ব্যয়বহুল ৩ স্টেশনে ট্রেন থামবে কবে?
কুমিল্লার ময়নামতি রেলওয়ে স্টেশন। একেবারে ঝকঝকে-চকচকে। আকাশি রংয়ের দেওয়াল। এসএস পাইপের চমৎকার রেলিং। রয়েছে প্ল্যাটফর্ম জুড়ে যাত্রীদের বসার জন্য বেঞ্চ। এক প্ল্যাটফর্ম থেকে আরেক প্ল্যাটফর্মে যাওয়ার জন্য রয়েছে দৃষ্টিনন্দন ফুটওভার ব্রীজ। স্টেশনের যাতে গরু, ছাগল কিংবা বখাটেরা ঢুকতে না পারে সে জন্য রয়েছে লোহার শিকল দিয়ে টানা প্রাচীর। আর দুই প্ল্যাটফর্মের মাঝ দিয়ে চলে গেলে সমান্তরাল চারটি রেললাইন। কোথাও কোন দাগ নেই। নেই কোন জনমানব। দেখতে অনেকটা বিদেশের রেলওয়ে স্টেশনের মত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই স্টেশনে কোন ট্রেন থামে না। কোন যাত্রীও উঠানামা করে না।
শুধু ময়নামতি নয়। লালমাই এবং আলীশ্বর এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন বিলাসবহুল রেলওয়ে স্টেশন। তবে এর কোনোটিতেই থামে না ট্রেন, হয় না যাত্রী কিংবা মালামাল ওঠা-নামা। প্রায় ১০ বছর যাবত এসব স্টেশন বন্ধ রয়েছে। কবে চালু হবে তাও বলতে পারছেন না কেউ। তাই প্রশ্ন উঠেছে, যদি যাত্রী উঠা-নামাই না হয় তবে এতো এতো টাকা খরচ করে কেনো নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন এসব স্টেশন?
এসব স্টেশন এখন রীতিমত বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বিকেল হলেই দৃষ্টিনন্দন এসব স্টেশনে স্থানীয় লোকজনের সমাগম ঘটে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের আখাউড়া-লাকসাম সেকশনে মোট ১৩টি রেলওয়ে স্টেশন আধুনিকায়ন এবং ১৮৪ কিলোমিটার ডাবল লাইন রেললাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ছয় হাজার ৫০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে চারটি স্টেশনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। রসুলপুর এবং রাজাপুরে দুটি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। সবগুলোরই স্টেশনের নকশা ও আকৃতি একই ধরনের। দেশীয় প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স অটোমোবাইল প্রোডাক্টস লিমিটেড এসব স্টেশনের নির্মাণ কাজ করছে। এর মধ্যে তিনটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি আছে আরো দু’টি।
ম্যাক্স সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্টেশনগুলো নতুন করে তৈরি করা হয়নি। পুরনো স্টেশনগুলোকে সংস্কার করে নতুন রূপ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে তিনটি স্টেশনের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেছি। রেলকর্তৃপক্ষ এখনো এগুলো বুঝে নেয়নি। বাকিগুলোর কাজ চলছে।
এসব স্টেশনের বিষয়ে জানতে চাইলে আখাউড়া-লাকসাম ডাবল লাইন প্রকল্পের পরিচালক শহীদুল ইসলাম মঙ্গলবার রাতে ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এডিবির অর্থায়নে আখাউড়া-লাকসাম সেকশনে ডাবল লাইন নির্মাণ ও স্টেশন আধুনিকায়নের কাজ চলছে। আগামী ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ইতিমধ্যে মোট ১৮৪ কিলোমিটার রেল লাইনের মধ্যে ইতিমধ্যে ১০০ কিলোমিটারের কাজ শেষ হয়েছে। চারটি স্টেশনের আধুনিকায়নের কাজও শেষ হয়েছে। বাকিগুলোর কাজ চলছে।
