হিযবুত তাহরীরের অর্থের জোগান বিদেশ থেকে
নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীর অর্থের জোগান আসছে দেশের বাইরে থেকে। দেশের বাইরে পলাতক থাকা দেড়শ জঙ্গি এ অর্থ পাঠাচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে। আর এ অর্থে সংগঠনটি আবারো সক্রিয় হচ্ছে। তার প্রমাণও পাওয়া যায় তাদের নানামুখী তৎপরতায়। বিশেষ করে কিছুদিন পর পরই হিযবুত তাহরীর রাজধানীতে দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগিয়ে নিজেদের উপস্থিতির জানান দেয়। সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পোস্টার সাঁটিয়েছে সংগঠনটি।
গত ২০ নভেম্বর ঢাকার আদালত থেকে দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা অনুসন্ধান করতে গিয়ে এমন তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে— জঙ্গিদের টাকা কোথা থেকে আসছে, কীভাবে তারা সক্রিয় হচ্ছে? দেশের কোন কোন অঞ্চলে জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের কমিটি ও কার্যালয় রয়েছে। এ সব বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। এর বাইরে আত্মগোপনে থাকা জঙ্গিদের সন্ধানে কাজ করছেন তারা।
অবশ্য নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন— জঙ্গিদের অর্থের যোগানদাতাদের খুঁজে বের করতে পারলে জঙ্গি দমনের কাজ অনেকটা সহজ হবে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, হিযবুত তাহরীরকে চাঙ্গা করতে দেশের বাইরে থেকে পলাতক অন্তত দেড়শো জঙ্গি অর্থ পাঠাচ্ছে। এই অর্থে নিজেদের সংগঠিত করা, সদস্য সংগ্রহ করাসহ দেশবিরোধী নানা তৎপরতায় লিপ্ত হচ্ছে সংগঠনটি। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, পলাতক জঙ্গি ছাড়াও অর্থ-সহায়তাকারীদের মধ্যে লন্ডন, পাকিস্তান, হংকং ও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক রয়েছেন।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে কোন কোন অঞ্চলে হিযবুত তাহরীরের কমিটি ও কার্যালয় আছে তার সন্ধান পাওয়া গেছে। বিভাগীয় অঞ্চলগুলোতে একাধিক কমিটি কাজ করছে। এ সব কমিটির মাধ্যমে তারা দাওয়াতি কার্যক্রম চালায়। সংগঠনটির মহিলা ইউনিটও রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের দলে ভেড়ানোর জন্য তাদের ‘দাওয়াতি টিম’ মাঠে কাজ করছে। তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে তারা মোবাইল ফোনের অ্যাপস ব্যবহার করে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, আল কায়দার আদর্শে অনুপ্রাণিত হিযবুত তাহরীর ৯৫টি দেশে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আমেরিকায় শক্তিশালী কমিটি রয়েছে। ভারতবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও ওই দেশে হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম আছে। মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, পাকিস্তান, সুদান, লিবিয়া, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, তুরস্কসহ অন্যান্য দেশে হিযবুত তাহরীর সক্রিয়। তবে জঙ্গি কার্যকলাপের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ান ফেডারেশন, পাকিস্তান, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, কাতার, সুদান, ওমান, জর্ডান, সিরিয়া, ইরাক, মিসর, লিবিয়া, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, আজারবাইজান, তুরস্ক ও তিউনিসিয়াসহ ২৩টি দেশের সরকার হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। তারপরও ওইসব দেশে তাদের প্রচারণামূলক কার্যক্রম আছে।
পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামান বলেছেন, নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীরের কর্মকাণ্ড এখনো আছে। তবে তারা অনেকটাই দুর্বল। জঙ্গি সংগঠনগুলোর ওপর নজরদারি আছে। প্রায়ই জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ জামিন নিয়ে আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছে না। আবার অনেকে ঠিকানা বদল করেছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। আত্মগোপনে থাকা জঙ্গিদের সন্ধান করা হচ্ছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হিযবুত তাহরীরের সদস্য আছে ১০ হাজারের বেশি। এদের অনেকেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাদের মধ্যে তালিকাভুক্ত এক হাজার ১৭২ জঙ্গির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের সন্ধান করতে সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বিশেষ নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে পুলিশের সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোতে। বার্তায় বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে ১৪৭ জন দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে। তারা বিদেশে বসেই টাকা পাঠাচ্ছে।
ডিএমপির সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, বিশেষ বার্তা পেয়ে পুলিশ ও র্যাব পলাতক জঙ্গিদের ধরতে কাজ শুরু করেছে। নিষিদ্ধ অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর চেয়ে হিযবুত তাহরীর বেশি ভয়ংকর। তারা শিক্ষিত জঙ্গি। দেশের বাইরে যারা পালিয়ে আছে তাদের ধরতে ইন্টারপোলে বার্তা দেওয়া হয়েছে। আমরাও চেষ্টা করছি।
এদিকে কিছুদিন আগে হিযবুত তাহরীর সারা দেশে পোস্টারিং করেছে। পোস্টারে লেখা হয়েছে, ‘জনগণকে দুর্দশায় নিমজ্জিত রেখে আওয়ামী-বিএনপি নেতাদের রাজনৈতিক খেলা নিশ্চিত প্রতারণা।
তারা পোস্টারে মাধ্যমে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়ার পাশাপাশি সরকার বিরোধী বিভিন্ন বার্তাও দিচ্ছে। যাতে তারা বলছে, ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি, ব্যাপক বেকারত্ব, তীব্র জ্বালানি সংকট এবং ভঙ্গুর অর্থনীতির কারণে জনজীবন দুর্দশায় নিমজ্জিত। জনগণের দুর্দশার কারণ হচ্ছে আওয়ামী-বিএনপির শাসকগোষ্ঠীর দশকের পর দশকের দুর্নীতি এবং তাদের পশ্চিমা প্রভুদের পুঁজিবাদী নীতির বাস্তবায়ন করছে। এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য, পশ্চিমাদের হাতিয়ার আইএফএম-বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশন অনুসরণ করে পৃথিবীর বহু দেশের অর্থনীতি পরনির্ভরশীল ও ধ্বংস হয়ে গেছে। অথচ শেখ হাসিনা সরকার দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে তার অনিবার্য পতন ঠেকাতে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছে। আর বিএনপি আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের হস্তক্ষেপের মাধ্যমেই বিশ্বাসযোগ্য রাজনৈতিক সমাঝোতা আশা করে। আওয়ামী-বিএনপির রাজনৈতিক খেলায় যে-ই জিতুক, শাসকগোষ্ঠীর দুর্নীতি কিংবা দেশের অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী নীতির বাস্তবায়ন বন্ধ হবে না। এ খেলায় জনগণই হচ্ছে পরাজিত পক্ষ।’
উত্তরা, মিরপুর, কল্যাণপুর, মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট, ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন এলাকার প্রধান সড়কে ও অলিগলিতে দেয়ালে দেয়ালে হিযবুত তাহরীরের এ ধরনের পোস্টার দেখা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড থামছেই না। আচমকা হামলা চালাচ্ছে তারা। প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছে। সর্বশেষ ঢাকার আদালতপাড়ায় পুলিশের ওপর চড়াও হয়ে ছিনিয়ে নিয়েছে দুই দুর্র্ধষ জঙ্গিকে।
পুলিশ বলছ, জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীর লাইমলাইটে আসার চেষ্টা করছে। কিছুদিন আগে নিষিদ্ধ সংগঠনটি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিরুদ্ধে সারা দেশে পোস্টারিং করেছে। এর সদস্যরা গোপনে বৈঠক করছে। তারা অনলাইনে মিটিং করে নির্দেশনা দিচ্ছে।
জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ করে সরকার। তারপরও তাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড থেমে নেই। গোপনে তারা অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। অভিযোগ উঠেছে, নব্য জেএমবি নামে কলকাঠি নাড়ছে হিযবুত তাহরীরই।
