প্রতারণা করে বিক্রি হচ্ছে ‘বিষ’ মেশানো লাল চিনি
চিনির তুমুল সংকটের মধ্যে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সাদা চিনিতে লাল রং মিশিয়ে দেশীয় চিনি পরিচয়ে চড়া মূল্যে বাজারে বিক্রি করছে। বিষয়টি ধরা পড়েছে সরকারের জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানেও। তারপরও বন্ধ হয়নি প্রতারণা।
তারা বলছেন, চিনির সংকটকে পুঁজি করে একশ্রেণির অসাধু চক্র সাদা চিনিতে বিষাক্ত রং মিশিয়ে ‘দেশি লাল’ চিনির নামে ১৫৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছে। যা আসলে লাল চিনি না। কারণ সরকারি লাল চিনির প্রতি কেজির খুচরা বিক্রয় মূল্য ১১২ টাকা। তারপরও লাল চিনির নামে গাংচিল, সতেজ ফুড, মাশিরা বিডি, সেবা মার্কেটিং এর চিনিতে সয়লাব হয়ে গেছে।
অন্যদিকে সরকারের বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য করপোরেশন (বিএসএফসি) কর্তৃপক্ষ বলছে, ডিলারদেরকে দেওয়ার মতো তাদের পর্যাপ্ত চিনিই নেই। তা ছাড়া তাদের চিনির প্রতি কেজির খুচরা মূল্য ১১২ টাকা। এর চেয়ে বেশি দামে যেমন কেউ এটা বিক্রি করতে পারবে না, তেমনি এই চিনি নিয়ে কেউ অন্য নামে প্যাকেট করেও বিক্রি করতে পারবে না।
অথচ বাজার সয়লাব লাল চিনিতে! ভোক্তাকে শুধু ঠকানোই হচ্ছে না। প্রতারণা করে রং মেশানো বিষাক্ত চিনি যেমন পাওয়া হচ্ছে, তেমনি সাধারণ ক্রেতাদের পকেট থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সংঘবদ্ধ চিনি প্রতারক চক্র।
সরকার প্রতি কেজি প্যাকেট চিনির দাম ১০৭ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও সিটি, মেঘনা, দেশবন্ধু, ইগলুসহ ৫টি রিফাইনারি কোম্পানি ডিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের চিনি দিচ্ছে না। স্বাভাবিক সরবরাহ বন্ধ থাকায় ভোক্তারাও চিনি পাচ্ছেন না। রমজানের আগে চিনির বাজারের অস্থিরতা ডিলার-পাইকার তো বটে, সাধারণ ক্রেতাদেরকেও রীতিমতো আতঙ্কিত করে তুলেছে।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে চিনির বিষয়ে ডিলার, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলেও পাওয়া যায় চিনি নিয়ে জাল-জালিয়াতির সত্যতা। তারা বলছেন, এসব অসাধু ও প্রতারক চক্রকে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক।
ঢাকাপ্রকাশ-এর অনুসন্ধানে জানা গেছে, খুচরা বাজারে সাদা চিনির সংকটের সুযোগে প্রতারকচক্র বিভিন্ন নামে লাল চিনি বেশি দামে বিক্রি করে কাঁচা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন বলছে, আগে প্যাকেট লাল চিনির প্রতি কেজির খুচরা মূল্য ছিল ৯৯ টাকা। গত ১৩ ডিসেম্বর থেকে ১৩ টাকা দাম বাড়িয়ে এখন বিক্রি করা হচ্ছে ১১২ টাকা। আর খোলা চিনির কেজি ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ১০৫ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। এর চেয়ে বেশি দামে কেউ বিক্রি করলে তা প্রতারণা হিসেবে ধরে নিতে হবে। এরকম প্রতারণা করায় ঢাকার এসপি ফুড প্রোডাক্টস, গ্রামীণ ফুড প্রোডাক্টস ও ফেয়ারডিল কনজুমার প্রোডাক্টস ও গাংচিল নামে কথিত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও ভোক্তা অধিদপ্তরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
বিএসএফসির প্রধান মো. মাযহার উল হক খান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দেওয়ার পর করপোরেশনের হাতে চিনি তেমন একটা থাকে না।
