পেশার ভেতরে আবদ্ধ থাকা আমি সমর্থন করি না: হাবিবুর রহমান
ডিআইজি হাবিবুর রহমান
পুলিশ বাহিনীতে এক ব্যতিক্রমী নাম হাবিবুর রহমান। তার অনুপ্রেরণা, আন্তরিকতা ও কর্মের মাধ্যমে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বদলে দিয়েছেন কিছু সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জীবন। আর এই সামাজিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই তিনি হয়ে উঠেন হাজার মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস। হাবিবুর রহমান বাংলাদেশ পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি।
হাবিবুর রহমান গোপালগঞ্জের চন্দ্র দিঘলিয়া গ্রামে ১৯৬৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতকোত্তর করেন। পরে ১৭তম বিসিএস দিয়ে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন। এরপর থেকেই কর্মক্ষেত্রে নিজের মেধা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছেন। সাহস, সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার জন্য তিনি তিনবার বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) এবং দু’বার রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদকে (পিপিএম) ভূষিত হয়েছেন।
পেশাগত ও মানবিক কাজের বাইরে সফল ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এবং এশিয়ান কাবাডি ফেডারেশনের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
পুলিশের সেবার পাশাপাশি মানুষের সেবা করার জন্য গড়েছেন উত্তরণ ফাউন্ডেশন নামে একটি সেবামুখী প্রতিষ্ঠান। ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার পদে কাজের সুবাদেই দেশজুড়ে আলোচনায় আসেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। সাভারে বেদে পল্লী সমাজ ব্যবস্থা উন্নয়ন থেকে শুরু করে স্কুল, কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার, গাড়ি চালনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও বুটিক হাউজসহ নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে তাদের আত্মকর্মসংস্থানের পাশাপাশি বেদেপল্লীর অভিশপ্ত বাল্যবিবাহ রোধে তার ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে দেশে-বিদেশে।
নিজের প্রতিষ্ঠিত উত্তরণ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সুবিধা বঞ্চিত ও অবহেলিত পিছিয়ে পড়া হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘উত্তরণ কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ’ কর্মসূচি চালু করেন। হিজড়া সম্প্রদায়ের জীবনমান উত্তরণ, তাদের পূনর্বাসন ও মানুষ হিসেবে তাদের সামাজিক মর্যাদা সমুন্নত করতে সাড়া জাগানো বেশ কিছু পদক্ষেপ নেন। যে কারণে এই দুই জনগোষ্ঠীর কাছে তার পরিচয় মানবতার ফেরিওয়ালা।
বাংলাদেশ পুলিশকে মানবিক পুলিশে রূপান্তর করা গেলে এই মানুষগুলোর অনেক সমস্যাই আর থাকবে না। এই চিন্তা চেতনাকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করে চলেছেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান। মানুষের জন্য নিজে কাজ করছেন। অনুপ্রাণিত করে চলেছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের।
সম্প্রতি পুলিশি সেবা ও উত্তরণ ফাউন্ডেশনের নানা বিষয় নিয়ে ডিআইজি হাবিবুর রহমানের সঙ্গে কথা হয় ঢাকাপ্রকাশের। নিম্নে তার চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো..
ঢাকাপ্রকাশ: আপনার নানা ব্যস্ততার মধ্যেও উত্তরণ ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠন করেছেন, এটি করার পরিকল্পনা নিলেন কীভাবে?
ডিআইজি হাবিবুর রহমান: আপনারা এবং সবাই জানেন উত্তরণ ফাউন্ডেশন একটি মানবিক সংগঠন। এই সংগঠনটি অবহেলিত মানুষের পাশে দাঁড়ায়। উত্তরণ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত ও অবহেলিত এবং পিছিয়ে পড়া হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবন-মান উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘উত্তরণ কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ’ কর্মসূচি চালু করা এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়ন, তাদের পুনর্বাসন ও মানুষ হিসেবে তাদের সামাজিক মর্যাদা সমুন্নত করতে কিছু পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করা হলো এ সংগঠনের কাজ। ছোট বেলা থেকে নিজের যোগ্যতা ও বাবার আদর্শ বুকে ধারণ করে সমাজের অবহেলিত মানুষের জন্য কিছু করব এমন একটি উদ্যোগ গ্রহণ করার ইচ্ছা নিয়েই আমার কাজ করা।
ঢাকাপ্রকাশ: পুলিশি সার্ভিসের পাশাপাশি এমন একটি কাজ করা কি সম্ভব?
