হাসপাতালে সেবা কম, ভোগান্তি বেশি!
অবৈধভাবে দালালদের অতিরিক্ত টাকা দিলে রোগী ও তার স্বজনদের ভোগান্তি কম হয়। আর যদি নিয়ম অনুযায়ী চিকিৎসা সেবা নিতে যায় তাহলে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সম্প্রতি রাজধানীর বেশ কয়েকটি সরকারি হাসপাতাল ঘুরে রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কথা হয়, ২১৯ নম্বর ওয়ার্ডের ১৪ নম্বর বেডে স্বামী নিয়ে চিকিৎসাধীন সাহিদা আক্তারের সঙ্গে। এ সময় সাহিদা জানান, অবৈধভাবে দালালদের অতিরিক্ত টাকা দিলে ভালো সেবা পাওয়া যায়। আমাদের টাকাও নেই সেবাও তেমন নেই বললেই চলে।
হাসপাতালের দালাল কারা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে বুয়া, বাবুর্চি, ড্রাইবার, কেয়ারটেকার ও নতুন নতুন কিছু স্বাস্থ্য কর্মীরাও দালালের কাজ করেন। অনেক সময় তারা ডাক্তাদের বিভিন্ন আত্মীয় স্বজন বানিয়ে নানা ধরনের সেবা নেয়।
রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, নিয়ম অনুযায়ী সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে গেলে অনেক জটিলতায় পড়তে হয়। শুধু সকাল এবং রাতে এক ঝলক ডাক্তারের দেখা মেলে। পরিচিত লোক এবং দালাল না থাকলে অনেক ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সরকারি হাসপাতালগুলোতে সেবা দালালদের কাছে জিম্মি রোগী ও তার স্বজনেরা!
অভিযোগ আছে, রোগী ভোগান্তির অন্ত নেই, সেখানে দালালদের কাছে জিম্মি স্বজনরা। অনেকেই সঠিক চিকিৎসার জন্য নাম সর্বস্ব প্রাইভেট হাসপাতালে খোয়াচ্ছেন টাকা।
ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেল যেহেতু বড় একটি জায়গা এখানে সবাইকে আসলেই সমান দেখা সম্ভব হয় না। তবে আগের থেকে তুলনামূলকভাবে রোগীদের ভোগান্তি অনেকটা কমে গেছে। তা ছাড়া দালাল চক্র এবং রোগীদের জিম্মি করা অন্যান্য চক্রদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করি।’
ঢামেকে রোগীদের অভিযোগ সেবা পেতে ভোগান্তি পড়তে হয় এবং দালালদের কাছে জিম্মি রোগীর স্বজনদের থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপনার কাছে যদি সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে আমাদের জানান। আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব। তবে আপনি যে সব কথা বললেন এর মধ্যে রোগীদের অনেক অভিযোগ ভিত্তিহীন আছে। আমরা বিভিন্ন রোগীদের দায়িত্ব নিয়ে সেবা দিয়ে থাকি। ঢামেকে সেবা পাচ্ছে না এমন কোনো রোগীর সন্ধান পেলে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন বিষয়টি আমি নিজেই দেখব।’
মিরাজ মাহমুদ কুমিল্লা থেকে ৩ মাস বয়সী ছোট মেয়েকে নিয়ে এসেছেন ঢাকার শিশু হাসপাতালে। কথা হয় মিরাজ মাহমুদের সঙ্গে। তিনি বলেন, কুমিল্লার একটি বেসরকারি হাসপাতালে সিজারের সময় পেটে ছিদ্র হয়ে যায় তার। ৩ দিন ধরে শিশু হাসপাতালে সিট না পেয়ে বারান্দায় থাকেন তারা। সঠিক সময়ে ডাক্তারের সেবা না পেয়ে হতাশ তিনি।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমাদের পেছনে যারা হাসপাতালের বারান্দায় ভর্তি হয়েছিল তাদের অনেকেই লোক ধরে সিট পেয়েছে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দালাল বা লোকজন না থাকায় চিকিৎসা সেবা পেতে অনেক কষ্ট হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘সঠিক সময়ে যদি আমরা চিকিৎসা সেবা না পাই তাহলে তো রোগীর বিভিন্ন সমস্যা হবে। এখন বুঝেছি মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে কেনো যায়।’
শিশু হাসপাতালের বারান্দায় কথা হয় আরেক রোগী ফাতেমার স্বজন মনির হোসেনের সঙ্গে। মনির হোসেন বলেন, সরকারি হাসপাতালে রোগীদের ভোগান্তির শিকার হতে হয় বেশ। একদিকে সেবা কম অন্যদিকে দালালদের কাছে জিম্মি হতে হয় স্বজনদের। দালাল না ধরলে হাসপাতালের বারান্দায় পড়ে থাকতে হয়।
শিশু হাসপাতালের নার্স, ওয়ার্ডবয় ও ক্লিনারদের ব্যবহার খুব খারাপ। এমন অভিযোগ করে শাহাজাহান তরফদার বলেন, আমাদের সঙ্গে হাসপাতালের কর্মচারীরা খারাপ ব্যবহার করে। যা বলার মতো না।
