সমুদ্রপথে মানব পাচারের অধিকাংশ মামলা ঝুলে থাকে
মানব পাচারের রুট সমুদ্রপথে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে যাত্রা করেন বিদেশগামীরা। সবাই জানেন এ পথে রয়েছে মৃত্যুর হাতছানি। তারপরও অনেকেই জেনে বুঝে এই পথ দিয়ে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এ বিষয় নিয়ে কোস্ট গার্ড বলছে, মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপথে অনেক মানুষ বিদেশে যাচ্ছে। শুধু যে আমাদের দেশের মানুষ যাচ্ছে বিষয়টি এমন না, রোহিঙ্গারাও বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
অবশ্য এ সব বিষয় নিয়ে গোয়েন্দা তথ্য বলছে, মানব পাচারের বড় রুট হলো সমুদ্রপথ। এই পথেই ঘটে বেশি মৃত্যুর ঘটনা। তবে এ সব ঘটনায় অনেক মামলা হয়, যা বেশির ভাগ আদালতে ঝুলে থাকে।
গত মাসে বঙ্গোপসাগর দিয়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়াগামী ট্রলারডুবির ঘটনায় নারী পুরুষ ও শিশুসহ পাঁচ জনের মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় প্রায় ৫০ জনকে জীবিত উদ্ধার করে কোস্ট গার্ড। তাদের উদ্ধারের পর কোস্ট গার্ড জানায়, কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক শক্তিশালী মানবপাচারকারী চক্র গড়ে উঠেছে। চক্রটি রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
কোস্ট গার্ড বলছে, এ পথে পাচার হওয়া দুই ব্যক্তি জয়নাল ও রাবেয়া জানান, সমুদ্রপথে তাদের নোয়াখালীর অনেক মানুষ বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া, জার্মানসহ ইউরোপের দেশগুলোতে গেছেন এবং তারা বর্তমানে অনেক ভালো আছেন। তা ছাড়া টাকাও কম লাগে, এজন্য তারাও এই পথ বেছে নিয়েছেন।
সম্প্রতি র্যাব-৩ এর অভিযানে মানব পাচার চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব বলছে, বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে দালালের মাধ্যমে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যেতে ইচ্ছুক লোকজনকে টার্গেট করে তারা সমুদ্রপথে পাচার করে আসছে। র্যাব বলছে, বড় একটি চক্রের সদস্য মাহবুব উল হাসান ও মাহমুদ করিম। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়। তারা সমুদ্রপথে অনেক মানুষকে বিদেশে পাচার করার কথা স্বীকার করেছেন। দেশের বাইরে অবস্থানরত মানুষকে প্রতারণার কাজে ব্যবহার করতেন তারা। আসামিদের গ্রেপ্তারের পর আরও বেশ কয়েকটি চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
জানতে চাইলে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ২০২১ সালে মানব পাচারকারী সর্বমোট ৫৯ জনকে আমরা গ্রেপ্তার করি। ১২ জন ভিকটিমকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করেছি।
তিনি বলেন, মানব পাচার চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন অসহায় দরিদ্র লোকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দালালের মাধ্যমে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যেতে ইচ্ছুক লোকজনের কাছ থেকে আগে পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন। ভিকটিমদের প্রথমে বিমানের কথা বলে পরে সমুদ্রপথে পাচার করার চেষ্টা করেন। আমরা নিয়মিত এ সব অপরাধ দমন করতে বিভিন্ন অভিযান চলমান রেখেছি।
আইশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, সমুদ্রপথে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকেই মানব পাচারকারীদের হাতে পড়েন এবং বিভিন্ন নিযার্তনের শিকার হয়ে কোনোভাবে জীবন নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। আবার এ পথেই অনেকের মৃত্যু হয়।
এদিকে একটি গোয়েন্দা তথ্য বলছে, অবৈধভাবে সড়কপথে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার রুটটি মূলত ঢাকা থেকে শুরু। এরপর পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত হয়ে মিয়ানমারের মান্দালয়। সেখান থেকে থাইল্যান্ড সীমান্ত দিয়ে মালয়েশিয়ার রানং শহরে পৌঁছাতে হয়। এ যাত্রায় একদিকে যেমন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বাঁধা, অন্যদিকে আছে দেশগুলোর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা। তবে সড়কপথের এ রুটটির জন্য এখন সবচেয়ে ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মিয়ানমারের সংঘাতপূর্ণ অবস্থা। তাই এ সব বিষয় বিবেচনায় মানব পাচারকারীদের কাছে গত কয়েক বছর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাত্রা।
গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে ২০১৮ সাল থেকে চলতি বছর-২০২২ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি মানব পাচার মামলা দেশের বিভিন্ন আদালতে ঝুলে আছে। ওই তথ্যটি বলছে, তবে অনেক মামলার সাক্ষীও নেই। যে কারণে বছরের পর বছর ঝুলে রয়েছে এ সব মামলা।
