সম্ভাবনার নতুন দুয়ার পদ্মা সেতু-১১
এক কিশোরীর চোখে পদ্মা পারাপারের স্বপ্ন
বাবা তখন ঢাকায় চাকরি করতেন। আমার জন্ম হয়নি। বড় দুই ভাই খুব ছোট। প্রতিবার ছুটি শেষে বাবা ঢাকায় চলে আসতেন। ভাইয়েরা বাবাকে যেতে না দেয়ার জন্য কান্না জুড়তেন। তখন বাবা নাকি বলতেন, পদ্মা সেতুটা হইলে সকালে বাড়ি থেকে ঢাকা গিয়ে অফিস করে সন্ধ্যায় আবার তোদের কাছেই ফিরবো। পদ্মা পেরোলেই তো ঢাকা। আমার দুই মানিককে বুকে নিয়ে শান্তির ঘুম দিব...।
বলতে বলতে নাকি বাবার দুচোখ বিস্ময়ে চকচক করে উঠতো। সেই বিস্ময় ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে দুই ভাই আনন্দে খিল খিল করে হেসে উঠতো। হাত তালি দিত। যুগ যুগ ধরে পদ্মা সেতু নিয়ে ওপারের মানুষ এভাবে কত শত স্বপ্ন বুনে গেছেন। পদ্মার ওপারের মানুষের কাছে পদ্মা সেতু নিয়ে এমন উচ্ছ্বাসের হাজারো গল্প শুনেই বড় হয়েছি আমরা। এরপর কত বছর পেরিয়ে গেছে। বাবা বৃদ্ধ হয়েছেন। বাবা এখন পদ্মার ওপারের গ্রামে থাকেন। আর সময়ের প্রয়োজনে আমরা ভাই-বোনেরা থাকছি ঢাকায়। পদ্মার কারণে এ দূরত্বটুকু মনে হয় এক সমুদ্র।
আমরা ঢাকায় কিংবা যেখানেই থাকি ঈদ কিংবা কোন উৎসব এলে সকলকে পদ্মার ওপারের সবুজে ঘেরা সেই ঘরটিতেই ফিরতে হয়। সেখানেই যেন সকল শান্তির বসবাস। তবে ওই যে বললাম, পদ্মার কারণে দূরত্বটুকু যেন এক সমুদ্র। সেই শান্তির ঘর পর্যন্ত পৌঁছাতেই করতে হয় বিশাল যুদ্ধ জয়। এক ঈদযাত্রার কথা বলতে পারি। ২০১৯ সালে ঈদে বাড়ি যাওয়া নিয়ে আমরা আগেই পরিকল্পনা করলাম, কীভাবে দ্রুততম সময়ে বাড়ি যাওয়া যেতে পারে। ঠিক করা হলো ঢাকা থেকে আমরা রওনা হবো সেহরি খেয়েই। যত দ্রুত পদ্মার পাড়ে পৌঁছানো যায়! ভোর রাতে নিশ্চই রাস্তা ফাঁকা কিংবা ফেরিও পেয়ে যাবো খুব সহজে। আর তাতে করে সকাল ১০টা-১১ টায় পৌঁছে যাব বাড়ি। ইফতারে কি কি আয়োজন হবে তা আগে থেকেই বাজার করে রেখেছেন বাবা। আজ সবাই একসঙ্গে ইফতার করবো।
ভাবতেই খুব আনন্দ হচ্ছিলো। সেখানে আমাদের অপেক্ষায় রয়েছে বাবা-মায়ের স্নিগ্ধ-ক্লান্ত দুই জোড়া চোখ। আমাদের দেখা পেলেই যেন চোখের সকল ক্লান্তি সেরে যাবে। যা ভেবেছিলাম, রাস্তা অনেকটাই ফাঁকা। খুব কম সময়ে আমরা পৌঁছে গেলাম পদ্মার পাড়ে। যখন পৌঁছেছি সূর্য কেবল আলো ছড়াচ্ছে। সদ্য ভোরের সোনালী আলোয় যা দেখলাম, হাজার হাজার গাড়ি স্থির দাঁড়িয়ে আছে ফেরীর অপেক্ষায়। হয়তো আমাদের মতন তারাও ভেবেছিলো ভোরেই পৌঁছাবে ঘরে। তাইতো সবাই সেহরি খেয়েই রওনা। তাদের লাইনে যোগ হলো আমাদের গাড়িও। লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলো। এক সময় ফেরিও পার হওয়া গেলো।
