মার্কেটে আগুন: আরও সময় চেয়েছে তদন্ত সংস্থাগুলো
রাজধানীর বঙ্গবাজার ও নিউমার্কেটে আগুন ও সিদ্দিক বাজারে ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় পৃথকভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে কোনো তদন্ত কমিটিই প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আরও সময় চাওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিটি ঘটনায় পৃথকভাবে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশের বিশেষ শাখা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তদন্ত কমিটিগুলোকে ৭ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু এই সময়সীমা বেশ আগেই পার হয়ে গেছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, বেঁধে দেওয়া সময়সীমা পার হয়ে গেছে। নতুন করে আবেদন করা হয়েছে সময় বাড়ানোর জন্য। সবগুলো তদন্ত কমিটিই সময় বাড়ানোর আবেদন করেছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বললে পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, আগুন লাগার ধরন দেখে আমরা নাশকতার বিষয়টিও মাথায় রেখেছি। সেই অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে। সেজন্যই একটু সময় লাগছে।
রমজান মাসে রাজধানীর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের ৫১ ইউনিটের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। এই ঘটনায় সবকিছু পুড়ে যাওয়া ব্যবসায়ীদের কান্নার মাতম না থামতেই নিউ সুপার মার্কেটে ঘটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। এতে ফায়ার সার্ভিসের ৩০টি ইউনিটের কয়েক ঘণ্টার প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। তারও আগে সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ভবনটি একরকম ধ্বংস হয়ে যায়।
দুটি মার্কেটেই আগুন লাগে ভোরবেলা।এতে মনে করা হচ্ছে নাশকতা হতে পারে। এ ছাড়া সিদ্দিকবাজারের ভবনের বিস্ফোরণের ধরন দেখেও সংশ্লিষ্টদের ধারণা নাশকতা হতে পারে।
যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ রকম বিস্ফোরণ বা অগ্নিকাণ্ডের পেছনে মানুষের অসাবধানতা ও অজ্ঞতাকে দায়ী করছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। কর্মকর্তারা বলছেন, শুষ্ক মৌসুমে (অক্টোবর-এপ্রিল) সারাবিশ্বেই আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। মানুষ সচেতন হলে এটি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ঘনঘন কেন আগুন লাগছে তা ক্ষতিয়ে দেখতে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে রাজধানীর ৫৮টি বিপণিবিতান পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস। তারা তাদের পর্যবেক্ষণে জানায়, ৫৮টি বিপণিবিতানের সব ক'টিই অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে ৯টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ। বাকি ৪৯টির মধ্যে ৩৫টি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১৪টি মাঝারি মাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
রাজধানীর বিপণিবিতানগুলোর অগ্নিঝুঁকির মাত্রা কেমন, সেটি নিরূপণ করা ফায়ার সার্ভিসের নিয়মিত কাজের অংশ। তবে করোনাসহ বেশ কিছু কারণে ২০১৯ সালের পর ঝুঁকিপূর্ণ বিপণিবিতানের তালিকা হালনাগাদ করা হয়নি।
ফায়ার সার্ভিস বলছে- এসব বিপণিবিতান অগ্নিঝুঁকিতে থাকলেও ব্যবসায়ীরা বেশ উদাসীন। তারা সারা বছর কোনো কার্যকর উদ্যোগ বা পদক্ষেপ নেয় না। অগ্নিঝুঁকি কমাতে এসব মার্কেটে নেই নিরাপত্তা সরঞ্জাম, হয় না নিয়মিত মহড়া, নেওয়া হয় না অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। ফলে আগুন লেগে গেলে প্রাণহানিসহ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়।
তবে রমজানের মধ্যে এবার বেশির ভাগ মার্কেটগুলোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ভোরবেলা বা সেহরির পরে। এসব আগুনের ঘটনায় অনেকে আবার রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততার কথাও বলছেন। এ বিষয়ে সঠিক তদন্ত করে বিস্তারিত প্রতিবেদন পেলে সে বিষয়ে হয়তো জানা যাবে।
বঙ্গবাজার শপিং কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক বি এম হাবিব অভিযোগ করে বলেন, জমি ফাঁকা করার জন্য অগ্নিসংযোগ নাশকতার ঘটনা হতে পারে। এরই মধ্যে নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগল। এর আগে পুরান ঢাকায় দুটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আগুন লাগে। এতে আমাদের সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। আসলেই এই আগুন কিসের আগুন!
অল্প সময়ের মধ্যে একাধিক স্থানে অনেকটা একই প্যাটার্নে আগুন লাগা কতটা স্বাভাবিক- এমন প্রশ্নের জবাবে অগ্নি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার (অব.) আলী আহমেদ খান বলেন, আগুনের বিষয়টি একটা চিন্তার বিষয়। তদন্ত ছাড়া এই বিষয়ে কিছু মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে আমার মনে হয়, ইন্টেলিজেন্সগুলোর উচিত এটা তদন্ত করে দেখা। যেভাবে মার্কেটগুলোয় আগুন লাগার ঘটনাগুলো ঘটছে, সেটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব নিয়ে বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখা উচিত।
এই বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নাঈম মো. শাহিদউল্লাহ বলেন, নাশকতা মনে করলে আগে দেখতে হবে, এ ঘটনায় কে বা কারা লাভবান হচ্ছে। আর যদি কেউ লাভবান না হয় তাহলে এটা নাশকতা নয়।
এসব বিষয়ে তদন্তকারী সংস্থাদের পরামর্শ দিয়ে অপরাধ বিশ্লেষকদের দাবি, যেসব মার্কেটের জমি দখল বা মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে, সেসব বিষয়ে জোরদার তদন্ত করে অপরাধী যদি কেউ থাকে তা খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আবার নাশকতার অভিযোগে কোনো দল বা গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা যদি পাওয়া যায়, তবে তাদেরও বিষদাঁত ভেঙে দিতে হবে। তাদের দাবি, তদন্ত যেন না হয় কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। নচেৎ এ আগুনের লেলিহান শিখায় একদিন পুড়তে হবে নিজেকেই।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, হঠৎ সারাদেশে আগুনের ঘটনা বেড়েছে। এসব ঘটনা নাশকতা না কি সেই বিষয়টি বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলে। এমন ভাবে আলোচনার কারণ হল যে কোনো আগুনের ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে অনেক সময় লাগে। যার কারণে মানুষ আগে ভাগে নানা ধরনের আলোচনা করে। মার্কেটগুলোতে ঘনঘন আগুন কেন? নাকশতার গন্ধ নেই তো? হয়তো কিছু ঘটনায় নাশকতার চিত্র থাকতে পারে। ইতোমধ্যে মাঠে নেমেছে সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা। তারা ফাইনাল প্রতিবেদন জমা দিলে এই বিষয়ে আরও ভালোভাবে জানা যাবে।
আরইউ/এসএন