প্রশ্নফাঁসের দুই মামলায় আরও একাধিক ব্যক্তির সন্ধানে গোয়েন্দারা
প্রতিরক্ষা মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ের অধীন ডিফেন্স ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টের অডিটর পদে নিয়োগের প্রশ্ন ফাঁসের মূলহোতা সাবেক সেনা সদস্য নোমান সিদ্দীকি। গত ৮ বছর ধরে তিনি বিভিন্ন সরকারি প্রশ্নফাঁসে জড়িত ছিলেন। সেই ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দিয়ে তার নিকট আত্মীয়-স্বজদের চাকরিরও ব্যবস্থা করিয়েছেন। আবার বিক্রি করে উপার্জন করেছেন কাড়িকাড়ি টাকা। করেছেন বাড়ি-গাড়ি।
এই চক্রে রয়েছেন শিক্ষক-জনপ্রতিনিধিসহ একাধিক রাঘববোয়াল। এ ঘটনায় দায়ের করা দুই মামলার তদন্তে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে আরও একাধিক ব্যাক্তির সন্ধানে নেমেছে গোয়েন্দারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় মাস্টারমাইন্ড সাবেক সেনা ওয়ারেন্ট অফিসার নোমান সিদ্দীকি। তিনি এক সময় র্যাবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৪ সালে স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার পর প্রশ্ন ফাঁসে জড়িয়ে পড়েন। সেখান থেকে তিনি মোটা অঙ্কের টাকা উপার্জন করেছেন। একই সাথে তার আত্মীয় স্বজনদেরও চাকরির ব্যবস্থা করেছেন ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দিয়ে। তদবির বানিজ্য করেও কামিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা। সম্প্রতি তিনি তার চক্রে আরও একাধিক সদস্যকে যুক্ত করেন। এরমধ্যে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যায়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) নিবন্ধিত একজন শিক্ষকও রয়েছেন।
তিনি জানান, ৮ বছরে নোমান একাধিক ব্যাক্তিকে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দিয়ে চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। তাদের একটি তালিকা পাওয়া গেছে। এছাড়া তিনি আরও কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তদন্তের স্বার্থে এখনই তাদের নাম প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না। তার দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টদের মতে, এ ঘটনায় পলাতক এনটিআরসিএ-তে শিক্ষক হিসাবে নিবন্ধন পাওয়া ফারুকের সঙ্গে পূর্ব পরিচয় ছিলো মাহবুবা নাসরীন রুপার। তিনি বগুড়ার ধুপচাঁচিয়া উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান। একই সাথে ইডেন কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী। বিভিন্ন সময়ে রাজনীতিতে সময় পার করে দেওয়ার কারনে তার সরকারী চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছিলো। সম্প্রতি তিনি সরকারি চাকরির জন্য বিভিন্ন স্থানে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। এক পর্যায়ে ফারুকের মাধ্যেমে পরিচয় হয় নোমান সিদ্দীকির সাথে। সেই সূত্রধরে আরও কিছু পরীক্ষার্থী সংগ্রহ করেন রুপা। ওইসব পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে নেওয়া হয় ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা। সর্বমোট ১৮জন পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে নেওয়া টাকা বিকাশ ও রকেটে লেনদেনের বিষয়টি অস্বাভাবিক হওয়ায় নজরে আসে গোয়েন্দাদের। এরপর তারা নজরদারী শুরু করলে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি বেরিয়ে আসে।
এরপর গত ২১ জানুয়ারী কাফরুল থানার শেনপাড়া পর্বতার ৪৯৮/৪ ভবনের এ/২ ফ্ল্যাটে অভিযান চালানো হয়। এসময় সেখান থেকে নোমান সিদ্দীকিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তার বাসা ও দেহ তল্লাশি করে ৪টি মোবাইল ফোন সেট ও একটি ডিজিটাল ডিভাইস উদ্ধার করা হয়। পরে সেখান থেকে ৬ পাতা অডিটর নিয়োগ পরীক্ষার ২০২২ এর পার্ট-১ এর এমসিকিউ প্রশ্নপত্রের ফটোকপি পাওয়া যায়। একই সাথে একই পরীক্ষার ৮জন প্রার্থীর নামের তালিকা উদ্ধার করা হয়। ওই প্রার্থীরা হচ্ছেন- ফারদিন ইসলাম, লুৎফর রহমান, আমিনুল ইসলাম, সেলিম মাতবর, আহাদ খান, পারুল বালা, আকলিমা খাতুন ও মোরশেদ। একই সময় গ্রেপ্তার মাহমুদুল হাসান আজাদের দেহ তল্লাশি করে মফিজুর রহমান, পল্লব কুমার, হাসিবুল হাসান, সুরুজ আহম্মেদ নামে আরও ৪ জনের প্রবেশপত্র ও হাতে লেখা উত্তরপত্র উদ্ধার করা হয়।