নতুন স্টেশনগুলো নির্মাণ হলেও কেন সেগুলোতে ট্রেন থামছে বা যাত্রী উঠানামা করছে না, সে বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের চট্টগ্রামের মহাব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন মঙ্গলবার রাতে ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, রেলওয়ের স্টেশন মাস্টারের সংখ্যা কম। এ কারণে আমাদের অনেক স্টেশন বন্ধ রয়েছে। তাছাড়া দেখেন সব স্টেশনে তো সব ট্রেন থামে না। আন্তঃনগর ট্রেনও সব স্টেশনে থামে না। যেসব স্টেশন নির্মাণ হয়েছে সেগুলোর কোনো কোনটিতে লোকাল ট্রেন থামে এবং যাত্রী উঠানামা করে। পণ্যবাহী ট্রেন থামে এসব স্টেশনে।
বুধবার (২৭ জুলাই) দুপুরে ময়নামতি রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখা যায় সুনসান পরিবেশ। প্রচন্ড দাবদাহ থেকে কিছুটা স্বস্তি পেতে স্টেশনের বেঞ্চিতে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন কয়েকজন।
সেখানে কথা হয় ম্যাক্স অটোমোবাইলসের ভেকুলোডার অপারেটর কামাল হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, দৃষ্টিনন্দন এই স্টেশনটি দেখতে নানা প্রান্ত থেকে মানুষজন আসে। ছবি তুলে ও ভিডিও করে নিয়ে যায়। দুপুর হওয়ায় মানুষজন এখন নাই। তবে প্রতিদিন বিকেলে এবং শুক্রবারে মানুষের সমাগম বাড়তে থাকে। এখানে মাঝে মাঝে লোকাল ও মালবাহি ট্রেন থামিয়ে অন্যান্য ট্রেনকে পাস দেওয়া হয়। তবে স্টেশনটি চালু হলে মানুষের সুবিধা বাড়বে। যেহেতু পাশেই কুমিল্লার অন্যতম প্রধান জাঙ্গালিয়া বাসস্টেশন রয়েছে; স্টেশনটি চালু হলে যাতায়াত সহজ হবে।
স্টেশনে ঘুরতে আসা ইবনে তাইমিয়া স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাজিন জানায়, স্কুল ছুটি হলে প্রায়ই এখানে চলে আসি। ছিমছাম-গোছালো পরিবেশে বন্ধুদের সাথে ভালো সময় কাটে। আমাদের অনেক সহপাঠিই এখানে ঘুরতে আসে।
স্টেশনের বেঞ্চিতে শুয়ে থাকা ময়নামতি এলাকার আফজাল হোসেন জানান, অনেকদিন ধরেই তো দেখছি স্টেশনটি বন্ধ। এখন আবার নতুন করে সাজানো হয়েছে। স্টেশন চালু হয় কি না জানি না। আমরা মাঝে মাঝে আসি। গল্প-আড্ডায় সময় কাটে। শহর থেকেও তো অনেক মানুষ আসে। এতো টাকা খরচ করে স্টেশন বানাইয়া ট্রেন না থামলে লাভ কি?
ম্যাক্স অটোমোবাইল প্রোডাক্টস লিমিটেড এর প্রকৌশলী পলাশ বলেন, স্টেশনগুলোর বিষয়ে পুরোটা রেল কর্তৃপক্ষের। আমরা এ বিষয়টা বলতে পারবো না। তিনটি স্টেশনের কাজ শেষ হয়েছে। প্রতিটি স্টেশনে সিগন্যালও চালু আছে। সিগন্যালিংয়ের মাধ্যমে রেল অপারেটও করা হচ্ছে। প্রজেক্ট হ্যান্ডওভার (হস্তান্তর) হওয়ার পরে এসব স্টেশনে কোন ট্রেন থামবে কি থামবে না সেটা রেল কর্তৃপক্ষ ঠিক করবেন। রসুলপুর এবং রাজাপুর স্টেশনের কাজ চলছে।
পলাশ আরও বলেন, অনেকের মনে প্রশ্ন আছে, এতো কাছাকাছি তিনটি স্টেশন কেন? আমাদের বক্তব্য হচ্ছে- এগুলো তো নতুন করে তৈরি করা হয়নি। বরং পুরনো স্টেশনগুলোকে সংস্কার করে নতুন রূপ দেওয়া হয়েছে।
এনএইচবি/এএস