এদিকে পুলিশের আরেকটি তথ্য বলছে, ২০১২ সাল থেকে ২০১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা জেলার বিভিন্ন থানায় মানব পাচার আইনে মামলা হয়েছে ৪২২টি। এ সব মামলায় আসামি করা হয়েছে দুই হাজার ৮৯ জনকে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭৫০ জনকে। পাচারের সময় উদ্ধার করা হয়েছে তিন হাজার ২২৩ জন নারী, পুরুষ ও শিশুকে। ওই তথ্যটি বলছে, ২০১৮ সালের পর মানব পাচার মামলার সংখ্যা বেড়েছে তবে সুনির্দিষ্ট জরিপ পাওয়া যায়নি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি তথ্য বলছে, ২০২১ থেকে চলতি বছর-২০২২ পর্যন্ত লিবিয়া ও তিউনিসিয়ায় প্রায় দুই হাজারেরও বেশি মানুষ সমুদ্রেপথে পাচার হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই সর্বস্ব হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনস্যুলার ও কল্যাণ অনুবিভাগের মহাপরিচালক সোহেলী সাবরিন বলেন, গত সেপ্টেম্বর থেকে এক হাজারেরও বেশি নাগরিককে দেশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। এর মধ্যে বেশ কিছু নারী রয়েছে, তা ছাড়া ফেরত আসা ব্যক্তিদের আমরা আটক করে কয়েক দিনের কাউন্সিলিং করে তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছি।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত ৬ মাসে ভারতে পাচার হওয়া প্রায় ৩০০ জন নারী ও শিশুকে উদ্ধারের পর সরকারিভাবে বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ফেরত দিয়েছে ভারতীয় পুলিশ। এ ছাড়াও সীমান্তপথে বিভিন্ন সময় বিজিবির হাতে উদ্ধার হয়েছে পাচারের শিকার নারী-পুরুষ।
ভুক্তভোগীরা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করলে তাদের জীবননাশের হুমকির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে তারা ঘৃণ্য এ ব্যবসা সচল রেখেছে। তবে পুলিশের দাবি, সীমান্তপথে পাচার প্রতিরোধে তারা বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি আন্তরিক হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বৈধ পথে পাচারের কোনো সুযোগ নেই।
পাচারবিরোধী সংস্থাগুলোর দাবি মানবপাচারকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলেই এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব। তাদের সঙ্গে কথা হলে বেরিয়ে এসেছে পাচারের চাঞ্চল্যকর তথ্য।
বিভিন্ন এনজিও সংস্থার সূত্রে জানা যায়, গোটা দেশজুড়েই পাচারকারীদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। তাদের মূল টার্গেট দরিদ্র কিশোরী, তরুণী, স্বামী পরিত্যাক্তা নারী এবং শিশু।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মানব পাচার রোধে আমাদের বিভিন্ন অভিযান চলমান রয়েছে। এই অপরাধ দমন করতে র্যাবের সব ব্যাটালিয়ন একত্রিত হয়ে কাজ করছে।
তিনি আরও বলেন, সীমান্তের দায়িত্বে থাকা- কোস্ট গার্ড- বিজিবি ও পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে আমরা মানব পাচার রোধে বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান রেখেছি।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি মিডিয়া) মো. মনজুর রহমান বলেন, মানব পাচার প্রতিরোধে সর্বাত্মকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। তবে এ সব বিষয়ে সবাইকে সর্তক হতে হবে। মানুষ যদি তার জীবনের মূল্য বোঝে এবং এ পথে তার যে কোনো সময় মৃত্যু হতে পারে এটা বোঝে তাহলে অনেকটা সে সর্তক থাকবে। পরিবারের কথা ও মৃত্যু ঝুঁকি চিন্তা করলে এ সব পথে বিদেশ যাওয়া মানুষরা বুঝতে পারবে যে এটা তাদের ভুল পথ। তবে এ সব প্রতিরোধে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। পরিবার ও সবাই সচেতন হলে এ সব ঘটনা কমে আসবে এবং সুমদ্রপথে মৃত্যুর হারও কমে আসবে।
এদিকে মানব পাচার ও অনুপ্রবেশকারী ঠেকাতে সমুদ্রপথে ও সীমান্তে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের টহল এবং নজরদারি বৃদ্ধি করেছে এমনটা জানিয়ে কোস্ট গার্ড সদর দপ্তরের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার খন্দকার মুনিফ তকি বলেন, নাফ নদী থেকে বঙ্গোপসাগরে ঢুকে ছেঁড়া দ্বীপ হয়ে পাচারের চেষ্টা করা হয় সাধারণ মানুষকে। অনেকে ভালো থাকার জন্য এই পথ বেছে নিচ্ছেন। শুধু বাংলাদেশের নাগরিক নয় রোহিঙ্গারাও এই পথ দিয়ে দেশের বাইরে যাওয়া চেষ্টা করছেন।
তিনি বলেন, মানব পাচার রোধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে। সে অনুযায়ী নিয়মিত মানব পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি শীতকেন্দ্রিক সমুদ্রপথের অবৈধ যাত্রা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রস্তুতি রয়েছে।
জানতে চাইলে নিম্ন আদালতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জান্নাতুল সুলতানা বলেন, মানব পাচারের অধিকাংশ মামলা ঝুলে থাকার কারণ হলো মামলার সাক্ষী এবং আলামত যথাযথভাবে না পাওয়া। দেখা গেছে, অনেক সময় সাক্ষীরা আসেন না। প্রমাণ না থাকায় বিচারকরা এ সব মামলার রায় দিতে পারে না। যার কারণে এ সব মামলা ঝুলে থাকে।
কেএম/আরএ/