সংগঠনটির মূল কমিটিতে কারা আছেন কেউ জানে না। তাদের কেউ চেনেও না। ফলে মূল নেতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকছে। সরকার নিষিদ্ধ করলেও সংগঠনটির তৎপরতা থেমে নেই। নিয়মিত অনলাইনে সভা, সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক করছে।
পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা জানান, নিষিদ্ধ করার পর তাদের কর্মকাণ্ড আরও বেড়েছে। নানা কৌশল অবলম্বন করেও শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের নেতাদেরও গ্রেপ্তার করতে পারছে না আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। মাঝেমধ্যে পোস্টার সাঁটানো বা লিফলেট বিলি করার সময় পুলিশ বা র্যাবের হাতে ধরা পড়ছে কিছু মাঠকর্মী। সংগঠনের শীর্ষ নেতাসহ বড় নেতারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সক্রিয়। তারা গোপনে কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করে দিকনির্দেশনা দিচ্ছে। মেজর জিয়াও হিযবুত তাহরীরকে সহায়তা করছেন বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
এ বিষয়ে চাইলে জানতে চাইলে কাউন্টার টেরোরিজম ক্রাইম (সিটিটিসি) প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, হিযবুত তাহরীরের কর্মকাণ্ড মনিটরিং করা হচ্ছে। জামিনে হিযবুতের অনেক সদস্য মুক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকের হদিস মিলছে না, তা সত্য। তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তাদের শক্তিদাতাদের খুঁজে বের করার চেষ্টাও চলছে। হিযবুতসহ সবকটি জঙ্গি সংগঠনের কর্মকাণ্ড আমাদের নজরে আছে। রাতের আঁধারে তারা পোস্টারিং করছে। এ সব ঠেকাতে থানাগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেন, গোয়েন্দা পুলিশ ও সিটিটিসির বিশেষ অভিযানে জঙ্গিদের ধরতে আমাদের পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। ইতোমধ্যে জঙ্গিদের অর্থের যোগানদাতাদের খোঁজ পাওয়া গেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।
জঙ্গিদের বিষয় জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন, আমাদের কাছে তথ্য আছে একাত্তরের পরাজিত শক্তিগুলো জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত। জঙ্গিরা বাংলাদেশ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। তারা মাঝে মাঝে অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা করে। জনগণ ও পুলিশ বাহিনীর তৎপরতার কারণে তারা অপরাধ ঘটতে পারে না।
নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদীনের (জেএমবি) ১৪ শীর্ষ নেতা এখনো পলাতক। এরমধ্যেই আবার আদালত থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় নতুন করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।
জঙ্গিদের তৎপরতার বিষয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মো. আব্দুর রশীদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, জঙ্গিদের কার্যক্রম তদারকি করে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন ইউনিট। তাদের অর্থের যোগান কোথা থেকে আসে সেই গুলো চিহ্নিত করে কাজ করতে পারলে জঙ্গিদের অনেক কিছু জানা সম্ভব হবে। এবং জঙ্গি দমনে এবং নিয়ন্ত্রণে অনেকটা সহজ হবে।
এদিকে জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ততার অভিযোগে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির ডা. মো. শফিকুর রহমানকে গত ১০ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) বিভাগ। গত মঙ্গলবার (১৩ ডিসেম্বর) সিটিটিসি জানায়- এর আগে গত ৯ নভেম্বর তার ছেলে ডা. রাফাত চৌধুরীকে সিলেট থেকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসির বোম ডিসপোজাল ইউনিট। তাকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ বলছে- জঙ্গিরা হিজরতের মাধ্যমে নতুন নতুন কৌশলে কাজ করছে। আমাদের কাছে বিভিন্ন তথ্য আসছে সেইসব তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।
এনএইচবি/আরএ/