সারিন্দার সুরে সংসার চলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সুনীলের
বাইশ বছর ধরে পথে-ঘাটে এবং বিভিন্ন হাট-বাজারে সারিন্দার সুর ও সুমিষ্ট কণ্ঠে গান পরিবেশন করে কোনোরকমে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিল্পী সুনীল চন্দ্র রায় (৩৭)।
সুনীল বাস করেন উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী সীমান্তবর্তী উপজেলা নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের কিষামত শিমুলবাড়ী গ্রামে। তিনি সে গ্রামের মৃত শৈলান চন্দ্র রায়ের ছেলে।
চার বছর আগে বাবা শৈলান চন্দ্র রায় তার স্ত্রী শ্রীমতি রায়, বড় ছেলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সুনীল ও ছোট ছেলে শুশীলকে ছেড়ে না ফেরার দেশে যান। সংসারে অভাব থাকায় মাত্র ৮ বছর বয়স থেকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সুনীল চন্দ্র রায় ফুলবাড়ী সদর ইউনিয়নের খামারটারী এলাকায় মামা মনোরঞ্জনের বাড়িতে থাকে। মামা মনোরঞ্জন ছোট থেকেই সুনীলকে বড় করেন। তিনি ১৪ বছর আগে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সুনীলের বিয়েও দিয়ে দেন।
সুনীলের বিয়ের কয়েক বছর পর মামা মনোরঞ্জন রায় বাড়ি করার জন্য চার শতক জমি তার নামে লিখে দেন। টাকার অভাবে মামার দেওয়া জমিতে বাড়ি করতে পারেননি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সুনীল। এখনও স্ত্রী ও ১২ বছরের ছেলে সন্তানসহ মামার বাড়িতেই আছেন। তার ছোট ছেলেটি তালতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণিতে পড়ে। সুনীলের সম্বল বলতে প্রতিবন্ধী ভাতা ও তার সুরেলা কন্ঠ।
বাবার সম্পদ বলতে মাত্র ৪ শতক জমির ওপর বাড়িতে একটি টিনের চালায় ছোট ভাই শুশীলসহ মা শ্রীমতি রায় ওই বাড়িতে থাকেন। সেখানেই ছোট ভাই শুশীল ও মা মানুষের বাড়িতে কাজ করে অনেক কষ্টে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছেন।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিল্পী সুনীল চন্দ্র রায় বলেন, ‘বাবা-মার কাছে শুনেছি, আমার বয়স যখন ৫ বছর তখন তার টাইফয়েড জ্বর হয়। তাতে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলি। পরে তার পরিবার বিভিন্ন সময়ে তাকে তৎকালীন সময়ে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও রংপুরে চিকিৎসার করার পরেও সুনীলের দৃষ্টি শক্তি আর ফিরে আসেনি। দৃষ্টিশক্তি না থাকায় সুনীল সম্পূর্ণরুপে পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তারপর সে পনের বছর বয়সে জীবন-জীবিকার তাগিদে হাতে তুলে নেন সর আর সারিন্দা।
ফুলবাড়ীর উপজেলার ৬ টি ইউনিয়নের বিভিন্ন হাট বাজার ও গ্রামগঞ্জে ঘুরে লোক সমাগমে সারিন্দা বাজিয়ে ভাওয়াইয়া, লালনগীতি, পল্লীগীতিসহ বিভিন্ন গান পরিবেশন করে জীবিকা নির্বাহ করেন সুনীল।
পথে-ঘাটে ও বিভিন্ন বাজারে সুনীলের সুরেলা কণ্ঠের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে উপস্থিত মানুষজন যার যেমন সাধ্য অনুযায়ী সুনীলকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে। এতে তার দৈনিক ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় হয়। সেই টাকা দিয়ে কোনোরকমে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সুনীলের সংসার চলে। এ ভাবে বাইশ বছর ধরে সুখ-দুঃখের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সুনীলের সংসার ও সর সারিন্দা ।
সুনীল মামার দেওয়া ৪ শতক জমিতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকার জন্য সরকারিভাবে ঘরের দাবি জানিয়েছেন।
নাওডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলাম সাবু জানান, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সুনীল খুব অভাবী মানুষ। তিনি বিভিন্ন হাট-বাজারে গান পরিবেশন করে মানুষের মনকে জয় করে নিয়েছেন। মানুষ তার গান শুনে খুশি হয়ে কেউ ৫ টাকা কেউ ১০ টাকা দেন। তা দিয়ে তিনি সংসার চালান। সুনীলকে একটু সহযোগিতা করলে সে একদিন বড় গায়ক হতে পারতো।
ফুলবাড়ী উপজেলা শিল্পকলা একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান জানান, সুনীল চন্দ্র রায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিল্পী। তিনি সারিন্দা বাজিয়ে গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তার থাকার জায়গা নাই। সে তার মামার বাড়িতে থাকেন। আমি যতটুকু জানি তার মামা তাকে ৪ শতক জমি দিয়েছেন। সেই জমিতে ঘর নির্মাণ করার সামর্থ নেই। করোনাকালে তাকে ছোট একটা অনুদানের ব্যবস্থা করেছি। উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা পরিষদের কাছে সুনীলের থাকার জন্য সরকারিভাবে একটি ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে তার প্রতিভা বিকাশের জন্য শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে সব রকম সহযোগিতা করা হবে।
এসিআর/এএন