ঢাকা শিশু হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অনেকটা পাশাপাশি। রাজধানীর সরকারি এই হাসপাতালগুলোর সেবা নিয়ে যেন অভিযোগের শেষ নেই।
এসব অভিযোগ সম্পর্কে চাইলে শিশু হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. হাকিম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘শিশু হাসপাতলে দালালদের বিরুদ্ধে নিয়মিত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অভিযান চালিয়ে থাকে। হাসপাতালে রোগীরা যেহেতু শিশু সেই ক্ষেত্রে দালালরা যাতে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের কোনোভাবে জিম্মি করতে না পারে সেজন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তবে আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে এসে ভোগান্তির কম হয়।’
সেবা গ্রহীতারা বলছেন, ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ম মেনে সেবা নিতে গেলে পদে পদে অনিয়ম করে কাজ করতে হয়। অন্যথায় সেবা পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীরা বেশি ভোগান্তিতে পড়েন। তবে তদবির আর টাকা হলে সব কিছু ঠিকঠাক আছে।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) এর সামনে কথা হয় এক ‘দালালের’ সঙ্গে। এ সময় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই দালাল বলেন, সকাল দুপুর ও বিকাল টাইমে দালাল চক্রের সদস্যরা রোগী ভাগানোর কাজ করে। এতে করে আশেপাশের হাসপাতাল থেকে তারা কমিশন পান।
শ্যামলী এলাকায় অবস্থিত বিভিন্ন হাসপাতালের সামনে কথা হয় একাধিক দালালের সঙ্গে। এ সময় জানা যায়, দালালদের স্ত্রীরাও দালালের কাজ করে। তারা একেক সময় একেক নাম ব্যবহার করে। তবে এই এলাকার সব হাসপাতালের মূল দালাল হলেন- বিল্লাল সর্দার। আর এর সর্দারনী হলেন তার স্ত্রী মোছা. ফাতেমা। তাদের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি হাসপাতালে রোগী পাঠানো হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. খলিলুর রহমান বলেন, আমি যোগদানের পর সেবার মান বৃদ্ধি করেছি। যেহেতু এটি একটি বড় হাসপাতাল সেই ক্ষেত্রে আমাদের কিছু সমস্যা হয়তো থাকে। আর হাপাতালের স্বার্থে এবং রোগীদের জন্য যা করণীয় আমরা করে থাকি। আর আমাদের হাসপাতালের লোকজন দালালীর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে এমনটা যদি প্রমাণ হয় তাহলে আমরা বিষয়টি আমলে নিয়ে কাজ করব।
তিনি বলেন, কিছু রোগী এবং তার স্বজনেরা বারান্দায় আছে। তারা হয়তো কিছু অভিযোগ করতে পারে। ৫০টি বেড আসবে। সেগুলো এলে এসব সমাধান হয়ে যাবে। তিনি বলেন, দালাল ও হাসপাতালের কর্মচারীদের আমরা বিভিন্নভাবে তদারকি করছি। বিশেষ ক্ষেত্রে প্রায় প্রতিদিন আমাদের হাসপাতালে দালাল চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। হাসপাতালে লোকবল কম থাকায় প্রথম দিকে কিছু সমস্যা ছিল। বর্তমানে সব কিছু আমরা সমাধানের জন্য কাজ করছি। যদি কেনো রোগী বা স্বজনেরা তেমন কিছু না বোঝে তাহলে তাদেরকে আমাদের লোকজন সহযোগিতা করে থাকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আসলে দালাল চক্রদের বিরুদ্ধে আমাদের নিয়মিত অভিযান চলমান রয়েছে। অনেক হাসপাতালে প্রায়দিন অভিযান চলে। সবচেয়ে বড় কথা হলো যেকোনো সেবামুখী মানুষদের সতর্ক হতে হবে, না বুঝলে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষকে অবহতি করতে হবে। দেখবেন অনেকটা এসব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মো. ফারুক হোসেন বলেন, অনেক সময় আপনারা লক্ষ্য করবেন আমাদের মেট্রাপলিটন পুলিশ ঢাকা মেডিকেলসহ অন্যান্য হাসপাতালে দালাল চক্রদের ধরার জন্য বিভিন্ন ফাঁদ পেতে থাকে। দালালরা আমাদের অভিযানে ধরা পড়ে কিন্তু এরা বের হয়ে আবার একই কাজ করে। সবচেয়ে বড় কথা হলো যেকোনো অসাধু চক্র থেকে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ বিরত থাকলে এসব অপরাধ অনেকটা কমে আসবে।
কেএম/এমএমএ/