তিনি বলেন, মাসে একজন ডিলারকে পাঁচ বস্তা অর্থাৎ ২৫০ কেজি চিনি দেওয়া হয়। আমরা ডিলারদের কাছে ১০৭ টাকা কেজি বিক্রি করি। তারা খুচরা বাজারে ১১২ টাকায় বিক্রি করে। কাজেই কোনো ডিলার ১১২ টাকার বেশি দামে বিক্রি করতে পারে না। কেউ করলে বুঝতে হবে তারা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ভোক্তাদের ঠকাচ্ছে। কারণ কোনো অনুমোদিত ডিলার বিএসএফসির প্যাকেট ছাড়া অন্য কোনো নামে চিনি বিক্রি করতে পারে না।
মাশিরা, গাংচিলসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান তাদের নামে প্যাকেট করে সরকারি চিনি বলে ১৫৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, এটা করলে বুঝতে হবে তারা প্রতারণা করছে। মাশিরা আমাদের ডিলার হলেও ১১২ টাকার বেশি বিক্রি করতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, ঢাকা জেলায় ৬০৬ জন হোলসেল ডিলার রয়েছে। এর মধ্যে মাশিরার নাম পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ আমাদের প্যাকেটও ব্যবহার করতে পারে না।
লাল চিনির নামে বিষ
ঢাকাপ্রকাশ-এর অনুসন্ধানে জানা গেছে, গাংচিল, সতেজ ফুড,মাশিরা, সিবা ফুডসহ সেসব নামে প্যাকেট করে লাল চিনি নামে ১৫৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে তার পুরোটাই প্রতারণা। কারণ চিনির উৎপাদন কম হওয়ায় চিনি করপোরেশন লাল চিনি সরবরাহই করতে পারছে না।
বাজার ঘুরে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, মাশিরা বিডি লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের প্যাকেটজাত চিনি রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজির খুচরা মূল্য ১৫৫ টাকা। যা একেবারেই অস্বাভাবিক। আর এসব প্যাকেটের গায়ে লেখা আছে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অনুমোদিত ডিলার।
শুধু মাশিরা নয়, গত দুই সপ্তাহ আগেও বাজারে একইভাবে সেবা ফুড, গাংচিল ও সতেজ ফুড তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে প্যাকেটজাত চিনি সরবরাহ করেছে লাল চিনি বলে। প্যাকেটের গায়ে দাম চিনি ও খাদ্য করপোরেশনের অনুমোদিত ডিলার উল্লেখ করে প্রতি কেজি চিনির দাম ১৫৫ টাকা বিক্রি করা হয়েছে।
লাল চিনির রহস্য জানতে গত তিন দিন ধরে মাশিরা বিডি সম্পর্কে অনুসন্ধান করে সোমবার পাওয়া গেল প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার এস এম শহিদুল্লাহ ইমরানকে।
তিনি ঢাকাপ্রকাশ-এর কাছে দাবি করেন, আমি প্রতারণা করছি না। আমি চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অনুমোদিত ডিলার। অন্য ডিলারদের কাছ থেকে বেশি দামে ডিও কিনে থাকি। ১৭০০ ডিলারকে মাসে ২৫০ কেজি চিনি দেওয়া হয়। কিন্তু এই চিনিতে একজন ডিলারের হয় না। তখন আমরা অন্য ডিলারের কাছ থেকে ডিও কিনি। প্রতিটি ডিও কিনতে হয় ৬ হাজার ৫০০ টাকায়। এত দাম দিয়ে কেনার পর ১১২ টাকায় আর বিক্রি করা যায় না।
এসময় তিনি বেশ উত্তেজিত হয়ে বলেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি। আমি সাংবাদিকতা লাইনের লোক। আপনি ভোক্তা অধিদপ্তরে, চিনি করপোরেশনে যান। সব জানতে পারবেন। আমার ১০০ টন লাগে। প্রতি কেজিতে ২৫ টাকা বেশি দিতে হয়। তাই দাম বেশি। ১১২ টাকা খুচরা রেট। ১০৭ টাকা কেজি কেনা হয়। আমি কি কম দামে লস করে বিক্রি করব নাকি?
