করপোরেট গিলে খাচ্ছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ক্ষতিগ্রস্ত ক্রেতারাও
করপোরেট প্রতিষ্ঠানের আগ্রাসনে হারিয়ে যেতে বসেছেন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উদ্যোক্তারা। বিশেষ করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উদ্যোক্তারা মুড়ি, চানাচুর তৈরি করে তা কম দামে বিক্রি করেন। হাসকিংসহ অটো রাইস মিল থেকেও কম দামে চাল বিক্রি করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সিটি গ্রুপ, আকিজ, প্রাণসহ বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান মুড়ি, চানাচুর, চালের ব্যবসায় নেমে প্যাকেটজাত করে অনেক বেশি দামে বিক্রি করছে। এসব খাতে তারা একেবারে বাজার দখল করে নিয়েছে। যার প্রভাব সরাসরি গিয়ে পড়ছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে।
শিল্পনীতির ফাঁকফোকরেই তারা গিলে খাচ্ছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আহার। শিল্পনীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের বিকাশের কথা বলা হলেও কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পখাতে বিনিয়োগে করপোরেটদের নিষেধ করা হয়নি। ফলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা হারিয়ে যাচ্ছেন। করপোরেটদের বিনিয়োগে মন্ত্রী থেকে শুরু করে শীর্ষ ব্যবসায়ীরাও ক্ষুদ্ধ। তারা বলছেন, করপোরেটরা সব জায়গয়ে বিনিয়োগ করলে ক্ষুদ্র ও ছোটরা যাবে কোথায়?
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সরেজমিনে দেখা গেছে, সিটি গ্রুপের তীর মিনিকেট ২৫ কেজি বস্তার দাম ১৮৫০ টাকা। প্রতি কেজির মূল্য ৭৪ টাকা। এটি পাইকারি দাম। তবে খুচরা প্রতি কেজি চাল বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকা। একইভাবে আকিজ গ্রুপের এসেনসিয়াল ২৫ কেজি মিনিকেট চালের দামও ১৮৫০ টাকা। যেখানে মোজাম্মেল, রশিদসহ অন্যান্য মিনিকেট চালের কেজি ৬৮ থেকে ৭০ টাকা। আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির আব্দুল আওয়ালসহ অন্যান্য চাল ব্যবসায়ীরা করপোরেট কোম্পানির চালের বাড়তি দামের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
দীর্ঘ দিনের ব্যবসার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে ওই চাল ব্যবসায়ীরা করপোরেটদের বেশি দাম নেওয়ার ব্যাপারে বলেন, গুণাগুণ একই হলেও প্যাকেটজাত করার কারণেই করপোরেট কোম্পানির চালের দাম বেশি। এতে ভোক্তাদের বাড়তি টাকা করপোটেরদের পকেটে যাচ্ছে। তারা আরও বলেন, কোম্পানি থেকে লোক এসে বলে ভালো চাল, আমরাও রাখি। কারণ অনেকে মনে করে, বেশি দাম তাহলে বেশি ভালো হবে।
আটারও একই দশা। হাজী স্টোরের জসিম, জব্বার স্টোরের জব্বারসহ অন্যান্য মুদি ব্যবসায়ীরা জানান, তীর, ফ্রেশসহ বিভিন্ন করপোরেটের দুই কেজি আটা ১৩০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। যেখানে খোলা আটার কেজি ৬০ টাকা। পোলাও চালও বেশি দামে বিক্রি করছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। খোলা চাল ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা বিক্রি করা হলেও প্রাণ, তীর কোম্পানির প্যাকেট চাল ১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে।
ভাই ভাই ট্রেডার্সের মুনির হোসেন ও মেসার্স রফিক ট্রেডার্সের রফিক জানান, কুষ্টিয়া, গাজীপুরের খোলা মুড়ি প্রতি কেজি ৮০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। আর বরিশালের মোটা চালের মুড়ি প্রতি কেজির দাম ১২০ টাকা। কিন্তু একটু দূরেই প্রাণসহ বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মুড়ির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা।
ওই মার্কেটের দ্বিতীয় তলার রফিক ট্রেডার্সের রফিক জানান, বিসমিল্লাহ বেকারির ৯০০ গ্রামের চানাচুর ৮০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। ৩০০ গ্রামের রুচি চানাচুরের দাম ৬৫ টাকা।
এটা যে শুধু কারওয়ানবাজারের চিত্র, তা কিন্তু নয়। মোহাম্মদপুরের পাইকারি বাজার কৃষিমার্কেট, টাউনহলের মতো বড় বড় বাজার থেকে শুরু করে পাড়া মহলায়ও করপোরেটরা ঢুকে গেছে। মোহাম্মদপুরের ফিউচার টাউন হাউজিং এর আলআমিন এন্টারপ্রাইজের মো. আনোয়ার এ প্রতিবেদককে বলেন, আগে বিভিন্ন এলাকার মুড়ি, চানাচুর কম দামেই বিক্রি করতাম। কিন্তু প্রাণ, সিটিসহ বিভিন্ন কোম্পানিও মুড়ি, চানাচুর, চাল, ডাল নিয়ে আসছে। তাদের পণ্যের দামও বেশি। তীর মিনিকেট ২৫ কেজি ১৮৭৫ টাকা। প্রতি কেজির মূল্য ৭৫ টাকা। ৫ কেজির মিনিকেট রুপচাঁদা চাল ৪৬০ টাকা। অথচ অন্য মিনিকেট কম দামে বিক্রি করা হচ্ছে। তারা প্যাকেটজাতের কারণেই বেশি দাম নিচ্ছে।
