বিশেষ সাক্ষাৎকার
নিজেদের প্রতীকে নির্বাচন করব: রাশেদ খান মেনন
দিন যত যাচ্ছে, জোট-মহাজোটের হিসাব ততই খোলসা হচ্ছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো প্রস্তুতি শুরু করেছে। নিজেদের সাংগঠনিক কার্যক্রমে জোর দিয়েছে দলগুলো। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। গত দুই নির্বাচনে নৌকায় চড়ে বৈতরণী পার হয়েছেন মহাজোটের শরিক হেভিওয়েট নেতারা। এভাবে রাজনৈতিক মহলে নিজ দলের অবস্থানকে নড়বড়ে করেছেন তারা। তাই এবার নৌকায় চড়তে চান না শরিক দলের অনেক নেতা। নিজ দলের প্রতীকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে তারা। সম্প্রতি একান্ত সাক্ষাৎকারে আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে নিজেদের চিন্তা-ভাবনা ঢাকাপ্রকাশকে জানিয়েছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার শাহজাহান মোল্লা।
ঢাকাপ্রকাশ: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আপনার দলের প্রস্তুতি কেমন?
রাশেদ খান মেনন: আমাদের দলের ১০ম কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত হয়, আমরা ১৪ দলে থাকলেও নিজের প্রতীকে নির্বাচন করব। আগে যেমন নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেছি, এখন নৌকা প্রতীক নেব না। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগকে অনুরোধ করব–আমরা নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করব। আমাদের সিদ্ধান্ত হলো–অন্য শরিকরাও যেন তাদের দলের প্রতীকে নির্বাচন করে। এটা আমাদের ইচ্ছে।
ঢাকাপ্রকাশ: নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সংসদ সদস্য হয়েছেন আবার মন্ত্রীও হয়েছেন। এখন হঠাৎ কি হলো যে নৌকায় চড়তে চান না?
রাশেদ খান মেনন: নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করার বড় কারণ হলো–বাধাহীনভাবে কথা বলা। নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে না পারলে সংসদে কথা বলা ৭০ বিধির কারণে বাধা হয়ে দাড়ায়। এই ধরনের কোনো বাধার সামনে যেন না পড়তে হয়, যাতে আমরা খোলাখুলি মত প্রকাশ করতে পারি সংসদে এবং সংসদের বাইরেও। এই সুবিধার জন্য নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করতে চাই। আমরা এখনও মনে করি, সামনের নির্বাচনে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে ঐক্য দরকার আছে এবং সেই পর্যায়ে নির্বাচন হবে। তবে এটি নির্ভর করবে–আওয়ামী লীগ কতটা প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।
ঢাকাপ্রকাশ: আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে তো আপনারা আছেন? ১৪ দলের বর্তমান অবস্থা কী?
রাশেদ খান মেনন: ১৪ দলের কার্যক্রমে খুব একটা আশান্বিত হচ্ছি না। করোনাকালীন তো বটেই, করোনার আগেও কেবল দিবস পালন ছাড়া অন্য কোনো কাজ করিনি। যেমন–সম্প্রতি সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সংগঠিত হলো বাংলাদেশে। অতীতে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়ে জামায়াতে ইসলাম-বিএনপি যখন একটি সংকট তৈরি করল, তখন আমরা জনগণের কাছে গিয়েছিলাম। অথচ সাম্প্রতিককালে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়েছে, অথচ মানুষের কাছে যেতে পারিনি। এটি নিয়ে কেবল ভার্চুয়াল মাধ্যমে কিছু আলোচনা করেছি। সেখানেও খুব বেশি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এমন নয়। শুধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি–এগুলো কেবল নাম রক্ষা। নাম রক্ষা করলে হবে না। মানুষকে নিয়ে রাজনীতি করেই কেবল রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে।
ঢাকাপ্রকাশ: ১৪ দলের নতুন সমন্বয়ক আসাতে কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?
রাশেদ খান মেনন: সমন্বয়ক বিষয় না। শরিকদের কাছে আওয়ামী লীগের চাওয়া কি সেটাও তো বুঝতে হবে। আগের সমন্বয়ক থাকাতে সুবিধা ছিল যে, তিনি নিজে সরাসরি সক্রিয় ছিলেন। এখনকার সমন্বয়ক বয়োজ্যেষ্ঠ। তার পক্ষে করোনাকালে দৌড়ঝাঁপ করাটা একটু মুশকিল, এটি আমরা যেমন করতে পারছি না, তিনিও করতে পারেননি। সীমাবদ্ধতা রয়েই গেছে। আমাদেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এটি তার ব্যাপার না। সামগ্রিকভাবে আওয়ামী লীগ কি ভাবছে সেটিই বড় কথা।
ঢাকাপ্রকাশ: আপনি নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করার কথা বলেছেন; কিন্তু অনেকে বলেন–নৌকা ছাড়া নির্বাচন করলে সুবিধা করতে পারবেন না। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
রাশেদ খান মেনন: এটি সঠিক না। আমি আমাদের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে আরও দুইবার নির্বাচিত হয়েছি। আমাদের সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা হাতুড়ি মার্কা নিয়ে বিএনপির সেই চক্রান্তের ভোটেও বিএনপি প্রার্থীকে প্রায় পরাজিত করেছেন। আমাদের অন্য সদস্যরাও দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আমাদের প্রতীক নিয়ে দুইজন প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে হেরে যাব! তাহলে আমি এতবার সংসদ সদস্য হলাম কি করে? আমি তো এই তিনবারই সংসদ সদস্য না। এর আগেও সংসদ সদস্য ছিলাম; বরং সেই সময় অনেক বেশি কাজ করতে হয়েছে।
ঢাকাপ্রকাশ: আপনি একটি অনুষ্ঠানে একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। আপনার বর্তমান অবস্থানটা কী?
