বিলুপ্তির পথের বন্যপ্রাণীরা
আলম শাইন
গত তিনদশক আগেও আমাদের দেশে অসংখ্য বন্যপ্রাণীর সমাগম ছিল। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল ছিল বন্যপ্রাণীদের স্বর্গরাজ্য। সাঁঝের বেলায় শিয়ালের হাঁকডাক কিংবা বাগডাশার হুঙ্কারে কলজে কেঁপে উঠতো সে সময়। আজকাল আগের মতো তেমন একটা শোনাও যায় না বন্যপ্রাণীদের হাঁকডাক। আগের মতো সে রকম বন্যপ্রাণীর আনাগোনাও নজরে পড়ে না এখন আর। নানাবিধ কারণেই দেশ থেকে ওরা হারিয়ে যেতে বসেছে আজ। তার মধ্যে প্রধান কারণগুলো হচ্ছে ১. বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস করে দেওয়া। ২. অবাধে বৃক্ষ নিধন (বিশেষ করে গাছের প্রাকৃতিক কোটরে যে সব পাখি বাসা বাঁধে তাদের প্রজননে বিঘœ ঘটছে ব্যাপক)। ৩. খাদ্য সংকট। ৪. জলাশয় ভরাট। ৫. পাখিদের বিচরণক্ষেত্র হাওর-বাঁওড়সহ অন্যান্য জলাশয়ে অতিরিক্ত মাছ শিকার। ৬. চরাঞ্চলে জেলেদের উৎপাতের ফলে মৎস্যভুক পাখিরা বিপাকে পড়ছে। ৭. বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচারের ফলে আশঙ্কাজনক হারে এদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। এ ছাড়াও দেশের সর্বত্রই হাট-বাজারে বিভিন্ন ধরনের পশু-পাখির মাংস প্রকাশ্যে বিক্রি করছে কবিরাজ নামক এক ধরনের অপচিকিৎসকরা। তারা ধনেশ পাখি, বনরুই কিংবা শিয়ালের মাংস সামনে রেখে বাত-ব্যথা ও শক্তিবর্ধক ওষুধ বলে চালিয়ে দিচ্ছে। কয়েক বছর আগে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ‘টুট্টেং’ শিকার এই ধারাবাহিকতার ফল।
এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বন্যপ্রাণীর বেশ কিছু প্রজাতি আজ এ দেশ থেকে হারিয়ে গেছে। কিছু প্রজাতি রয়েছে বিপন্নের পথে। আবার কিছু প্রজাতি রয়েছে মহাবিপন্নের পথেও। যেমন হারিয়েছে, ফ্লোরিকান ময়ূর, পিংক মাথা হাঁস ও রাজ শকুন। আর হারিয়ে যেতে বসেছে বাদিহাঁস, বালিহাঁস, দিগহাঁস, কালো তিতির, চন্দনা, বাংলা শকুনসহ ইত্যাদি প্রজাতির পাখি। এ ছাড়াও আরও ১৯ প্রজাতির পাখি মহাবিপন্নের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। উল্লেখ্য, যে কোন ধরনের প্রাণীর প্রজাতি যদি প্রকৃতি থেকে বছর দশেকের মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগ বা তারও অধিক বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সাধারণত সে প্রজাতি মহাবিপন্নের তালিকায় স্থান পায়।
প্রাণীদের মধ্যে মহাবিপন্নের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ‘লজ্জাবতী বানর’। আমাদের দেশে বেশ কিছু প্রজাতির প্রাণী আজ মহাবিপন্নের তালিকার রয়েছে। তার মধ্যে লজ্জাবতী বানর অন্যতম। প্রাণীবিজ্ঞানীদের আশঙ্কা এটি দ্রæত হারিয়ে যাবে এ দেশ থেকে। যার ফলে লজ্জাবতী বানর ‘রেড সিগন্যাল’-এর আওতায় রয়েছে। এর অন্যতম কারণ অবাধে বনভূমি উজাড়। আগেও বলেছি, লজ্জাবতী বানরের বাসযোগ্য স্থান হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও লাউয়াছড়ার গভীর জঙ্গলে। উঁচু গাছের মগডালে থাকতে এরা পছন্দ করে। জন-মানবের পদচিহ্ন নেই যেখানে, সেখানেই ওদের বাস। অন্য কারণটি হচ্ছে এদের প্রজননহারও সন্তোষজনক নয়। বছরে মাত্র একটি বাচ্চা প্রসব করে মাদী বানরটি। আবার গড় আয়ুও সন্তোষজনক নয়। মাত্র ১০-১২ বছর বাঁচে, তাও যদি অনুকূল পরিবেশ পেয়ে থাকে।
বন্যজন্তুদের করুণ পরিণতির কথা ব্যক্ত করলে আফসোস করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। কারণে অকারণে বলির পাঁঠা হচ্ছে জন্তু-জানোয়ারগুলো। বাঘেরবাচ্ছা মনে করে কত মেছো বিড়ালকে যে লোকজন পিটিয়ে মেরেছে তার কোন সঠিক হিসেব নেই। হিসেব নেই গুইসাপের করুণ মৃত্যুরও। শুধুমাত্র ওদের চামড়ার লোভে কতিপয় দুষ্কৃতকারীরা জ্যান্ত গুইসাপের চামড়া তুলে নিতো এক সময়। পরক্ষণে গুইসাপটি মারা গেলেও বড়ই করুণভাবে প্রাণ হারাত। অজগর সাপের ক্ষেত্রেও তদ্রুপ।
এভাবে অনেক বন্যপ্রাণী এ দেশ থেকে হারিয়ে গেছে। তার মধ্যে সম্বর হরিণ, হগ হরিণ ও প্যার্যাইল্ল্যাবানর উল্লেখযোগ্য। হনুমানের অবস্থা আরও করুণ। লাউয়াছড়া, যশোরের কেশবপুরে কোন রকম বেঁচে আছে। হাতির অবস্থাও তেমন ভালো নয়। খাদ্যের অভাবে ওরা মিয়ানমার ও ভারতে পাড়ি জমাচ্ছে। আর যে প্রাণীটি এখন বাংলাদেশে নজরেই পড়ছে না, সেটি হচ্ছে নীলগাই; অথচ গত চার দশক আগেও প্রাণীটি উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে চষে বেড়াত। দুষ্কৃতকারীদের নিষ্ঠুরতার বলি হয়ে ওরা এখন আর আমাদের ধারে কাছেও ঘেঁষছে না। শুধু নীলগাই-ই নয়, দেখা যেত পদ্মার উচ্চ অব্বাহিকায় ঘড়িয়াল। নেই ওই প্রজাতির কেউ-ই এখন আর! ভবিষ্যতে আর দেখাও যাবেনা। বিষয়টা ভাবতে কেমন লাগছে? কেমন লাগছে পরিবেশটা ভারসাম্য হারিয়ে পঙ্গু হতে দেখে? এ নিধন বন্ধ না হলে অদূর ভবিষ্যতে বন্যপ্রাণীদের দেখতে চিড়িয়াখানায় যেতে হবে আগামী প্রজন্মকে। তাই আমাদের উচিত প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে বন্যপ্রাণীদের ওপর যেন নির্যাতন না ঘটে তার প্রতি সজাগ দৃষ্টি দেয়া। কাজটি কিন্তু ইচ্ছে করলেই করতে পারি আমরা। শুধু প্রচার-প্রচারণা বাড়িয়ে দিলেই যথেষ্ট। পাশাপাশি আইনের প্রয়োগ ঘটাতে হবে, যাতে কেউ বন্যপ্রাণী নিধন করে পার পেয়ে যেতে না পারে। তবে সার্থক হবে বন্যপ্রাণী নিধন আইন পাস।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও বন্যপ্রাণী বিষয়ক লেখক।