যে কারণে মাদক নিয়ন্ত্রণ অভিযান ব্যর্থ
বিশ্বে মাদক দ্রব্যের এবং চোরাচালানের উপর নানাবিধ আইন জারি করা হলেও, আদতে এর কোনোটাই এখনো নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি৷ এমনই এক তথ্য পাওয়া গেছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, পুরোপুরি মাদক নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা তাদের নেই। অন্যদিকে, এ বিষয় নিয়ে সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, দেশ থেকে পুরোপুরি মাদক নিয়ন্ত্রণে আমরা সফল হতে পারিনি। সুশীল সমাজ বলছে, অনেক দেশ মাদক নিয়ন্ত্রণে সফল হয়, আমরা কেন সফল হচ্ছি না?
গোয়েন্দা তথ্য বলছে, সারা দেশে অবাধে বেচাকেনা হচ্ছে মাদক। এটা এখন অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’ তবে মোবাইলে এসব মাদক বিক্রি হচ্ছে বেশি। মাদককারবারিরা এখন প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছে।
মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ২০১৮ সালের ৪ মে একযোগে দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। সেই অভিযানে র্যাব, পুলিশ ও কোস্ট গার্ডের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রায় ৪০০ মাদক কারবারি নিহত হন। গ্রেপ্তার হন দুই লক্ষাধিক মাদক। কিন্তু তারপরও বন্ধ করা যায়নি মাদক ব্যবসা। তথ্য বলছে, অনেক মাদক কারবারি জেল থেকে বের হয়ে আবারও নতুন করে মাদকের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, সবাই সতর্ক না হলে পুরোপুরিভাবে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। মাদক নির্মূূূল হোক এবং সে লক্ষ্যে আমাদের বিশেষ বিশেষ অভিযান চলমান রয়েছে। তা ছাড়া, বিভিন্ন শহরে মাদকবিরোধী অভিযানের কিছুটা সফলতা আসছে।
তথ্য বলছে, প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার মাদকদ্রব্য দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করা হচ্ছে। সীমান্ত দিয়ে বেশির ভাগ ফেনসিডিল, মরফিন, ইডিগ্রা, হেরোইন, ম্যাগডন, সিগনেসার, রয়েলস্টার, এপ্রিয়র ব্লু, বিআরসহ বিভিন্ন নামের মাদকদ্রব্য প্রবশে করছে। মাদক সহজলভ্য হওয়ায় যুবসমাজ সহজেই নেশায় আসক্ত হচ্ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, তারা শুধু ঢাকা বিভাগেই সাড়ে তিন হাজার সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ীর একটি তালিকা করেছে। কর্মকর্তারা বলছেন, যাদের চিহ্নিত করে এই তালিকা করা হয়েছে, তাদের অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছে, অনেকেই আবার পলাতক।
এদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, মাদক ব্যবসায় গডফাদার এবং প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না মূলত সে কারণে অভিযানে কোন ফল পাওয়া যাচ্ছে না। দেখা গেছে তারা সমাজের উচুস্থানে বসবাস করে এজন্য হয়তো সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর অভিযানে তেমনটা সফলতা আসছে না।
অভিযোগ আছে, কোথাও কোথাও প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও নানাভাবে মাদকের সঙ্গে জড়িত আছেন। এসব কারণে মাদকের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো অভিযান দেখা যায় না।
অবশ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারা সমাজের কেউকেটা হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে তেমন কিছু করা যায় না।
একাধিক গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে ইয়াবাসেবনকারীর সংখ্যা ৮০ লাখেরও বেশি। সম্প্রতি প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা সাময়িকীর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মাদকাসক্তদের ৫৮ শতাংশেরও বেশি ইয়াবাসেবী।
জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে কাজ করছি। তবে মাদক নিয়ন্ত্রণে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মনুষদের এগিয়ে আসতে হবে। মাদকের বিরুদ্ধে র্যাব সর্বপ্রথম যুদ্ধ ঘোষণা করে।
জানতে চাইলে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল মো. কামরুল বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে র্যাব কাজ করছে। নতুন নতুন কৌশলে আমরা এসব দমনের জন্য বিশেষ ভুমিকায় কাজ করছি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার কেএন রায় নিয়তি বলেন, আমাদের দেশে তো মাদক তৈরি হয় না। মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের নিয়মিত অভিযান চলমান রয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহভাবে পাওয়া যায় ইয়াবা। যা মিয়ানমার থেকেই আসছে।
তিনি বলেন, এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। এর সঙ্গে কারা জড়িত, আশ্রয় বা প্রশ্রয়দাতা কারা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আশ্রয় বা প্রশ্রয়দাতা কারা সেটা নিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কাজ করে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক সহকারী মহাপরিদর্শক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুলিশ সব সময় ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক নির্মূলে কাজ করছে। তবে পুরোপুরিভাবে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি যারা মাদকের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয় তারা অধিকাংশ সময় তাদের গডফাদারদের নাম প্রকাশ করে না। যার করণে মাদকের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারা আড়ালে থেকে যায়।
আপনারা মাদক ব্যবসায়ীদের একটি লিস্ট করেছেন সেটার প্রথমিক তদন্তে কী পেয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্ত শেষে আমরা একটি ফাইনাল লিস্ট সংশ্লিষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে এবং দুদকে পাঠিয়েছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মোহাম্মদ শফিউল্লাহ বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর আমাদের কাছে যে লিস্ট দিয়েছে সেটা আপাতত আমরা প্রকাশ করতে পারছি না। খতিয়ে দেখতে হবে এখানে মাদকের সঙ্গে যুক্ত আছেন কারা।
কেএম/এমএমএ/