৬ বছরে আত্মহত্যা করেছে ৭০ হাজার মানুষ
ধানমন্ডির ৭ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে বন্দুক মাথায় ঠেকিয়ে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন ব্যবসায়ী আবু মহসিন খান। আত্মহত্যার আগে তিনি চিরকুটে লিখে গেছেন নানা হতাশার কথা। এরপর সারাদেশে এ বিষয় নিয়ে নানান আলোচনা-সমালোচনা হয়। চোখের সামনে এমন একটি প্রাণ ঝরেপড়া কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না অনেকেই।
প্রেসক্লাবের সামনে নিজের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরানোর চেষ্টা করেন ২৭ বছর বয়স্ক এক যুবক। উপস্থিত লোকজন ও পুলিশ সদস্যরা কিছু সময় চেষ্টা করে যুবককে ধরে শাহবাগ থানায় নিয়ে যান। এ ঘটনায় যুবকটির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারায় একটি মামলা দায়ের করে। ওই যুবক এখন কারাগারে।
আত্মহত্যায় সহায়তা বা প্ররোচনাকারীকে দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারা অনুযায়ী ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া, আত্মহত্যার চেষ্টাকারীর শাস্তি, দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারায় এক বছর কারাদণ্ড।
আত্মহত্যার চেষ্টা এবং কাউকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়াও বড় অপরাধ। পুলিশ জানায়, আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারীদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো আইনত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। তবে মরার পরে অপমৃত্যু মামলা হয়।
প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ জনের আত্মহত্যা
আত্মহত্যার ওপর পরিচালিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত ৫০ বছরে সারা পৃথিবীতে মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার শতকরা ৬০ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশেই ২ দশমিক ০৬ শতাংশ। প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রতি লাখে ২৮ দশমিক ০৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করছে। প্রতি বছরই এ সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশের প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ জন মানুষ আত্মহত্যা করছে।
বেশ কয়েকটি জরিপ বলছে, ৬ বছরে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে দেশে আত্মহত্যা করেছে ১০ হাজার ৭৪৯ জন।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী- ২০১৭ সালে সারাদেশে আত্মহত্যার ঘটনা ১০ হাজার ২৫৬টি। ২০১৮ সালে ১১ হাজার মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। ২০১৯ সালে সারা দেশে ১০ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। আর ২০২০ সালে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছেন।
২০২১ সালের আত্মহত্যার সঠিক পরিসংখ্যান ডিএমপির কাছে নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিসংখ্যান মতে, ২০২১ সালে ১১ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছেন।
ছাত্রভিত্তিক সামাজিক সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন জানায়, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে আত্মহত্যা ৪৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। এদের মধ্যে নারীর ক্ষেত্রে ৫৭ শতাংশ এবং পুরুষের ক্ষেত্রে ৪৩ শতাংশ বেড়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারিকালে ২০২১ সালে সারাদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এদের মধ্যে ৬৫ জন পুরুষ, ৩৬ জন নারী। গবেষকরা মনে করছেন, মহামারির মধ্যে সামাজিক, আর্থিক ও পারিবারিক চাপে হতাশা বেড়ে যাওয়া আত্মহত্যার কারণ হতে পারে।
সামাজিক, আর্থিক ও পারিবারিক চাপ বেড়ে যাওয়া, হতাশায় ভোগা আত্মহত্যার কারণ বলে মনে করছেন গবেষকরা। তাদের দাবি, যৌতুক, নির্যাতন, বখাটের নিপীড়ন, আর্থিক টানাপোড়েন বা পারিবারিক কলহ মানুষকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার প্রবণতা একটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসার মাধ্যমে আত্মহত্যার ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা ও প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিং।
ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের সাইকিয়াট্রি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাহিদা চৌধুরী ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, আত্মহত্যা প্রবণতা বাড়ার নানা কারণ রয়েছে। একটি হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়, আরেকটি হচ্ছে পারিপার্শ্বিক অবস্থা। বর্তমানে মানুষ পরিবারকে মোটেও সময় দিতে চায় না। অনেকে কাজে ব্যস্ত থাকে। আমার পরামর্শ হলো কর্মের পাশাপাশি প্রত্যেক মানুষের পরিবারকে সময় দেওয়া উচিত।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, আত্মহত্যার প্রবণতা ঠেকাতে সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ় করতে হবে। মানুষ বেঁচে থাকার জন্য নানা ধরনের সম্পর্কে জড়িত হয় বা জড়িয়ে পড়ে। নানা ধরনের সংকট জীবনে তৈরি হয়।
তিনি বলেন, সংকটগুলোকে মোকাবেলা করে আমাদের এগিয়ে যেতে হয়। কিন্তু যখন তার কোনো সংকট সে এককভাবে মোকাবেলা করতে পারে না অথবা একজন ব্যক্তি তার এ দীর্ঘ যাপিত জীবনে যে পরিবার-পরিজনের জন্য কাজ করেছেন তারা যখন তাকে অবহেলা করে বা তার প্রতি গুরুত্ব দেয় না অথবা সে যখন তার নানান দিক থেকে ব্যর্থ হয় তখন তার মধ্যে নানা ধরনের হতাশা কাজ করে।
এ অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, হঠাৎ সারাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো সামাজিক দায়বদ্ধতা এড়িয়ে চলা। ব্যক্তির প্রয়োজনে ব্যক্তিকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। কিন্তু বিষয়টা হলো আমাদের দেশের আত্মহত্যার বিষয়গুলো সামাজিক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে আমরা দেখি। এসব বিষয়ে সরকারেরও একটা ভূমিকা প্রয়োজন। ‘আত্মহত্যাকে না বলুন’ এ স্লোগান সামনে রেখে এগোতে হবে। তাহলে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
কেমএম/এসএন