ডিআইজি হাবিবুর রহমান: আমি একজন পুলিশ কর্মকর্তা আমার কাজ আইন বাস্তবায়ন করা। পুলিশি সার্ভিসের মধ্যে যেগুলো আছে সেই সমস্ত কাজ দায়িত্ব নিয়ে করে থাকি। কিন্তু একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে পেশার ভেতরে আবদ্ধ থাকা সেটাকে আমি সমর্থন করি না। আমি মনে করি পুলিশের সেবার ভেতরে এবং বাইরে উভয় জায়গায় অনেক কিছু করার সুযোগ রয়েছে। ইচ্ছা শক্তি থাকলে পুলিশের কাজের পাশাপাশি আরও অনেক কিছু করা সম্ভব।
ঢাকাপ্রকাশ: উত্তরণ ফাউন্ডেশন মূলত কাদের নিয়ে কাজ করে?
ডিআইজি হাবিবুর রহমান: মূলত উত্তরণ ফাউন্ডেশন হলো মানবিক সেবামুখী একটি সংগঠন। যেখানে মানুষ বিপদগ্রস্ত হয় সেখানেই আমাদের এই সংগঠন বিভিন্ন সেবার উদ্দেশে কাজ করে।
ঢাকাপ্রকাশ: এক সময় বেদে সম্প্রদায় ও হিজড়া সম্প্রদায়ের লোক নানা অপরাধে যুক্ত ছিল, তাদের নিয়ে কাজ করতে কোনো সমস্যা হয়েছে কি?
ডিআইজি হাবিবুর রহমান: আমরা যারা পুলিশে কাজ করি তারা জানি এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কিছু আইনগত বিষয় রয়েছে। আমরা সবাই জানি পুলিশ আইনের মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করে কিন্তু আইন প্রয়োগ ছাড়াও অপরাধ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি পুলিশের এখতিয়ারের মধ্যেও রয়েছে। যেমন, কমিউনিটি পুলিশিং এর মাধ্যেমে সাধারণ জনগণকে পুলিশের কাজে ইনভাইট করে পারস্পারিক একটি আস্থার সম্পর্ক তৈরি করে এবং অনেক সময় তার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হয়ে যায় এগুলোই কমিউনিটি পুলিশিং। হয়তো কোনো একটা বিষয় নিয়ে মামলা হতে পারত বা কোনো জটিলতা তৈরি হতো কিন্তু কমিউনিটি পুলিশিং থাকার কারণে বিষয়টি সমাধান হয়ে গেছে যদি আমার বা আইনের লোকের পক্ষে সেটি সম্ভব হয় তাহলে আমি মনে করি সেই বিষয়টিতে আমাদের গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এমন ভাবে আমরা বেদে সম্প্রদায় ও হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষের সমস্যা সমাধনের পথ খুঁজেছি।
ঢাকাপ্রকাশ: পুলিশের দেওয়া বিভিন্ন ধরনের মামলার জট রয়েছে এসব মামলা ডিসপোজাল হতে সময় নেয় কেন?
ডিআইজি হাবিবুর রহমান: বাংলাদেশে বিভিন্ন অপরাধ সংক্রান্ত মামলাগুলোর প্রশাসন সিস্টেম রয়েছে এবং এসব মামলার জুডিশিয়াল সিস্টেম রয়েছে। এসব নিয়ে আমি বলব অনেক মামলার জটও রয়েছে যে মামলাগুলো হয় সেই মামলা থানায় ডিসপোজাল হতে একটু সময় নেয় এরপরে জেলায় অথবা কোর্টে যায় আমরা দেখেছি ওইসব মামলা শেষ হতে অনেক সময় লাগে। একটি ঘটনার বিচার হতে কয়েক বছর সময় লাগে। সেই সময় পর্যন্ত বিচার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং ধৈর্য অনেকেই হারিয়ে ফেলেন। এই মামলার বিষয়ে আমি বলতে চাই, যদি এ বিষয়ে বা ঘটনা ঘটার আগেই যদি সুষ্ঠু সমাধান দিতে পারি তাহলে অনেক ক্ষেত্রে অপরাধজনক ঘটনা কমে যায়। যদি পুলিশ এবং জনগণ আরও একটু সচেতন হয় তাহলে এ বিষয়গুলো মীমাংসা করা যায়। তো এসব বিষয়ে আমি চেষ্টা করি বিভিন্ন ঝামেলা মিটমাট করার। যাতে কারো কোনো সমস্যায় পড়তে না হয়।
ঢাকাপ্রকাশ: মাদকব্যবসায়ী ও সেবনকারীদের আপনারা কীভাবে সমাজের ভালো পথে ফিরিয়ে আনতে কাজ করেন?
