্ত এ নিয়ে কোনও মিটিং করেননি। নাফিসা বলেন, আমরা ১৫-২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করি। ‘ফ্র্যাঞ্চাইজিদের সঙ্গে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের বোঝাপড়া ভালো থাকতে হবে। আমরা কিন্তু এখন পর্যন্ত একটা মিটিংয়েও বসিনি। এই টুর্নামেন্টের গুরুত্বপূর্ণ অংশ আমরা। আমাদের যদি সে সম্মানটা দেওয়া হয়, আমরা একই টেবিলে বসে বিপিএল কীভাবে ভালো করা যায়, কীোবে লাভবান করা যায়, তা নিয়ে প্রয়োজনে আলাপ করতে চাই।’
এমপি