বানানরীতি নিয়ে বিশিষ্টজনদের মুখোমুখি ঢাকাপ্রকাশ
প্রতি বছর যেন অকারণে আমরা বানান না বদলাই
বাংলা বানান নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। তবে সম্প্রতি বানান নিয়ে বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, স্কুলে যে বানান লিখলে শিক্ষক ভুল বলে কেটে দিতেন, এখন সেসব বানানকে শুদ্ধ বলে অভিধানে জায়গা দেওয়া হচ্ছে। আবার বাংলা একাডেমির বিভিন্ন অভিধানে একই শব্দের ভিন্ন বানান দেখা গেছে। এর ফলে অনেকেই বিভ্রান্ত হচ্ছেন বলে অভিযোগও রয়েছে। আর এ নিয়ে চার বিশেষজ্ঞের মুখোমুখি হয় ঢাকাপ্রকাশ।
সেলিনা হোসেন, কথাসাহিত্যিক ও সভাপতি, বাংলা একাডেমি
ফেব্রুয়ারি আমাদের ভাষার মাস। আমাদের ভাষার একটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে। দেশের তরুণরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষাকে রক্ষা করেছে। বিশ্বের কোনো দেশে এমন নজির নেই। ভাষার জন্য এমন ত্যাগ আমরা আগে কখনো দেখিনি। ইউনেস্কো আমাদের তরুণদের সেই অবদানকে সম্মান জানিয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা দান করেছে। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়। বিশ্বব্যাপী বাংলা একটি গৌরবোজ্জ্বল এবং সুপরিচিত ভাষা হিসেবে আজ বিবেচিত। কাজেই সেই ভাষার সুষ্ঠু চর্চায় আমাদের যত্নশীল হতে হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
ভাষাচর্চায় শুদ্ধ বানানরীতির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। শুদ্ধ বানান একটি ভাষাকে অনেক বেশি শ্রুতিমধুর এবং মাধুর্যমণ্ডিত করে থাকে। বাংলা একাডেমিও সেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বানানরীতিতে পরিবর্তন নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। এর উদ্দেশ্য মূলত সহজ-সাবলীল একটি অভিধান তৈরি করা এবং সর্বত্র সেটির বাস্তবায়ন ঘটানো। প্রতিটি ক্ষেত্রে একই অভিধান অনুসরণ করা, যাতে করে বাংলাভাষীদের মধ্যে একটি মতৈক্য তৈরি হয়। মতভেদ-বিভেদ এড়ানো সম্ভব হয়।
আমাদের উচিত সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পথ চলা। অনেক আগে যেমন সংস্কৃতি ছিল, সাধু ভাষা ছিল, গোত্র ভেদেও ভাষার প্রচলন ভিন্ন রকম ছিল। এখন সেরকমটি আর নেই। বৈশ্বিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আমরাও পরিবর্তনে বিশ্বাসী। তবে হ্যাঁ,এক্ষেত্রে যে কথাটি আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা যেন নিজেদের সংস্কৃতির কথা অর্থাৎ নিজস্বতাটুকু ভুলে না যাই।
অনেক ভাষাবিদ এবং গবেষক যারা আছেন, তারা অনেক বিচার-বিশ্লেষণ করে বাংলা বানানের নানাবিধ পরিবর্ধন পরিমার্জন করছেন। আমি এটিকে সাধুবাদ জানাই। এই যে তাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না এবং এটি অবশ্যই একটি সুফল বয়ে নিয়ে আসবে বলেই আমি সর্বোতভাবে বিশ্বাস করি।
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
বাংলা বানানের একটি অভিধান বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রণীত আছে। সেটি অনুসরণ করলেই চলে। বানান সহজিকরণের চেষ্টা আমি করেছিলাম, কিন্তু কাজ হয়নি। পণ্ডিতেরা সহযোগিতা করেননি। এখন যেমন দীর্ঘ-ঈকার কমে গেছে, হ্রস্ব-ইকার বেশি হয়েছে, যে সমস্ত শব্দের শেষে y আছে, সেগুলোতে হ্রস্ব-ইকার দেওয়া ঠিক নয়। একাডেমি দীর্ঘ-ঈ কার স্থলে হ্রস্ব-ই কার হয়েছে,তবে ইংরেজিতে লিখতে হলে, y লিখতে হয়। এখন y কি i এর সমান হতে পারে? এজন্য আমার মনে হয়, বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে আরও ভালোভাবে আলোচনা বিবেচনা হওয়া দরকার।
