অর্থ পাচারকারীদের ধরতে সিআইডির অভিযান কতটা সফল
বর্তমানে দেশের অর্থনীতির বিষফোড়া হলো অর্থ পাচার। আর এর অন্যতম মাধ্যম হলো হুন্ডি। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো সব টাকা বৈধ উপায়ে দেশে আসে না। হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানোর কারণে পাচার হয়ে যায় অনেকটাই। দিন দিন পাচার হওয়া টাকার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় অর্থ পাচার ঠেকাতে সিআইডির অভিযান ও বিভিন্ন কার্যক্রমের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
অবশ্য এসব বিষয় নিয়ে সিআইডি বলছে, ব্যাঙের ছাতার মতো হাজার হাজার অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জার রয়েছে দেশে। এসব মানি এক্সচেঞ্জারদের মাধ্যমে দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার করছে দুষ্কৃতীকারীরা। তবে পূর্বের তুলনায় বর্তমানে সিআইডির অর্থ পাচার প্রতিরোধের বিভিন্ন অভিযানে বেশ কিছু সফলতা এসেছে। সিআইডির দাবি, অর্থ পাচার রোধে যার যার অস্থান থেকে সর্তক থাকতে হবে। কোনো কিছু না বুঝলে আইনের সহযোগিতা নিলে অনেকটা এসব ঝামেলা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, মানুষের অভিযোগ অর্থ পাচার প্রতিরোধে সিআইডি কাজ করলেও তাদের অভিযানে তেমন কোনো প্রতিকার আসেনি। দিন দিন অর্থ পাচারের ঘটনা বেড়েই চলছে। অনেক সময় দেখা গেছে সিআইডি মিডিয়াতে কিছু পাচারকারীদের গ্রেপ্তার করে তারা ঢালাওভাবে প্রচার করছে। তবে এতে সর্তক হয়নি পাচার চক্র।
গত বছরের ৪ আগস্ট সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত ও অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, মোট পাঠানো রেমিট্যান্সের ৪৯ শতাংশ আসে হুন্ডির মাধ্যমে। কখনো কখনো এ শতকরা হার আরও বেড়ে যায়। এ প্রক্রিয়ায় পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার সমপরিমাণ বাংলাদেশি টাকা দেশে পরিশোধ করা হয়। বৈদেশিক মুদ্রা হুন্ডি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যায়।
সিআইডি থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বর্তমানে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি শুরু হলে হুন্ডি ব্যবসা অনেকটা কমে যায়। সেজন্য প্রায় দুই বছর বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসে এবং ২০২১ সালে আগস্টে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম দিক থেকেই করোনা মহামারির প্রকোপ কমে এলে হুন্ডি ব্যবসা আবার চাঙ্গা হয়। বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানো কমে যাওয়ার ফলে ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে; যা শতকরা হিসেবে ১৫ শতাংশ কম। শুধু হুন্ডির মাধ্যমেই নয়, আরও নানা উপায়ে দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়।
সিআইডির একটি সূত্র জানায়, অনেক পদ্ধতিতে অর্থ পাচার হয়। তবে এর মধ্যে দুর্নীতিবাজ সামরিক-বেসামরিক আমলা, রাজনীতিবিদ ও অসৎ ব্যবসায়ীরা এসব অর্থ পাচার করেন। অনেকেই অসৎ উপায়ে অর্জিত টাকা বিদেশে পাঠিয়ে দেন। আমদানি-রপ্তানির আড়ালে একশ্রেণির ব্যবসায়ী বিদেশে উন্নত জীবন কাটানোর কিংবা বিকল্প ব্যবসার উদ্দেশ্যে অর্থ পাচার করেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই কিংবা মালয়েশিয়ায় জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাট ক্রয় কিংবা ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসের বিকল্প ব্যবস্থার জন্য অর্থ পাচার করেন। মাদক ও অস্ত্র ব্যবসাসহ অন্যান্য অবৈধ ব্যবসার (যেমন ক্যাসিনো) মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে নিরাপদে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে পাচার করেন। উন্নত সুযোগ-সুবিধার জন্য স্ত্রী-সন্তানদের বিদেশে রাখা এবং নিজেও গোপনে ওই দেশের নাগরিক হয়ে ভবিষ্যতে নিরাপত্তার জন্য অর্থ পাচার করে জমা করেন।
সিআইডি বলছে, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের গন্তব্যস্থল সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে প্রাথমিকভাবে সেসব দেশে এবং পরবর্তী সময়ে অন্যত্র সুবিধামতো জায়গায় স্থানান্তরিত হয়।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) গত বছর সেপ্টেম্বরে অবৈধ হুন্ডি চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। সে সময় সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) একটি দল বেশ কয়েকজন অর্থ পাচারকারীদের গ্রেপ্তার করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য তথ্য পর্যালোচনায় এ হুন্ডি চক্রটির কার্যক্রম আমাদের নজরদারিতে রয়েছে।
তিনি বলেন, পাচার চক্রের একটি শক্তিশালী চক্র ইতালিতে রয়েছে তবে তাদের মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যা বেশি। তারা বিভিন্ন এলাকায় ছোট দোকানের মতো করে সেখানে বিকাশের লোগো ব্যবহার করে টাকা সংগ্রহ করে। তিনি বলেন, আমরা বিএফআইইউর (বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) কাছ থেকে পাওয়া এমএফএসের তথ্যের ভিত্তিতে হুন্ডির সঙ্গে জড়িতদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তারের চেষ্টায় আছি। তা ছাড়া অর্থ পাচারকারীদের যাবতীয় তথ্য পর্যালোচনা করে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে বিদেশে অর্থ পাচারকারীদেরও গ্রেপ্তার করা হবে।
অর্থ পাচারকারীদের ধরতে সিআইডির অভিযান কি ব্যর্থ- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সিআইডির বিভিন্ন অভিযানে অনেকটা সফলতা আসছে। অনেক সময় দেখা গেছে, আমাদের অভিযানে পচারকারীরা গ্রেপ্তার হয়। পাঁচটি মানি এক্সচেঞ্জের মধ্যে তিনটির অফিস থাকলেও বাকি দুটি প্রতারণামূলক বা ভ্রাম্যমাণ। এক্ষেত্রে অনেক সময় আইনপ্রয়োগের জটিলতা তৈরি হয় সেই ক্ষেত্রে সফলতা ব্যর্থতার কথা আসে। এ দেশে এমন কমপক্ষে হাজার হাজার অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জার রয়েছে যার মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে।
কেএম/এসএন