ডিআইজি হাবিবুর রহমান: আমরা মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীদের প্রথমে কাউন্সেলিং করি এবং তাকে কিভাবে সমাজের ভালো পথে ফিরিয়ে আনতে হয় সেসব নিয়ে কাজ করি। আমাদের যেসব অফিসাররা আছেন সবার উদ্দেশে বলতে চাই একটা কাজে সীমাবদ্ধ না থেকে নিজে নিজের জায়গা থেকে সমাজের জন্য কিছু করতে হবে। আমাদের পুলিশ অফিসাররা অনেক জায়গায় বর্তমানে মানবিক বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন। যেমন, তারা একজন মাদক ব্যবসায়ীকে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছেন, তাকে খারাপ পথ থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। একজন নাগরিক হিসেবে আমার অনেক কিছু করার সুযোগ রয়েছে। শুধুমাত্র আইনের ধরা-বাধার মধ্যে থাকতে চাই না। সমাজের জন্য কিছু করতে চাই।
ঢাকাপ্রকাশ: আমাদের সমাজে তো আরও অনেক অসংগতি আছে। সন্ত্রাস, মাদকের মতো সমস্যাগুলো আমাদের সামাজিক ব্যাধি। একজন আইনের মানুষ হয়ে ওই সমস্যাগুলো সমাধানে অগ্রাধিকার না দিয়ে মানবিক কাজে যুক্ত হয়েছেন। এর কি কোনো সুনির্দিষ্ট গল্প আছে?
ডিআইজি হাবিবুর রহমান: আমাদের সমাজে যে সব অসংগতি আছে সব সমস্যা আসলেই একেবারে সমাধান করা সম্ভব নয়। তবে যেসব অসংগতি চোখে পড়ে তা সমাধানের জন্য চেষ্টা করি। সন্ত্রাস, মাদকের মতো সমস্যাগুলো আমাদের সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে সেসবও সমাধানের জন্য আমরা কাজ করছি। আর মানবিক কাজের বিষয়টি হলো, আমি যখন ঢাকা জেলার এসপি হিসেবে কাজ করতাম তখন আমি দেখতে পাই বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের যে মানবতার জীবন এবং পাশাপাশি তাদের যে চিরাচরিত পেশা সেটা সমাজের ঘৃণিত পেশা, অনেকেই পছন্দ করে না, তাছাড়া নানা অপরাধে তারা জড়িয়ে যাচ্ছে। তখন তাদের সেখান থেকে রক্ষা করার জন্য এবং তাদের প্রচলিত সমাজে অগ্রগতি দেওয়ার জন্য যতোটুকু পারি ততটুকু আমি চেষ্টা করেছি। তাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমরা নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। তারা মারা গেলে তাদের কবরস্থানে কবর দিতে দেওয়া হতো না, তাদের সন্তানদের স্কুলে যেতে দেওয়া হতো না তাদের প্রাধান্য দিত না। তখন থেকে আমার মনে হলো এটা তো ঠিক না। এরপর থেকে আমি তাদের নিয়ে কাজ শুরু করি।
ঢাকাপ্রকাশ: আর কাদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আছে ফাউন্ডেশনের?
ডিআইজি হাবিবুর রহমান: আমরা মূলত তৃতীয় লিঙ্গ ও বেদে জনগোষ্ঠীদের নিয়ে কাজ করেছি। সেই সঙ্গে সমাজের নিরীহ মানুষ, প্রতিবন্ধী ও অবহেলিত মানুষদের নিয়ে কাজ করি। তাছাড়া ফাউন্ডেশনের আরও কিছু চিন্তা আছে সেগুলো হয়তো পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে আমরা মানুষের জীবন যাত্রার উয়ন্ননের জন্য বিভিন্ন কাযর্ক্রয় চলমান রেখেছি।
ঢাকাপ্রকাশ: উত্তরণ ফাউন্ডেশন তো অনেকদিন ধরেই এই মানবিক কাজগুলো করে যাচ্ছে। জনমানুষের সমর্থন কেমন পাচ্ছেন?
ডিআইজি হাবিবুর রহমান: উত্তরণ ফাউন্ডেশন ইতোমধ্যে মানুষের জীবন যাত্রার মান উয়ন্ননের একটি সংগঠন হিসেবে বেশ সাড়া পাচ্ছে। এজন্য সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সহযোগিতারও প্রয়োজন আছে।
ঢাকাপ্রকাশ: উত্তরণ ফাউন্ডেশনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
ডিআইজি হাবিবুর রহমান: উত্তরণ ফাউন্ডেশনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো মানুষের সেবা করা। তবে ফাউন্ডেশনের ভবিষ্যৎ বেশ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে সেগুলো প্রকাশ বা বাস্তবায়ন করা হয়নি, চিন্তার মধ্যে রয়েছে। তবে আমি একজন মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে থেকে সেবা করে যেতে চাই এটাই হলো আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।
ঢাকাপ্রকাশ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ডিআইজি হাবিবুর রহমান: ঢাকাপ্রকাশ পরিবার এবং আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
কেএম/আরএ/