রাশেদ খান মেনন: শুধু একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে বলেছি বিষয়টি তা নয়। আমি সব নির্বাচন নিয়েই কথা বলেছি। এখন তো অনেক নির্বাচন, বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যা হচ্ছে, তা দেখলেই বোঝা যাবে–নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ধসে পড়েছে। এই যে হানাহানি-মারামারি হচ্ছে, এই যে হুমকি-ধামকি দেওয়া হচ্ছে–নির্বাচন কমিশন কি কিছু করতে পেরেছে?
ঢাকাপ্রকাশ: বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ফেব্রুয়ারিতে। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আপনার দলের অবস্থান কী?
রাশেদ খান মেনন: আমরা সব সময় বলে আসছি, নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান অনুসারে আইনের ভিত্তিতে গঠন করাটা বাঞ্ছনীয়। হুদা কমিশন থেকে শুরু করে এ কথাটি বারবার বলে আসছি; কিন্তু আইনটি এখন পর্যন্ত না বিএনপি করেছে, না আওয়ামী লীগ করেছে? আমরা মনে করি, এখনও যে সময় আছে, তাতে একটি আইন করা খুব অসম্ভব নয়। আইনের ড্রাফট করা আছে। শামসুল হুদা কমিশন ড্রাফটা করে দিয়েছিল। সংসদে না করা গেলে অধ্যাদেশ জারি করেও আইন হতে পারে। সেটি একান্তভাবে সম্ভব না হলে, মন্দের ভালো সার্চ কমিটির মাধ্যমে।
ঢাকাপ্রকাশ: আইনমন্ত্রী তো বলে দিয়েছেন, নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আইন এই সময়ে করা সম্ভব না...
রাশেদ খান মেনন: কেন সম্ভব না? ড্রাফট তো করাই আছে। ওই ড্রাফট নিলেই তো হয়। আর যদি সম্ভব না হয়, তাহলে তো অধ্যাদেশও জারি করতে পারে।
ঢাকাপ্রকাশ: সার্চ কমিটির মাধ্যমে যে কমিশন গঠন করা হবে, সেটিতে আপনাদের আস্থা কতটুকু?
রাশেদ খান মেনন: সার্চ কমিটির কারণে তো কমিশন প্রশ্নবিদ্ধ হয় না। নির্বাচন কমিশন তার নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ না করে যদি আজ্ঞাবহ হয়ে যায়, তাহলে তার পরিণতি যা হওয়ার তা-ই হবে। আইনে নির্বাচন কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হয়, তারা সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করছে না। তারা চোখের সামনে দেখছে ঘটনাবলি, এখন তারা বলছে প্রশাসন দায়ী। প্রশাসন তো তাদের অধীনেই থাকছে নির্বাচনের সময়। প্রশাসন যদি দায়ী হয়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক। নির্বাচন কমিশন যদি সরকারকে কোনো ডিসি বা এসপিকে সরিয়ে দিতে বা ব্যবস্থা নিতে বলে, তাহলেই তো সরকার সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
ঢাকাপ্রকাশ: বারবার কেন সাম্প্রদায়িক হামলা হচ্ছে?
রাশেদ খান মেনন: কোনো কারণ আমি দেখি না। গত তিন দশক ধরে, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায় থেকে রাজনৈতিক স্থবিরতায় সাম্প্রদায়িকীকরণ হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা সমাজের মধ্যে এমনভাবে বিস্তার লাভ করেছে যে, যারা বামপন্থী বলে দাবি করেন, তাদের অনেকে রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে কথা বলতে রাজি না। কারণ তাদের ভয়–ভোট নষ্ট হবে। বঙ্গবন্ধু শপথ নেওয়ার সময় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। আমরা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে চরম লড়াই করেছি। আমাদের তরুণ প্রজন্মের যদি এই অবক্ষয় হয়ে যায়, তাহলে তো মুশকিল।
ঢাকাপ্রকাশ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
রাশেদ খান মেনন: আপনার মাধ্যমে ঢাকাপ্রকাশকেও ধন্যবাদ।
এসএম/এএন