আমরা যখন মাদারীপুর শহর পার হচ্ছি তখন মাগরিবের আজান হচ্ছে! বাড়ি যেতে তখনও ঘন্টা খানেক বাকি। খাবার কিনে গাড়িতেই ইফতার করে নিতে হলো। বাবা মা তখনও অপেক্ষা করছিলেন একসঙ্গে বসে ইফতার করবেন বলে। একটি সেতুর অভাবে এমন ঘটনা ঘটেছে আরও অসংখ্য মানুষের ক্ষেত্রে। এখন স্বপ্নের পদ্মা সেতু হয়েছে। সামনের ২৫ জুন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে। খবরটি বাবাকে জানাতেই বিস্ময়ে তার দুচোখ চক চক করে উঠলো। এবার তার সন্তানেরা পদ্মা পেরিয়ে বাবাকে দেখার তৃষ্ণা নিয়ে তার বুকে ফিরবে স্বল্পতম সময়েই।
পদ্মা সেতু নিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ঘরে ঘরে রয়েছে এরকম হাজারো গল্প। প্রায়ই খবর শোনা যায় ফেরীর অপেক্ষায় অ্যাম্বুলেন্সেই রোগীর মৃত্যুর খবর। মুমূর্ষু ব্যক্তিকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা নিয়ে আসার পথেই রোগীর মৃত্যু। পদ্মার ওপারের মানুষেরা উন্নত চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন এই একটা সেতুর জন্য। সুচিকিৎসার অভাবে স্বজন হারানোর বেদনা আছে ওই অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি পরিবারের মধ্যে। আমাদের আত্মীয় মাদারীপুরের কালকিনী উপজেলা সাহেবরামপুর গ্রামের সারওয়ার ভাইয়ের বাবা হঠাৎ স্টোক করেন। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাকে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য ছুটলেন ঢাকার উদ্দেশ্যে। পদ্মা পেরোলেই রাজধানী ঢাকা। পাবেন উন্নত চিকিৎসা। চিকিৎসা দিয়ে বাবাকে সুস্থ করে নিয়েই তবে বাড়ি ফিরবেন। সেই স্বপ্ন নিয়েই যাত্রা শুরু করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ফেরী ঘাটেই আটকা পড়লেন ৫ ঘন্টা। ফলে যা হবার তা-ই হলো। উন্নত চিকিৎসার আশা সেখানেই মাটি। ফেরি ঘাটেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন রোগী। ফলে লাশ নিয়েই বাড়ি ফিরলেন তারা। সেদিন তিনি বারবার একটি কথাই বলেছিলেন, নদীতে একটি সেতু থাকলে হয়তো বাবা আজ বেঁচে ফিরতেন।
পদ্মা সেতু না থাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরির জন্য অপেক্ষা, কত শত মানুষের প্রাণ দিতে হয়েছে পদ্মার উন্মত্ত ঢেউয়ে। সেই যন্ত্রণাময় দিনগুলি শেষ হতে চলেছে। এবার সেসব পেছনে ফেলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেয়ার পালা এসেছে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এসব সমস্যার সমাধান হবে। এই অঞ্চলে এখন শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে। বেকারত্ব দূরীকরণে ভূমিকা রাখবে। মানুষ উন্নত চিকিৎসা পাবে। গোটা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চেহারা বদলে যাবে। সকলের চোখে পদ্মা সেতু অর্জন এক বিস্ময়। এ বিস্ময় আমার বাংলাদেশের।
এসজেটি/এনএইচবি/এএজেড