একই অভিযানে গ্রেপ্তার নাইমুর রহমান তানজীর ও শহিদুল্লাহর কাছ থেকেও ফাঁস হওয়া প্রশ্নের উত্তরপত্র ও বিপুল পরিমান টাকা উদ্ধার করা হয়। এসময় তাদের কাছ থাকা একাধিক বিকাশ ও রকেটের নাম্বারে লাখ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের সম্ভাবনা থেকেই পুলিশ নজরদারী বৃদ্ধি করে। এছাড়া প্রশ্ন ফাঁস হবে এমন তথ্যও ছিলো গোয়েন্দাদের হাতে। এ ধরনের আশঙ্কা থেকেই চক্রের সদস্যরা পুলিশের ফাঁদে পা দেয়। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার সাবেক সেনা সদস্য নোমানসহ কয়েকজনের নামে কাফরুল থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেপ্তার চক্রের প্রধান আসামি নোমানের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি থানার চর আলগিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম মো. আবু তাহের মিয়া। প্রশ্ন ফাঁসের টাকায় তিনি ঢাকায় ও তার গ্রামের বাড়িতে অঢেল সম্পত্তির মালিক বনে গেছেন। এ বিষয় গুলোও তদন্তে তুলে ধরা হবে। এ ঘটনার তার সাথে ছাপাখানার কেউ জড়িত আছে কি-না তাও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকেও কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
জানা গেছে, নোমান সিদ্দীকির বাসায় অভিযান শেষে পুলিশ বিজিপ্রেস স্কুলে অভিযান চালায়। সেখান থেকে পরীক্ষারত অবস্থায় ভাইস চেয়ারম্যান রুপাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের ম্যাসেঞ্জার থেকে হিরণ খান নামে এক ব্যাক্তির সঙ্গে কথপোকথনের প্রমান পাওয়া যায়। সেখানে প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে তাদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা হয়। এমনকি ফাঁস হওয়া প্রশ্নের কিছু উত্তরও পাওয়া যায়।
এরপর পুলিশ রুপার দেওয়া তথ্যমতে রমনা থানাধীন ৫৫/১ নিউ শাহীন হোটেলের ২৪ নাম্বার রুমে অভিযান চালায়। এরপর সেখান থেকে মো. আল আমিন আজাদ রনি, মো. রাকিবুল হাসান, মো. হাসিবুল হাসান ও নাহিদ হাসানকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এসময় তাদের কাছ থেকে অত্যাধুনিক ডিভাইস উদ্ধার করা হয়। এসময় ডিভাইসের মাধ্যেমে পরীক্ষা কেন্দ্রে অবস্থান করা পরীক্ষার্থীদের কাছে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সমাধান পাঠানো হচ্ছিলো। একই সাথে তাদের কাছ থেকেও একাধিক বিকাশ ও রকেটের সিম উদ্ধার করা হয়। ওইসব সিম দিয়েও মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়।
গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, রমনার হোটেল থেকে গ্রেপ্তারকৃতদের নামে রমনা থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ওই মামলায় আসামি ৫জন। এছাড়া পলাতক হিসাবে আরও একাধিক ব্যাক্তির নামে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এসব বিষয় যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে এ মামলায় প্রশ্নফাঁসের রাঘব-বোয়ালদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।
এরআগে, গত ২১ জানুয়ারি শুক্রবার দুপুর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত রাজধানীর মিরপুর, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল ও রমনার বিভিন্ন এলাকায় পৃথক দুটি অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির গুলশান জোনের গোয়েন্দা বিভাগ। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৬ টি ইয়ার ডিভাইস, ৬ টি মাস্টার কার্ড মোবাইল সিম হোল্ডার, ৫ টি ব্যাংকের চেক, ৭ টি নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, ১০ টি স্মার্ট ফোন, ৬ টি ফিচার মোবাইল ফোন, ১৮ টি প্রবেশপত্র ও চলমান পরীক্ষার ফাঁস হওয়া ৩ সেট প্রশ্নপত্র জব্দ করা হয়।
এনএইচ/এএস