শিক্ষাব্যবস্থার সংকট ও উত্তরণের উপায় (শেষ পর্ব)
শিক্ষাকে কর্মমুখী করার কোনো বিকল্প নেই
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, দেশের খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান সংকটসহ সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সম্প্রতি তার সঙ্গে কথা হয় ঢাকাপ্রকাশের। সেখানে তিনি এ থেকে উত্তরণের পথও তুলে ধরেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেহনাজ পূর্ণা। আজ প্রকাশিত হলো বিশেষ সাক্ষাৎকারটির শেষ পর্ব
প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গাইডের ছড়াছড়ি, এ নিয়ে আপনার মতামত কী?
এই গাইড বই, নোট বই যারা শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দেন, তারা একটা শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন, যাদের এখন অনেক ক্ষমতা। তারা এই ব্যবসা করে কোটিপতি হয়েছেন এবং হচ্ছেন। আমরা তো ছাত্রজীবনে গাইড বই ইত্যাদি কখনো দেখিওনি; কিন্তু আমরা তো ঠিকই পড়াশোনা করেছি, ভালো ফলও করেছি। আমরা একে-অপরকে সাহায্য করতাম। আমি আমার এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে অঙ্কটা বুঝে নিতাম, কারণ অঙ্কে সে ছিল ছোটখাটো যাদব ঘোষ। তার বাড়ি যেতে হতো নদী পার হয়ে। সে আবার আমার কাছে আসত ইংরেজিটা দেখে নিতে। এতে আমাদের পরীক্ষার ফলে ভালো প্রভাব পড়ত।
আরেকটা কথা, আমাদের সময় শিক্ষকরাই যা পড়াবার পড়াতেন। এখন অনেকেই কোচিং করেন। তারা গাইড বই পড়ায় উৎসাহ দেন। অথচ শিশুরা পাঠ্যপুস্তক থেকে জ্ঞান আহরণ করতে সক্ষম। তবে তাদের জন্য সহায়ক হিসেবে শিক্ষকদের এবং পরিবারের একটা ভূমিকা থাকতে হবে। তাদের জন্য রিডিং ক্লাব করা যেতে পারে। অর্থাৎ সব পড়া স্কুলে পড়ে নিতে হবে। আর গাইড বই ও নোট বই পদ্ধতি বাতিল করতে হবে। এসব শিক্ষার্থীদরে নিজ থেকে চিন্তাভাবনা করার সক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। সব পর্যায়ের শিক্ষকদের গাইড বই-নোট বই লেখা বন্ধ করতে হবে। এসব আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
শিক্ষার্থীদের আত্মপ্রত্যয়ী করে গড়ে তুলতে সরকারের কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা উপমন্ত্রী দুজনের সঙ্গেই আমার কথা হয়েছে। তারা শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী ও আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে চান। তারা সৃজনশীল পদ্ধতির ব্যাপকতার মধ্য দিয়ে শিক্ষার মান বাড়াতে চান। তবে একদিনে তো আর সেটি সম্ভব না। এখন সরকার যা করতে পারে, তা হলো–শিক্ষায় বাজেট বৃদ্ধির বিষয়টি নিশ্চিত করা, শিক্ষকদের বেতন ভাতা বাড়ানো, স্কুলের মান উন্নত করা, দিনের সব পড়া স্কুলেই শেষ করা, মুখস্থ শিক্ষা থেকে বেরিয়ে এসে সৃজনশীল শিক্ষার দিকে যাওয়া, শির্ক্ষাথীদের নিজেদের সক্ষমতা আবিষ্কারের পথ খুলে দেওয়া এবং কোচিং প্রথা ও গাইড বইয়ের সিন্ডিকেট ব্যবসা বন্ধ করা। সরকার চাইলে তা সম্ভব।
শিক্ষকরা অনেকাংশে প্রাইভেট বা কোচিংয়ের দিকে ঝুঁকছেন। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
আমি যে কোনো বিষয়ের উৎসমূলের দিকে তাকানোর চেষ্টা করি। আপনি দেখবেন আমাদের শিক্ষকদের বেতন এখনও অপ্রতুল, যা দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করা সম্ভব নয়। তাই অনেকাংশে শিক্ষকরা প্রাইভেট কোচিংয়ের দিকে ঝুঁকছেন। আর আমাদের ক্লাসগুলোতে শিক্ষার্থী বেশি হওয়ায় সব শিক্ষার্থী ক্লাসের পড়া ক্লাসে বুঝে নিতে পারে না। এজন্যও প্রাইভেট কোচিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। শিক্ষকদের ভালো বেতন-ভাতা দিলে, সকল পড়া স্কুলে শেষ করার বাধ্যবাধকতা থাকলে, পড়ানোর পদ্ধতি ও পাঠ্যবই আকর্ষণীয় হলে তেমন কোনো সমস্যা থাকবে না। তাই শিক্ষকদের জন্য উপযুক্ত প্রণোদনার ব্যবস্থা করা উচিত।
শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তুলতে আপনার পরামর্শ কী?
শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষার আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাতে হবে। তারা যখন শিখার আনন্দ পেয়ে যাবে তখন আর প্রযুক্তির অপব্যবহার করবে না। এজন্য তাদেরকে নিয়মিত অ্যাসাইন্টমেন্টের আওতায় রাখা উচিত। তাদেরকে যদি আমরা ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন ইত্যাদি বিষয়ে গ্রুপভিত্তিক কাজ করতে দেই, তাহলে তারা এতে খুবই আকৃষ্ট হবে। প্রতিযোগিতায় ও আনন্দে তারা পড়া শেষ করে ফেলবে।
শিক্ষার মান বাড়াতে পদক্ষেপ কী হওয়া উচিত?
এই প্রসঙ্গে পাঁচ-ছয়টি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে চাই। যদি সংক্ষেপে বলি–প্রথমত, শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো (যাতে মেধাবী শিক্ষার্থীরা এই পেশায় আগ্রহী হয়), প্রয়োজনে তাদের আবাসিক সুবিধা নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, গাইড বই নোট বই নিষিদ্ধ করা। তৃতীয়ত, পাঠ্যপুস্তক আকষণীয় করা ও শক্ষিাদান এবং শিখন পদ্ধতির পরিবর্তন করা। চতুর্থত, শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা। পঞ্চমত, পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন করা। বার্ষিক অর্ধবার্ষিক না নিয়ে মাসিক বা দ্বিমাসিক ভাগ করে পরীক্ষা নেয়া যায়। এতে শিক্ষার্থীরা নিজেদের অবস্থান বুঝতে পারবে। নিজেদের আপডেটেড রাখবে। ষষ্ঠত, পাঠ্য পুস্তকের বাইরের জগত সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। এতে ইন্টারনেটকে কাজে লাগাতে হবে।
শিক্ষার মান বাড়াতে শিক্ষকদের মান কেমন হওয়া উচিত?
রাষ্ট্র গড়ার কারিগর শিক্ষক; কিন্তু আফসোস যে, আমাদের দেশের শিক্ষকদের অনেকেই একে প্রথম পছন্দ হিসেবে নেননি, অনেকের যোগ্যতারও অভাব আছে। মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসতে চান না। তার কারণ, এখানে বেতন-ভাতা কম। বিসিএস সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্তরা প্রশাসন, কাস্টমস, ফরেন ক্যাডার হতে চান। শিক্ষকদের সর্বোচ্চ বেতন দিলে তারা শিক্ষাকেই পেশা হিসেবে প্রথমে বেছে নিতেন। তাই ভালোমানের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার জন্য, শিক্ষকদের মান বাড়ানোর জন্য আমাদের কার্যকর পরিকল্পনা থাকা ও তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
আউট কাম বেইজড এডুকেশন নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?
শিক্ষাকে কর্মমুখী করার কোনো বিকল্প নেই। দেশের বেকারদের বড় অংশ সনদধারী। এখন দেখা যায়, প্রায় সকল বিষয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকার সময় থেকেই বিসিএসের জন্য পড়াশোনা করে; কিন্তু বিসিএসের আসন সংখ্যা খুবই সীমিত। যার ফলে বেকার সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে সাধারণ বিসিএসমুখী নিয়োগ না দিয়ে সাবজেক্ট ভিত্তিক জ্ঞান ও দক্ষতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া দরকার। যেমন–কৃষি, অর্থনীতি, পরিকল্পনা, চিকিৎসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে শুধু যারা এসব বিষয় পড়েন, তাদেরই নেওয়া হবে, তাহলে শিক্ষার্থীরা তাদরে বিষয়ে পড়ায় মনোযোগী হবে। যদি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ ফলিত বিষয়গুলোতে চাকরির সম্প্রসারণ হয়, বাজার ও অন্যান্য ক্ষেত্রের ব্যবস্থাপনা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহে নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়, তাহলে পড়াশোনায় গতি আসবে এবং দেশের শিক্ষার মান বাড়বে।
এসএ/