বানানরীতি মানার ক্ষেত্রে শৈথিল্য আমাদের আছে। যে যার খুশিমতো লিখে। ইংরেজি শব্দের বাংলা উচ্চারণ যেমন–মেট্রোপলিটন, এর বানান metropolitan; কিন্তু ইংরেজিতে বানান তো ton নয়। gate এর বাংলা বানান গেইট কেন হবে? Face এর বানান, ফেইস। বানান করতে হয় হ্রস্ব-ই দিয়ে। বলা হয় এক, লেখা হয় আরেকভাবে। অনেক সমস্যা আছে বানানের ক্ষেত্রে।
তবে আমি মনে করি, বানান ভাবার্থ প্রকাশের সঙ্গে সহজ করে লেখা উত্তম। খেয়াল রাখতে হবে যেন সেটি করতে গিয়ে বেশি হ্রস্ব না হয়ে যায়। যেমন–‘শহীদ’ শব্দের বানান ‘শহিদ’ হয়ে গিয়েছে, না হলেও ক্ষতি ছিল না। ‘লক্ষ্য’ হয়েছে ‘লক্ষ’। অযথা সরকারি অর্থ অপচয় না করে বছর বছর রীতি নীতি পরিবর্তন না করে আমি মনে করি গঠনমুলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে সকল ক্ষেত্রে একটি সুষ্ঠু সহজ বানান নীতি অনুসরণ করা উচিত যেটি জ্ঞান বিকাশে ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।
ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ
সরকারিভাবে আমাদের কোনো বানানরীতি নেই। বাংলা একাডেমি একটি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা; যেমন–প্রথম আলোর একটি বানানরীতি আছে। আনন্দবাজার পত্রিকার একটি বানানরীতি আছে। আবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেরও একটি বানানরীতি থাকে। সেগুলো হচ্ছে তাদের কাজের সহায়তার জন্য। তারা যে প্রকাশনাগুলো করেন, তা একইরকম মানসম্পন্ন হওয়ার জন্য। সেখানে বানানে যেন কোনোরকম বিচ্যুতি না ঘটে। একই বানান যদি বিভিন্নভাবে লেখা হয়, তাহলে কিছু অসঙ্গতি তৈরি হয়। সে কারণে যারা একটু বড় প্রতিষ্ঠান, যেমন–বাংলা একাডেমিসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, তারাও নিজেদের সুবিধার জন্য একটি বানান রীতি তৈরি করে। এই রীতিটা সর্বত্র প্রযোজ্য নয়।
সবক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়, সেরকম কর্তৃত্ব অথবা আইনি অবস্থান সরকারের আওতাধীন থাকে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যখন দায়িত্ব নেয়, তখন প্রতিষ্ঠানের কাজে তার প্রভাব পড়তে পারে। এখন গবেষণার যে বিভিন্ন পদ্ধতি আছে, গবেষণা সংস্থাগুলো দুই-তিন রকমের গবেষণা পদ্ধতি ব্যবহার করে। আমরা সাহিত্যে যারা গবেষণা করি, তাদের এক ধরনের গবেষণা পদ্ধতি, বিজ্ঞানে যারা গবেষণা করেন, তাদের এক ধরণের পদ্ধতি। সেখানেও আবার পার্থক্য দেখা যায়। এখানে ভাষা হচ্ছে প্রতিদিনের ব্যবহারের বিষয়। একই দেশের ভেতর বহুরকম মানুষ ভাষা ব্যবহার করছে এবং ভাষা ব্যবহার করছে আমাদের মিডিয়া। টেলিভিশনের ভাষা একরকম। রেডিওর ভাষা একরকম। সেজন্য ভাষার ভেতরে বানানগত পার্থক্য অথবা তারতম্য থাকবেই। আমাদের উচিত হবে একটি মোটামুটি অবস্থানে নিয়ে আসা, যাতে সমস্যা না হয়।
একই বানান আগে যেটি ছিল ধ্বনি কেন্দ্রিক বানানব্যবস্থা, যেমন–‘তীব্র’ শব্দটিতে ‘ত’-এর উপর জোর দেওয়া বুঝাতে দীর্ঘ ইকার ব্যবহার করা হয়। সে রকম কিছু কিছু বানান ছিল যেখানে চাপটি পড়ছে দীর্ঘ হয়ে,সেক্ষেত্রে দীর্ঘ ইকার। আগে চীন বানান আমরা দীর্ঘ-ঈকার দিয়ে লিখতাম, এখন লিখছি হ্রস্ব-ইকার দিয়ে। আমরা এখন ‘চিন’ বলছি, ‘চীন’ বলছি না। ‘আলী’ লিখতে–এটি যদি আরবিতে লেখা হয় তাহলে, আইন লাম দা, ফলে আলী হওয়ার কথা; কিন্তু আমরা হ্রস্ব-ইকার দিয়ে লিখছি। একাডেমি যে বানান রীতিটা তৈরি করেছিল, এটি নিশ্চয়ই গ্রহণযোগ্য। কারণ এটির পেছনে কিছু না কিছু গবেষণা আছে। আমি মনে করি, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এতটা করতে পারেনি।