আপনি তো ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে অনেকটা ক্ষিপ্ত হয়ে ইমরান বলেন, আমরা বেশি দামে কিনি তাই খুচরা বিক্রয় মূল্য ১৫৫ টাকা করেছি। আমরা কোনো জালিয়াতি করি না। কারণ আমরা বিএসটিআই থেকে ট্রেডমার্ক লাইসেন্স নিয়ে মাশিরা ব্রান্ডের নামে ধানমন্ডি, ঢাকা ঠিকানা ব্যবহার করে ব্যবসা করছি।
এসময় তিনি পাশে থাকা তার সহযোগী কামরুল হাসানকে ফোন ধরিয়ে দেন। কামরুল হাসান বলেন, আমরা দুই জনে মিলে কারখানা করেছি। সেখানে চিনি প্যাকেট করি, তারপর বাজারজাত করি। এতে অনেক খরচ। বেশি করে চিনি বিক্রি করতে না পারলে কারখানা চলবে না। সরকার ২৫০ কেজি করে বরাদ্দ দেয়। তা দিয়ে তো কারখানা চলে না। তাই বেশি দামে ডিও কিনি।
চিনি ও খাদ্য করপোরেশনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি) আবার ইমরানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, আমি নিজে ডিলার না। পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়েছি এক ডিলারের কাছ থেকে। সে আমাকে চিনি বিক্রি করার পাওয়ার দিয়েছে। সেই ডিলারের নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা বলা যাবে না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চিনি করপোরেশন কত বরাদ্দ (অ্যালটমেন্ট) দেয় তার উপর নির্ভর করে। তবে মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টন চিনি বিক্রি করা হয়। পুলিশ লাইন, কচুক্ষেত থেকে প্রতি বস্তা (৫০কেজি) চিনি ৬ হাজার ২০০ টাকা বা প্রতি কেজি কেনা হয় ১২০ টাকা করে। এর সঙ্গে অফিস খরচও রয়েছে। এজন্য দাম বেশি।
ভোক্তা অধিকার যা বলছে
চিনি নিয়ে আসলে হচ্ছে কী? ১১২ টাকার লাল চিনি কেউ ১৫৫ বা ১৬০ টাকা বিক্রি হচ্ছে? জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিউজ্জামান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমরা তথ্য প্রমাণ পেলে অবশ্যই অ্যাকশনে যাব। সরকারের বেঁধে দেওয়া রেটের বেশি কেউ কোনো পণ্য বিক্রি করতে পারে না। এর আগেও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সাদা চিনিতে ক্ষতিকর রং মিশিয়ে ‘লাল চিনি’ নামে বেশি দামে বিক্রি করায় সতেজ এবং গাংচিলের লাল চিনি ধ্বংস করা হয়।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্যাকেট চিনি ও খোলা চিনির রেট বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এর বেশি নিলে অবশ্যই তা দেখা হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কাজ করছে। চিনির সংকট চলছে। এটা কাজে লাগাচ্ছে একশ্রেণির প্রতারক চক্র। তারা ভিন্ন ভিন্ন নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করে প্রতারণা করছে।
এ ব্যাপারে ক্যাবের সহ-সভাপতি কাজী আব্দুল হান্নান বলেন, এটা অবশ্যই প্রতারণা। এ অনিয়মগুলো দীর্ঘদিন থেকে চলছে। বিশেষ করে তেল ও চিনির ক্ষেত্রে। এজন্য কয়েকটা ফ্যাক্টরিতে অভিযানও হয়েছে। এর সত্যতা পাওয়া গেছে। আমরা সরকারকে অ্যাকশনে যেতে বলেছি।
প্রতারণা করলে রক্ষা নেই
বিএসএফসির চেয়ারম্যান মো. আরিফুর রহমান অপু বলেন, আমাদের ডিলার হলে বাজারে তাদের ১১২ টাকা কেজি চিনি বিক্রি করতে হবে। তারা আমাদের প্যাকেটে অন্য নামে লাল প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি করতে পারবে না। আবার আলাদা প্যাকেট করে সরকারের কোনো চিনিও বিক্রি করতে পারে না। করলে তা প্রতারণা। আর খোলা চিনিও ১০৫ টাকার বেশি বিক্রি করা যাবে না। আমাদের কাছেও তথ্য এসেছে কয়েকটা কোম্পানি বিভিন্ন দামে চিনি বিক্রি করছে। তাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ভোক্তা অধিদপ্তর ও নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এনএইচবি/এসজি