লাখ টাকা করে বরাদ্দ দিয়ে জীবিত রাখা হচ্ছে ২২ প্রকল্প
চলতি অর্থবছরে (২০২১-২২) ৪১৫টি প্রকল্প সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। কিন্তু চার কোটি টাকা থেকে শুরু করে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের ২২টি প্রকল্প দুই থেকে চারবার সংশোধন করে সময় বাড়িয়েও শেষ হচ্ছে না। নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হলেও কোনো কোনো প্রকল্প এক টাকাও ব্যয় করতে পারেনি। তাই আগামী অর্থবছরে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের এসব প্রকল্পে মাত্র এক লাখ টাকা করে বরাদ্দ দিয়ে জীবিত রাখার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তিনবারের বেশি কোনো প্রকল্প সংশোধন করা যাবে না বলা হলেও কোনো কোনো প্রকল্প চতুর্থবারও সংশোধন করা হবে।
মঙ্গলবার (১৭ মে) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় এর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে সূত্র জানায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘চলতি অর্থবছরে শেষ করার কথা থাকলেও করোনার কারণে অনেক প্রকল্প ঠিকভাবে কাজ করতে পারেনি। কোনো কোনো প্রকল্প ৯৮ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে। তাই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে সংশোধনের জন্য বলেছে। এর সুফল পেতে আগামী অর্থবছরে ২২টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব প্রকল্পে এক লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তারা পরে সমন্বয় করে নেবে। একই সঙ্গে প্রকল্প সংশোধনের নিয়ম মেনে তা বাস্তবায়ন করবে।’
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে সরকার ৪১৫টি প্রকল্প সম্পন্ন করার কথা ছিল। কিন্তু তা পারছে না বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। বাধ্য হয়ে আগামী অর্থবছরের (২০২২-২৩) এক লাখ টাকা করে বরাদ্দ দিয়ে জীবিত রাখা হচ্ছে এবং সংশোধন করে সময় বাড়িয়ে শেষ করা হবে।
লাখ টাকা করে বরাদ্দ রাখা প্রকল্প রয়েছে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থপনা বিভাগ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, জননিরপত্তা বিভাগে। এ ছাড়া আইন ও বিচার বিভাগ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়েরও একটি প্রকল্প রয়েছে।
সূত্র জানায়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ বেতারের জাতীয় বেতার ভবনে আধুনিক ও ডিজিটাল সম্প্রচার যন্ত্রপাতি স্থাপন প্রকল্পটি ২০১৬ সালে শুরু হয়ে ২০২২ পর্যন্ত চারবার সংশোধন করে আগামী জুনে শেষ করার কথা রয়েছে। চলতি অর্থবছরে ২৪ কোটি টাকা বরাদ্দও রাখা হয়েছে। তারপরও শেষ হচ্ছে না প্রায় ৭৫ কোটি টাকার এ প্রকল্প। বাধ্য হয়ে সরকার আগামী অর্থবছরে এক লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে এবং সময়ও বাড়ানো হয়েছে।
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের আওতায় আশুগঞ্জ ৪০০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্পটিও তিনবার সংশোধন করে আগামী জুনে শেষ করার কথা। তারপরও হচ্ছে না। ২০১৫ সালের জুন থেকে শুরু হওয়া ৪২১ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৯৬ শতাংশ। বাকি কাজ শেষ করতে আগামী অর্থবছরে এক লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে শেষ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের আরেকটি মিরসরাই ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পটিও ২০১৭ সালের জুলাই থেকে শুরু হয়ে ২০১৯ সালে শেষ হবার কথা। কয়েকবার সংশোধন করে জুনে শেষ করার কথা থাকলেও শেষ হচ্ছে না। ৯৩১ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পে এপ্রিল পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে ৯৮ শতাংশ। বাকি কাজ শেষ করতে এবার এক লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তা কার্যকর করতে সময় বাড়ানো হবে।