এভাবেই বিভিন্ন করপোরেট কোম্পানি বেশি দামেই চাল, আটা, ময়দা, তেল, চানাচুর বিক্রি করছে। তাদের ব্যবসার পরিধিও বাড়ছে। কিন্তু কুটির ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ওই সব পণ্য কম দামে বিক্রি করা হলেও তাদের ব্যবসা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের জাতীয় শিল্পনীতি-২০২২ এ শিল্পখাতের উন্নয়নের ব্যাপারে বলা হয়েছে-এসএমই নীতিমালা ২০১৯ এর আলোকে এসএমই ফাউন্ডেশন এবং বিসিক উদ্যোক্তা উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখসহ এর সার্বিক কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করা হবে এবং অপ্রাতিষ্ঠানিকখাতে কটেজ ও মাইক্রো শিল্পের বিকাশকে ত্বরান্তিত করা হবে। শিল্পখাতে নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তার ব্যাপারেও বলা হয়েছে।
এতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ প্রদানে বিসিকের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষিভিত্তিক, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ ও চামড়া শিল্পের উন্নয়নের জন্য আধুনিক সুবিধা সম্বলিত পরিবেশবান্ধব শিল্প পার্ক গড়ে তোলা হবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা একেবারেই ভিন্ন। বৃহৎ শিল্প বা করপোরেটদের চাপে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশ দূরের কথা, দিনে দিনে তলিয়ে যাচ্ছে। কারণ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উদ্যোক্তারা ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ না করেও চানাচুর, মুড়ি সরবরাহ করছে। তারা কম দামেও ভোক্তাদের এসব পণ্য সরবরাহ করছে।
অপরদিকে জাতীয় শিল্পনীতির আলোকে আমদানি বিকল্প পণ্য হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে এসব ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পেও কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। এরফলে সম্প্রতি সিটি গ্রুপ, প্রাণ, আকিজের মতো বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান এসব ব্যবসায় নজর দিয়েছে। ফলে তাদের প্রভাবে ছোট উদ্যোক্তারা হারিয়ে যাচ্ছেন। অপরদিকে ভোক্তাদেরও চাল, আটা, ময়দা, তেল, মুড়ি, চানানচুর বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এভাবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বাজার করপোরেটদের দখলে চলে যাওয়ায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
সিটি গ্রুপের তীর ব্র্যান্ডের আটা, চাল, ডাল নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা অমিতাব চক্রবর্ত্তীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এটা আমি দেখি না। যারা দেখেন তাদের সঙ্গে কথা বলেন। পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা দেখে থাকেন।
বিশ্বজিৎ সাহার সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার কোনো মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, করপোরেটরা ব্যবসা করবে। কিন্তু চাল প্যাকেটজাত করে কেজিতে ৫ টাকা বেশি দাম নিবে, এটা হতে পারে না। আমাদের কাছেও অন্য চাল ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছে। বাজারে আসলে দাম বাড়াচ্ছে করপোরেটরা। কারণ তারা নিজে ধান কিনে মজুদ করে রাখছে। কিন্তু তথ্য প্রমাণ না পেলে তো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। শিল্পনীতিতে কী আছে তাও দেখার বিষয়।
এদিকে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইএর সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন সম্প্রতি বলেছেন, সিটি গ্রুপসহ বড় বড় সাহেবরা চাল ব্যবসায়ে ঢুকে পড়েছে। একেকটা মিল দেড় থেকে দুই কিলোমিটার জুড়ে গড়ে উঠেছে। সিটির তীর চাল তারা খুচরাও বিক্রি করছে। এটা কেন? সব জায়গায় কেন তাদের যেতে হবে। এটা সরকারের দেখা উচিৎ। কারণ এভাবে চললে মুদির দোকানও বন্ধ হয়ে যাবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো মেজর ও হাসকিং রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও দিনাজপুর চেম্বারের পরিচালক শহিদুর রহমান পাটওয়ারী (মোহন) বলেন, পুঁজি থাকলে যে কেউ ব্যবসা করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কিছুটা নিয়ম মেনেই তা করতে হবে। যেভাবে পারব ভোক্তাদের কাছে বেশি দাম নেব, এটা কোনো ব্যবসা না। করপোরেটরা মিনিকেট চাল বাজারে বিক্রি করছে আমরাও অটো রাইস মিল থেকে সেই মিনিকেট চাল বিক্রি করছি কম দামে। ভোক্তাদের তা দেখতে হবে। তাহলে তারা একচেটিয়ে বাজার দখল করতে পারবে না। অন্যরা টিকে থাকবে।
পলিশ করে মিনিকেট নামে চিকন চাল বাজারে বেশি দামে বিক্রি করার ব্যাপারে জানতে চাইলে কৃষি অর্থনীতিবিদ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ড. শামসুল আলম এ প্রতিবেদককে বলেন, যে কেউ আইন মেনে বৈধপথে ব্যবসা করবে এটা দোষের কিছু না। কিন্তু বর্তমানে মিনিকেটের নামে ভোক্তাদের সঙ্গে ডাহা প্রতারণা করা হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকেও বলা হয়েছে মিনিকেট নামে কোনো জাত নেই। তারপরও কেন বাজার থেকে সরকার বন্ধ করছে না? এমন প্রশ্নের জবাবে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এজন্য আইন করতে হবে। অর্থনীতিবিদ হিসেবেই আমি বলছি এক ধানকে তিনবার কেটে অন্য চাল হিসেবে বিক্রি করা ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কিছু না।
এনএইচবি