প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নির্মাণ ও বণ্টনে ব্যাপক অনিয়ম!
নেত্রকোনার বারহাট্টায় মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহার ঘর নির্মাণ ও বণ্টনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ভূমিহীনদের নামে দুই শতাংশ খাস জমি বরাদ্দ পেয়েছে আর্থিক সচ্ছল ব্যক্তিরা। এমনকি তারা পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ভূমিহীনদের ঘরও। এ ছাড়াও এসব ঘর নির্মাণ কাজের প্রতিটি ধাপে ব্যাপক অনিয়ম ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করাসহ আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। ফলে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে সরকারের এই মহৎ উদ্যোগটি।
সরেজমিনে বাড়ি বাড়ি ঘুরে দেখা গেছে, ভূমিহীনদের মাঝে বিতরণ করা ঘর যারা পেয়েছেন তাদের মধ্যে কারো ৫ কাঠা জমি আছে, আবার কেউ ভূমি ও ঘরের মালিক।
এ ছাড়াও একাধিকবার সরেজমিনে ঘর নির্মাণের কাজ দেখতে গিয়ে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর উপহার ঘর নির্মাণে নিম্ন মানের সামগ্রী ব্যবহার ও প্রয়োজনের তুলনায় কম সিমেন্ট দিয়ে ঘর তৈরি করা হয়েছে। ফলে এসব ঘর নির্মাণের পর দেয়ালে হাত দিয়ে আঘাত করলেও দেয়াল থেকে আস্তর খসে পড়ছে। এসব ঘর যেকোনো সময় ধ্বসে পড়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। এ ছাড়াও ঘরের চালে হালকা ও নিম্নমানের পাতলা কাঠ ও পাতলা টিন ব্যবহারের ফলে বড় ধরনের বাতাস কিংবা ঝড়-তুফানে এসব ঘরের চাল টিকবে কিনা সেটা নিয়েও শঙ্কা থেকে যাচ্ছে। এ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যেও ক্ষুব্ধ ও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
বারহাট্টা উপজেলার সিংধা ইউনিয়নের সুবিধাভোগী কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহার ঘরের চাবি বুঝে পেলেও এখন পর্যন্ত ঘর বুঝে পাননি তারা। কারণ উল্লেখ করে তারা বলেন, ঘর নির্মাণ কাজ এখনও শেষ হয়নি।
এদিকে তারাসহ এলাকার অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নির্মাণাধীন উপহার ঘর নির্মাণে নিম্ন মানের ইট, বালু, কাঠ, টিন ও প্রয়োজনের তুলনায় সিমেন্ট কম ব্যবহার করা হচ্ছে। যার ফলে দেয়াল থেকে আস্তর ধসে পড়ছে। ভেঙ্গে পড়ছে দেয়াল ও পিলার। এ ছাড়াও সৌন্দর্যের জন্য দেয়ালে ব্যবহার করা রং একেবারেই নিম্ন মানের হওয়ায় রং লাগানোর পরপরই ফ্যাকাসে হয়ে সৌন্দর্য্য নষ্ট হয়ে বিশ্রী দেখাচ্ছে। সমান্তরাল স্থানে নির্মাণকৃত এসব ঘর কোনোটা উঁচু আবার কোনোটা অনেক নিচু হওয়ার কারণে বৃষ্টি হলে নিচু ঘরে পানি ঢুকে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯৫টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে এবং প্রতিটি ঘরের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০টি ঘরের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে এবং প্রতিটি ঘরের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ২ লক্ষ ৭৯ হাজার ৫০০ টাকা।
সূত্র আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অগ্রাধিকার প্রকল্প আশ্রয়ণ-২ এর আওতায় এই দুই অর্থবছরে বারহাট্টা উপজেলার মোট ১০৫টি ভূমিহীন পরিবারকে ২ শতাংশ খাস জমি বন্দোবস্ত দিয়ে একটি করে সেমি পাকা ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হবে। আর এ কাজের দেখভাল করছেন স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন। প্রকল্পের ঘর নির্মাণ বাস্তবায়নে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মাজহারুল ইসলাম এবং ঘর নির্মাণ কাজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করছেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা লতিফুর রহমান। তবে যারা ঘর নির্মাণ ও বণ্টনের দায়িত্বে আছেন তারা বিরুদ্ধেই উঠেছে অভিযোগ।
জানা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের নায়েবদের সহযোগিতায় প্রকৃত ভূমিহীনদের মাঝে সরকারি খাস জমির দলিল রেজিষ্ট্রি না করে দিয়ে জমি ও গৃহ আছে এমন স্বচ্ছ ব্যক্তিদের মাঝে ২ শতাংশ করে ভূমি রেজিষ্ট্রি করে দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এলাকাবাসীর ধারণা, কোনও লাভ ছাড়া তিনি এ কাজগুলো করেননি।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা লতিফুর রহমানের কাছে ঘর নির্মাণের ওয়ার্ক ওয়ার্ডার দেখতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, এ ব্যাপারে ইউএনও স্যারের সাথে কথা বলুন।
ঘর নির্মাণ কাজে অনিয়ম ও নিম্নমানের কাজ হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইতে প্রকল্পের সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেস্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে জানতে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মাইনুল হক কাসেমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভূমিহীনদের মাঝে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া উপহার ঘর নির্মাণে কোন রকম দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। যদি কেউ নিম্নমানের দ্রব্য সামগ্রী দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহার ঘর নির্মাণ করে সরকারের এই মহৎ উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে তাহলে তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে।
তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বাস্তবায়নে দুর্নীতি মুক্ত শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্টা করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন সোনার বাংলা বাস্তবায়িত হবে।
প্রসঙ্গত, গত ২৩ জানুয়ারি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এসব ঘর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে ভূমিহীনদের মাঝে এসব ঘর এখনো বুঝিয়ে দিতে পারেনি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি।