ফেসবুকে অনিরাপদ সম্পর্ক, বেড়েছে প্রতারণা ও ধর্ষণের সংখ্যা
বিশ্বজুড়ে এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জয়জয়কার। অনেকেই এই সামাজিক মাধ্যমে খুঁজে পেয়েছেন জীবনসঙ্গী, কেউবা হয়েছেন প্রতারণার শিকার। আবার বিভিন্ন অপরাধেরও অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে এটি। এসব অপরাধে যুক্ত হইয়েছে বিভিন্ন দেশের অনেক চক্র। সাইবার দুর্বৃত্তদের বড় একটি প্রতারণার ফাঁদ ফেসবুকে। সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে ঘনিষ্ঠ ও পরিচিতজনের ছদ্মবেশে ফেসবুক মেসেঞ্জারে টাকা চাওয়ার হার বেড়ে গেছে অকল্পনীয় ভাবে। ফেসবুকের এই স্ক্যাম, ব্যবহারকারীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। অনেকেই পড়ছেন নানান জটিলতা ও প্রতারণার ফাঁদে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক। অনেকেই ফেসবুকে দীর্ঘ সময় কাটান। ফেসবুককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অনেক প্রতারক চক্র। নানা কৌশলে ফেসবুক ব্যবহারকারীকে বোকা বানিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এসব সাইবার দুর্বৃত্তরা।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফেসবুক স্ক্যাম বা প্রতারণা বেড়ে গেছে। ফেসবুক প্ল্যাটফর্মের পাশাপাশি মেসেঞ্জার ব্যবহার করেও প্রতারণা করে দুর্বৃত্তরা। অনেক ক্ষেত্রে অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে ফেসবুক ব্যবহারকারী বন্ধুর ছদ্মবেশে অর্থ ও চাওয়া হচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ফেসবুক থেকে ছবি ও তথ্য নিয়ে ভুয়া প্রোফাইল তৈরি করে আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুর সঙ্গে প্রতারণা করছে। অনেক সময় বিশ্বস্ত বন্ধুর ছদ্মবেশে আসায় এ ধরনের প্রতারণা সহজে ধরা যায় না।
বিশেষজ্ঞরা বলছে, দেশে স্মার্টফোন সহজলভ্য হওয়ার পর থেকেই ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে ফেসবুক। এ অ্যাপটি ব্যবহারে সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ঘটিয়েছে বিপ্লব। গোটা বিশ্বকে নিয়ে এসেছে হাতের মুঠোয়। ইতিবাচক উদ্দেশ্যে ফেসবুকের যাত্রা শুরু হলেও এটির অপব্যবহারও হচ্ছে হরহামেশা। বেশ কিছু অসাধু ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে বেছে নিয়েছে এ মাধ্যমটি। আর এ কারণে প্রতারিত হওয়ার সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।
চলতি মাসের ২ ডিসেম্বর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের দমতলির শুভাট্টা এলাকায় বাকপ্রতিবন্ধী লতা সরকারকে ধর্ষণের পর পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত সুজনকে পটুয়াখালী থেকে গ্রেপ্তারের পর ঢাকা জেলা পুলিশ জানায়, ফেসবুক ও ইমোতে প্রেমের ফাঁদে ফেলে তাকে ধর্ষণ করা হয়। এই ঘটনা ফাঁস হওয়ার ভয়ে আসামিরা লতাকে পুড়িয়ে হত্যা করে।
বিয়ে না করলে ফাঁস করে দেওয়া হবে শারীরিক সম্পর্কের কথা। এ কথায় ভয় পেয়ে আসামি সুজন ভুক্তভোগী লতাকে ডেকে আনেন নির্জন জায়গায়। প্রথমে মারধর করা হয়, পরে অচেতন হয়ে গেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় লতার শরীরে।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, লতার সঙ্গে ফেসুবকে সুজনের আট-দশ দিনের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তাদের মধ্যে শরীরিক সম্পর্কও চলমান ছিল। বিয়ের জন্য সুজনকে চাপ দিতে থাকেন লতা। অন্যথায় শারীরিক সম্পর্কের কথা ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দেন তিনি। ফলশ্রুতিতে খুন হন লতা।
ফেসবুকে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে প্রেম হয় ঢাকার একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের এক নারী সংবাদ কর্মীর। ওই ব্যবসায়ী তাকে বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে নিয়ে অন্তরঙ্গ হন। এমনকি তারা দুজনে একসঙ্গে দেশের বাইরেও ঘুরতে যান। কিন্তু পরবর্তীতে সাইবার ক্রাইম ইউনিটে একটি অভিযোগ দায়ের করেন সেই নারী সংবাদকর্মী। তার দাবি, বিয়ের ছলে সব কিছু হারিয়ে প্রতারিত হয়েছেন তিনি। ওই ব্যবসায়ীর তাকে বিয়ে করার কথা ছিল, কিন্তু তাদের বিয়ে হয়নি।
ফেসবুকে বন্ধুত্ব এরপর ঘনিষ্ঠতা। এক পর্যায়ে সাক্ষাতের প্রবল আগ্রহে মেয়েটি চলে যায় চট্রগ্রামের মো, নাছির (৫৫) নামের এক ব্যক্তির কাছে। স্কুল পড়ুয়া কিশোরী প্রায় ছয়মাসের ও বেশি তার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছে। নাছির ওই শিক্ষার্থীকে প্রেমের ছলে দেড় মাস আটকে রেখে চালান ধর্ষণ ও পাশবিক নির্যাতন। পরে কৌশলে পরিবারের সহায়তায় কিশোরীকে উদ্ধার এবং নাছিরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
একই রকম ঘটনা ঘটে রাজবাড়ী জেলায়। স্কুল পড়ুয়া এক ছাত্রীর সঙ্গে বাবু হোসেন ওরফে সৈকত নামের এক ফেসবুক আইডির সঙ্গে পরিচয় ঘটে। ওই পরিচয়ের সুত্র ধরে সে মোবাইল ফোনে কথাবার্তা বলা শুরু করে। গভীর প্রেমের এক পর্যায়ে দেখা করতে গিয়ে ঘটে বিপত্তি। মেয়েটিকে এক বাসায় নিয়ে আটকে রেখে কয়েকদিন তাকে ধর্ষণ করে সৈকত। এক পর্যায়ে কৌশলে মেয়েটি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে পুলিশের সহায়তায় তাকে উদ্ধার হয়। পরে সৈকতকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ফেইসবুকের মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছে তরুণীরা। ফেইসবুকের মাধ্যমে যৌন নির্যাতনের ঘটনা আশংকাজনকভাবে বেড়েছে। প্রথমে ফেসবুকে অপরিচিত একাউন্ট থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে। একসেপ্ট করলে পরিচয় হয়। তারপর চলতে থাকে চ্যাট, অনলাইন আড্ডা। আস্তে আস্তে ঘনিষ্ঠ হয়ে দেখা করার প্রস্তাব আসে। দেখা করতে যাওয়া মানেই প্রতারক চক্রের ফাঁদে পা দেয়া। এভাবে অনেক তরুণীকে অপহরণের ফাঁদ পাতে প্রতারক চক্র। তারপর আটকে রেখে ধর্ষণ, নিপীড়ন-নির্যাতন, সর্বস্ব বিলীন করে এক সময় পতিতালয়ে বিক্রির মত ঘটনাও ঘটছে।
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুত্ব বা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে নারীদের যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার বানাচ্ছে এক শ্রেণির মানুষ। এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই আসছে সংবাদমাধ্যমে। এভাবে ঘরে-বাইরে প্রতিনিয়ত নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছে নারী।
নারীর প্রতি নির্যাতন, সহিংসতা ও ধর্ষণ ঠেকাতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন করেছে সরকার। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সভা-সিম্পোজিয়ামসহ নানাবিধ আয়োজন, কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। তবুও থামছে না নারীর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতা। অপরাধীর দ্রুত বিচার নিশ্চিত করলে এসব অপরাধ কমবে বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মীরা।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, সারাদেশে ধর্ষণ ও দলবেঁধে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০১৮ সালে ৭৩২ জন, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ জন ও ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৭ জন, ২০২১ সালে ১ হাজার ৩২১ জন এবং ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ৫৪৬ জন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদের প্রকাশিত তথ্যমতে, ২০১৯ সালে দেশে এক হাজার ৩৭০ জন, ২০২০ সালে এক হাজার ৩৪৬ জন, ২০২১ সালে এক হাজার ২৩৫ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত কয়েক বছরের মধ্যে প্রায় প্রতি বছরই গড়ে ১ হাজার ৩ শতাধিক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলার প্রায় অর্ধেকই ধর্ষণের।
এদিকে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর তথ্যানুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে। এ বছরের জুলাই পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ১১ হাজার ৯৫৯টি ফোনকল এসেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ৬১৯টি, ধর্ষণচেষ্টা ৩১৪টি, যৌন নির্যাতন ২৬৮টি, ধর্ষণের হুমকি ৩১টি এবং উত্ত্যক্ত ও যৌন হয়রানির ১ হাজার ৯টি। একই অভিযোগে গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে ১২ হাজার ১৬৯টি, ২০২০ সালে ৬ হাজার ৩৩১টি, ২০১৯ সালে ৩ হাজার ১১৫টি এবং ২০১৮ সালে ২ হাজার ২৯২টি ফোনকল আসে।
মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা হিউম্যান রাইটস ভয়েস অ্যান্ড হিউম্যানিটির সভাপতি আব্দুল আওয়াল নয়ন খান বলেন, দেশজুড়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের ফলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন করা হলেও নারী নির্যাতন বা ধর্ষণ কমছে না। এজন্য অপরাধীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান না দেখে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করা প্রয়োজন।
সমাজে নারী-শিশু নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. সানজীদা আখতার বলছেন, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানসিকতা থেকেই ক্ষমতা প্রয়োগের একটা কুৎসিত রূপ নারী নির্যাতন বা ধর্ষণ। পর্যায়ক্রমে ওই জায়গাগুলোতে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। একই সঙ্গে নারী নির্যাতন, সহিংসতা বা ধর্ষণের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোরও একটা বিরাট প্রভাব।
পুলিশ বলছে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ব্ল্যাকমেইলিং, চাঁদাবাজি, অর্থ আত্মসাৎ, প্রশ্নফাঁস থেকে শুরু করে যৌন হয়রানির মত ঘটনা ঘটছে।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে এ ধরনের ঘটছে। এখানে নিজেদের সাবধানতার বিকল্প কিছু নেই। ফেসবুকে যারা প্রতারণা করে তারা নানা কৌশল ব্যবহার করে। এতে অনেকেই আকৃষ্ট হতে পারে। কিন্তু যাছাই বাছাই করা প্রয়োজন। আবেগের বশবর্তী হয়ে কোন কিছু করতে গেলেই বিপদে পড়তে হয় এটা মনে রাখতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সাইবার ক্রাইম দল ইতোমধ্যে নানা ধরনের প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে। কোন বিষয়ে সন্দেহ হলেই নিকটস্থ থানা বা পুলিশের বিভিন্ন হটলাইন নম্বর রয়েছে সেখানে কল করে সহযোগিতা পেতে পারে। আমরা সবাই একটু সচেতন হলেই এ ধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে পারি।
জানতে চাইলে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, নারী, পুরুষ উভয়ই এসব অপরাধের শিকার হচ্ছেন। অনেকে আবার অনলাইনের মাধ্যেমে প্রতারিত হচ্ছেন। ফেসবুকে বা কোনো গণমাধ্যমে কাউকে নিয়ে মানহানিকর বা কারও বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিমূলক ছবি বা ভিডিও পোস্ট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অতিরিক্ত লোভ এবং অপরিচিত কারেও সঙ্গে অন্তরঙ্গ ছবি বা ভিডিও আদান প্রদান থেকে বিরত থাকলে এসব অপরাধ অনেকটা কমে আসবে। তবে এসব বিষয়ে কিছু না বুঝলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে বা একজন আইনজীবীকে বিষয়টি অবগত করে রাখলে ভালো পরামর্শ পাওয়া যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কামিশনার (এডিসি) নাজমুল বলেন, কেউ সাইবার অপরাধের শিকার হলে পুলিশের সাহায্য নিতে পারেন। তাতে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তিনি বলেন, তাছাড়া সবাইকে এই বিষয়ে সর্তক থোকতে হবে এবং অপরিচিতদের সঙ্গে ফেসবুক বা অন্যন্য মাধ্যমে কোনো কিছু শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
সাইবার অপরাধ বাড়ছে এমনটা জানিয়ে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার এসপি মুক্তা ধর বলেন, এসব অপরাধের বেশিরভাগই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়ে থাকে তবে প্রতারকরা বেশিরভাগ নারীদের টার্গেট করে। বিশেষ করে নারীদের এসব বিষয়ে অতিরিক্তক সর্তক থাকতে হবে। নারী পুরুষ সবাই যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সতর্ক হয় তাহলে এসব অপরাধ অনেকটা কমে আসবে।
কেএম/এএস