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের গোপালগঞ্জ ইসলামিক ফাউন্ডেশন কমপ্লেক্স স্থাপন প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জুনে শুরু হয়েছে, তা সংশোধন করে ২০২২ সালের জুনে শেষ করার কথা। তাও হচ্ছে না। ৩০ কোটি টাকার প্রকল্পটি সংশোধন করে ২০২৩ সালের জুনে শেষ করার জন্য আবার এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের স্কুল ২১ এমপাওয়ারিং সিটিজেনস ফর ইনক্লুসিভ অ্যান্ড সাসটেইন প্রকল্পটি ২০১৮ সালে শুরু হয়ে ২০২১ সালে শেষ হবার কথা ছিল। ১৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পটিতে জুন পর্যন্ত ব্যয় হবে ১২৮ কোটি টাকা। তাই বাকি কাজ শেষ করতে এক লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে জীবিত রাখা হবে এক বছর অর্থাৎ আগামী অর্থবছরের জুনে শেষ করা হবে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদপ্তরের সোনাইমুড়ী, কালিগঞ্জ, আড়াইহাজার, মঠবাড়ীয়া উপজেলায় ট্রেনিং সেন্টারও হোস্টেল নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১৪ সালের জুনে শুরু হয়ে ২০২১ সালের জুনে শেষ করার কথা। কিন্তু দুই বছর সময় বাড়িয়েও তা শেষ হচ্ছে না। তাই সাড়ে ৫২ কোটি টাকার প্রকল্পটি সংশোধন করে ২০২৩ সালের জুনে শেষ করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুনে শেষ করার কথা। কিন্তু ৩১ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের সময় দুই বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তাই নতুন এডিপিতে এক লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার।
পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের ন্যাশনাল হাউজহোল্ড ডাটাবেজ প্রকল্পটি ২০১৩ সালের জুনে শুরু হয়ে ২০২২ সালে শেষ হবার কথা। তারপরও হচ্ছে ৭২৭ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্প। তাই বাকি কাজ শেষ করতে এক লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে নতুন এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ফরিদপুরে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘরসহ বঙ্গবন্ধু উদ্যান স্থাপন প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্পটিও ২০২২ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয়ে জুনে শেষ করার কথা। কিন্তু সময় বাড়িয়েও প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের এক টাকাও ব্যয় হয়নি। কোনো কাজ না হওয়ায় নতুন এডিপিতে লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
লাখ টাকা বরাদ্দের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ এমভি আকরামকে উপজীব্য করে নারায়ণগঞ্জে একটি নৌ-জাদুঘর নির্মাণ প্রকল্পও রয়েছে। যা ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুনে শেষ হবার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না। প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পে এক টাকাও ব্যয় হয়নি। তাই নতুন এডিপিতে যুক্ত করা হয়েছে।
লাখ টাকা বরাদ্দের তালিকায় রয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়ের চর ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট প্রকল্প। প্রায় ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুনে শেষ করার কথা। তা হচ্ছে না।
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও আধুনিক নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত পল্লী জনপদ নির্মাণ প্রকল্পেও লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া উত্তরাঞ্চলের অতি দরিদ্রদের কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ কর্মসূচি প্রকল্পটিতেও লাখ টাকা রবাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ১৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পটি ২০১৪ সালের মার্চ থেকে কয়েকবার সংশোধন করে ২০২২ সালের মার্চে শেষ করার কথা। তাও হচ্ছে না।
নতুন এডিপিতে লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বরিশাল মেট্রেপলিটন ও খুলনা জেলা পুলিশ লাইন নির্মাণ প্রকল্পে। যা ২০১৯ সালের জুলাই শুরু হয়ে তিন বার সংশোধন করে ২০২২ সালের জুনে শেষ করা কথা ছিল। তা হচ্ছে না। প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে কারা অধিদপ্তরের কারা নিরাপত্তা আধুনিকায়ন প্রকল্পটিতেও লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রকল্পের লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এ তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের বর্তমান জায়গায় ১৫ তলা ভবন নির্মাণ, উত্তরা লেক উন্নয়ন প্রকল্প। আছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়া ও বিভিন্ন হলের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন ও পরিমার্জন কাজ প্রকল্প। সংশোধন করেও চলতি অর্থবছরে শেষ করতে না পারায় আরবান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন প্রকল্প, সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদ্যমান রানওয়ের শক্তি বৃদ্ধিকরণ এবং ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট স্থাপন, গাজিপুর শাখা প্রকল্প।
জেডএ/এসএন