বানানের একটি বেখাপ্পা বিষয় হলো–বাংলা ভাষায় লেখার ব্যাপারে এবং বলার ব্যাপারে আমরা যত না যত্নশীল, ইংরেজি ভাষার ক্ষেত্রে তারচেয়ে অনেক বেশি যত্নশীল। আমার আরও একটি আক্ষেপ হলো–আজ আমাকে যে প্রশ্নটি করা হচ্ছে, সেটি ফেব্রুয়ারি মাস বলেই করা হলো। এপ্রিল মাস হলে কেউ বলতো না। এতে প্রমাণিত হয়, আমরা ফেব্রুয়ারি মাসে গা ঝাড়া দিয়ে উঠি, তারপর এভাবে মাসটা পার হয়ে পরবর্তী মাসে চলে যায়। আমি মিডিয়াকে দোষ দেই না। আমি মনে করি, একটি স্ট্যান্ডার্ড বা প্রমিতকরণ এটি আমাদের প্রয়োজন। আমাদের লেখার স্বার্থে, আমাদের পড়ার স্বার্থে, আমাদের ভাষাকে সহজে ব্যবহারের স্বার্থে এটি আমাদের জন্য প্রয়োজন। সেজন্য ভাষার ব্যাকরণের যে নানারকম অসঙ্গতি আমরা লক্ষ্য করছি, সেখান থেকে আমাদের বেরুতে হবে। অকারণে কঠিন না করে বানানটি যেন একটু সহজ হয়, এটিও আমাদের দেখার বিষয়। কিন্তু একেবারে নিজেদের মনগড়া রীতি প্রয়োগ করাও আমাদের জন্য ভয়াবহ। সেজন্য গবেষণা প্রয়োজন। গবেষক, ভাষা তত্ত্ববিদরা ভাষাবিবর্তন পাঠ করেছেন যারা তারা পাঠ করবেন। তারপর যখন বানান রীতিতে দখল তৈরি হবে, তখন আমি মনে করি সেটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুসরণ করা উচিত। পত্র-পত্রিকাগুলোরও তা অনুসরণ করা উচিত।
আমি এখানে সরকারের হস্তক্ষেপ সমর্থন করব না। কারণ শিল্প-সংস্কৃতির বিষয়গুলোতে আমি সরকারি নিয়ম মেনে চলার বিরুদ্ধে। আমি এটিকে আমাদের বিবেকের উপর ছেড়ে দিই। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির উপর ছেড়ে দিই। আমরা যদি বাংলাকে ভালবাসি তাহলে বাংলা বানানও আমরা সুন্দরভাবে লিখব এবং শিখব এবং মনে রাখব–যেন বানানের বিশৃঙ্খলা আমরা দূর করতে পারি। এটি আমাদের কাজ। সরকারের কাজ নয়। আমাদেরও দায় আছে। আমরা সব সরকারের উপর চাপিয়ে দেই, প্রতিষ্ঠানের উপর চাপিয়ে দেই–আমি তার বিপক্ষে।
বাংলা একাডেমি যে কাজটি করেছে, সেটি খুব ভালো একটি কাজ। তারা একটি গবেষণালব্ধ ফলের উপর নির্ভর করে কাজটি করেছিল। সেটি যথেষ্ট আধুনিক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই তারা কাজটি করেছিল। ভাষার ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে। যখন এই অভিধানটি করা হয়েছিল, তখন অনেক কিছুই গোচরীভূত ছিল না। এখন ইন্টারনেটের ফলে নতুন নতুন জ্ঞান অর্জন করছি। সেই নতুন জ্ঞানের মাধ্যমে দুই-তিন বছর পর আমরা যেটুকু পরিবর্তন দরকার, সেটি করব। প্রতি বছর যেন অকারণে আমরা বানান না বদলাই এবং সর্বসম্মতভাবে যদি আমরা বানান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি, সেটি ভালো দিক বলে আমি মনে করি।
মুহম্মদ নূরুল হুদা, মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি
বাংলা একাডেমি তার কাজ করে যাচ্ছে। বহু ভাষাবিদ এবং গবেষকগণ বছরের পর বছর ধরে তাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রণীত আজকের আধুনিক বাংলা অভিধান। অনেকেই এর পক্ষে বিপক্ষে আগেও কথা বলেছেন, এখনো বলে যাচ্ছেন। আমি এত কথায় না গিয়ে শুধু এটুকুই বলবো আমরা কাজ করে যাচ্ছি এবং সেটি ভাষার সহজ ও সুষ্ঠু প্রকাশ বিকাশ ও পরিমার্জনের জন্যই। এটাই মূল কথা।
কে মানছে কে মানছে না অথবা মানার ক্ষেত্রে শিথিলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে কি না, এগুলো মতভেদ বাড়ায়। এই পরস্পরবিরোধী কথাবার্তায় না গিয়ে বরং আমরা যদি এভাবে মনে করি যে,বানানরীতি সহজিকরণে বাংলা একাডেমি যে কাজটি করছে, সেটি সব বাংলাভাষীর মঙ্গলার্থেই করছে এবং বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধান যদি সর্বোতভাবে অনুসরণ করি,সেটিই সকলের জন্য সমুচিত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
এসএ/