তিন ফসলি জমিতে আ'লীগ নেতার ইটভাটা নির্মাণ
ছবি : ঢাকাপ্রকাশ
নওগাঁ পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দফায় দফায় জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অভিযান চালিয়েছেন অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে। বেশ কয়েকটি ইটভাটার মালিককে করা হয়েছে লাখ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি একাধিক নির্মাণকৃত ইটভাটা গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ এসব অভিযানের মধ্যেও এবার নওগাঁর মান্দায় তিন ফসলি জমিতে অবৈধভাবে ইটভাটা নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে।
উপজেলার কশব ইউনিয়নের তালপাতিলা শিবনগর এলাকায় অনুমোদন ছাড়াই একটি ইটভাটা নির্মাণের তোড়জোড় চালিয়ে যাচ্ছেন ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাবেক এই নেতা। অনেকে বলছেন প্রভাবশালী হওয়ায় ক্ষমতার জোরে তিনি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ইটভাটার নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আর সংশ্লিষ্টরা কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় জনমনে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার তালপাতিলা শিবনগর এলাকার একটি মাঠে ‘এসইপি ব্রিকস’ নামের একটি ইটভাটা নির্মাণের কাজ চলছে। এর চারপাশে রয়েছে ফসলি জমি। এছাড়া নিমার্ণাধীন ইটভাটা থেকে আধা কিলোমিটার দূরেই জনবসতি। ইটভাটাটি চালু হলে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি আশপাশের জমির ধানসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেখানে নির্মাণ শ্রমিকেরা ইটভাটাটির চিমনি নির্মাণের কাজ করছেন। জিজ্ঞেস করলে শ্রমিকেরা জানান, ইটভাটাটির মালিক আব্দুল খালেক।
ইটভাটা প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৩ অনুযায়ী, ফসলি জমিতে ইটভাটা স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা আছে। তবে এ ক্ষেত্রে সেই নিষেধাজ্ঞা মানা হয়নি। পরিবেশ অধিদপ্তরের অনাপত্তি সনদ ছাড়াই নির্মাণ করা হচ্ছে ইটভাটাটি। নিয়মনীতি মানা না হলেও যেন দেখার কেউ নেই। এদিকে কৃষিজমিতে ইটভাটা হলে চাষাবাদের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন স্থানীয় কৃষকেরা।
আশপাশের লোকজন বলেন, শিবনগর এলাকার ফসলি মাঠের প্রায় জমিই তিন ফসলি। এক মাস আগে ফসলি জমির এই মাঠে ইটভাটা নির্মাণের জন্য নির্মাণসামগ্রী ফেলা শুরু করে উপজেলার কাঁশোপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল খালেক। ১৫ দিন আগে থেকে ইটভাটাটির চিমনি নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। প্রশাসনের অনুমতি না পেলেও আওয়ামীলীগ নেতা আব্দুল খালেক ইটভাটা নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
তালপাতিলা গ্রামের কৃষক সলোমান হোসেন বলেন, ‘যে মাঠে ইটভাটাটি নির্মাণ করা হচ্ছে, সেই মাঠের অধিকাংশ জমিই তিন ফসলি। ইটভাটাটি চালু হলে আশপাশের জমিতে ধানসহ বিভিন্ন ফসল আবাদ ব্যাহত হবে। যেখানে ভাটা হচ্ছে সেখান থেকে কিছু দূরেই আমার চার বিঘা ফসলি জমি আছে। মাঝেমাঝে টিভি-পত্রিকার খবরে দেখি ইটভাটার বিষাক্ত গ্যাসে মাঠের ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এখানে সে ধরণের ক্ষতি হতে পারে। ইটভাটাটির নির্মাণকাজ শুরুর পর থেকে এই মাঠে যাঁদের জমি আছে, তাঁরা সবাই খুব চিন্তিত।’
উপজেলার চকউলী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ইয়াকুব আলী মন্ডল বলেন, ‘একটি জমিতে চাইলেই যা খুশি তাই করা যায় না। ফসলি জমিতে ইটভাটা নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা আছে। তারপরেও ওই এলাকায় তিন ফসলি উর্বর জমিতে কিভাবে ইটভাটা নির্মাণ হচ্ছে? আমার বোধগম্য হচ্ছে না। স্থানীয় কৃষকেরা সবাই এই ভাটা নিয়ে ক্ষিপ্ত। কিন্তু ভাটা মালিক প্রভাবশালী লোক হওয়ায় কেউ প্রশাসন কিংবা পরিবেশ অধিদপ্তরে অভিযোগ করার সাহস পাচ্ছে না। তিন ফসলি জমিতে কোনোভাবেই ইটভাটা নির্মাণ করতে দেওয়া উচিত নয়।’
শিবনগর গ্রামের বাসিন্দা সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এলাকাটা অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ একটা এলাকা। ইটভাটা নির্মাণ হলে পরিবেশ দূষণের কারণে স্থানীয় লোকজনের স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে, ফসল উৎপাদন ব্যাহত হবে আশপাশের ফসলি জমিতে। এছাড়া ইটভাটার এক থেকে দুই কিলোমিটার মধ্যে আম-কাঁঠাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফলজ গাছের ফল উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। আর ইটভাটার কারণে এসব ক্ষয়ক্ষতি পরীক্ষিত। তাই আগামীতে ক্ষয়ক্ষতির কথা চিন্তা করে প্রশাসনের উচিত দ্রুত এই ইটভাটা নির্মাণের কাজ বন্ধ করে দেওয়া।’
এ সম্পর্কে এসইপি ব্রিকস ইটভাটার মালিক আব্দুল খালেক গণমাধ্যমকর্মীকে বলেন, ‘কাঁশোপাড়া এলাকায় আমার একটি ইটভাটা ছিল। সেই ইটভাটাটি তালপাতিলা শিবনগর এলাকায় স্থানান্তর করা হচ্ছে। তবে প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়েই ইটভাটা চালু করা হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নওগাঁ পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মলিন মিয়া জানান, ‘তিন ফসলি জমিতে ইটভাটা নির্মাণের কোনো সুযোগ নাই। এ বিষয়ে কোনো লিখিত অভিযোগ পাই নাই। অভিযোগ করলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মান্দা উপজেলার নির্বাহী অফিসার লায়লা আনজুমান বানু জানান, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখা হবে। প্রকৃতপক্ষে ফসলি জমিতে ইটভাটা নির্মাণ করা হলে কোনোভাবেই অনুমোদন দেওয়া হবে না।’