দুই নেতার পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে গোমর ফাঁস, বিব্রত আওয়ামী লীগ
বরগুনার বেতাগী উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে বক্তৃতাকালে উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতা ৭২ ওয়ার্ডে ৭২ লাখ টাকা উৎকোচ নেয়ার অভিযোগ আনেন। ওই অভিযোগ খন্ডন করতে গিয়ে বরগুনা সদর উপজেলাসহ আশাপশের বেশ কিছু উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতাদের পদ বানিজ্য, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ঘুস নেওয়া ও টাকা ছাড়া সালিসিও করেন না বলে মন্তব্য করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ।
ওই দুই নেতার এমন বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে এক পর্যায়ে তদন্ত কমিটি গঠন হয়। পরে বরগুনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বেতাগী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে আইনি নোটিশ পাঠান। এমনকি পার্শ্ববর্তী পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও বেতাগী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে আইনি নোটিশ পাঠান।
গত ৪ সেপ্টেম্বর বেতাগী পৌর অডিটোরিয়ামে আয়োজিত বেতাগী সদর ইউনিয়নের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে বেতাগী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বেতাগী উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মো. আমিরুল ইসলাম পিন্টু বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বলেন, বিএনপির কালচার এখন আওয়ামী লীগে ঢুকেছে। শুধুমাত্র উপজেলার একটি পৌরসভা ও ৭টি ইউনিটের ৭২টি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য ৭২ লাখ টাকার বানিজ্য হয়েছে। কমিটিতে পদ পাইয়ে দেওয়ার নামে সিনিয়র কিছু নেতা ৭২ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
পিন্টুর এমন মন্তব্যের জবাবে সম্মেলনে বেতাগী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাকসুদুর রহমান ফোরকান অভিযোগ খন্ডন করতে গিয়ে বলেন, বেতাগী উপজেলা আওয়ামী লীগ অতিতেও টাকার কাছে কোনো দিন বিক্রি হয় নাই। বর্তমান কমিটিও টাকার জন্য রাজনীতি করে না। পাশ্ববর্তী উপজেলায় খোঁজ নিয়ে দেখেন, মির্জাগঞ্জে গিয়ে দেখেন, কাঠালিয়ায় গিয়ে দেখেন, টাকা না দিলে নেতারা কোনো শালিসি পর্যন্ত করে না। টাকা ছাড়া কেউ কোনো জায়গায় রাজনীতি করতে পারে না। কোনো উপজেলায় যদি ১০ জন সভাপতি সেক্রেটারি প্রার্থী হয় তবে ১০ জনই শীর্ষ নেতাদের টাকা উপহার দিয়ে আসেন আশির্বাদ নেওয়ার জন্য। বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বরগুনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেয়ার জন্য ৩টা নাম পাঠিয়েছে। সেই তিনটা নামের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়েছে নেতারা।
৪ সেপ্টেম্বর আমিরুল ইসলাম পিন্টুর এমন বক্তব্যে পর ৭২ লাখ টাকার পদ বাণিজ্যের ঘটনায় গত ৬ সেপ্টেম্বর রাতে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে বেতাগী উপজেলা আওয়ামী লীগ। একইসঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম পিন্টুর বক্তব্যের ব্যাপারে প্রমাণ স্বাপেক্ষে, তথ্য উপাত্ত সহকারে সঠিক জবাব দিতে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়।
এমন বক্তব্যের কারন জানতে চাইলে বেতাগী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বেতাগী উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মো. আমিরুল ইসলাম পিন্টু জানান, একটি ওয়ার্ডের রাজনীতি করে একজন নেতা কি পায়? সেখানে যদি তার পদ পেতেই লাখ টাকা গুনতে হয়। আমার বক্তব্যে আমি যা বলার বলে দিয়েছি, আমি প্রমাণ ছাড়া কথা বলি না। এখন যদি সৎ সাহস থাকে তাহলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। আমি প্রমাণ দিয়ে সহায়তা করব।
একইভাবে বক্তব্যে পদ ও মনোনয়ন বানিজ্যের অভিযোগ আনায় বেতাগী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাকসুদুর রমহান ফোরকানের বিরুদ্ধে ৫০ কোটি টাকার মানহানির অভিযোগে আইনজীবীর মাধ্যমে ‘আইনি নোটিশ’ পাঠান বরগুনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শাহ মো. অলিউল্লাহ। গত ১২ সেপ্টেম্বর অলিউল্লাহ অলির আইনজীবী মো. আশ্রাফুল আলমের মাধ্যমে মাকসুদুর রহমান ফোরকানকে এ নোটিশ পাঠানো হয়।
নোটিশে উল্লেখ করা হয়, মাকসুদুর রহমান ফোরকান বক্তব্য দেওয়ার সময় গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নের জন্য যে তিনজনের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল সেখানে লাখ লাখ টাকা নিয়েছে বরগুনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ। এ ছাড়াও নির্বাচনি প্রচারণা সভায় বক্তব্য দিতে যাওয়া নেতাদেরও টাকা দিতে হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ ছাড়া এমন মন্তব্য কেন তিনি করেছেন এবং তার মন্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় বরগুনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অলিউল্লাহ অলির ৫০ কোটি টাকার মানহানি হয়েছে। নোটিশ প্রাপ্তির সাত দিনের মধ্যে সন্তোষজনক জবাব না দিলে বেতাগী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাকসুদুর রহমান ফোরকানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও নোটিশে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে একই বক্তব্যের কারণে ১৪ সেপ্টেম্বর পার্শ্ববর্তী পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন জুয়েল বেপারীও আইনজীবীর মাধ্যমে বেতাগী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাকসুদুর রমহান ফোরকানের বিরুদ্ধে ৫০ কোটি টাকার মানহানির অভিযোগে ‘আইনি নোটিশ’ পাঠান।
এ বিষয়ে জানতে বেতাগী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাকসুদুর রহমান ফোরকানের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তিনি লিগ্যাল নোটিশের কথা জেনেছেন। তিনি বিষয়টি লজ্জাজনক ও ভুল বোঝাবুঝি বলে দাবি করেন।
বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে আমাদের দলের এক নেতা দলীয় ৭২ লাখ টাকা ঘুস বানিজ্যের মিথ্যা অভিযোগ আনা প্রসঙ্গে আমি ওই কথা বলেছিলাম। এভাবে আমাদের কারোই বলা ঠিক হয়নি। আমরা বিষয়টি সাংগঠনিকভাবে সমঝোতা করে নেব।
এ ব্যাপারে বরগুনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ মুহাম্মদ অলিউল্লাহ অলি বলেন, বেতাগী উপজেলা আওয়ামী লীগের দুইজন নেতা যে মন্তব্য করেছেন এটা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা ছাড়া আর কিছু না। প্রমাণ ছাড়া এ ধরনের অযৌক্তিক মন্তব্য করা বিধিসম্মত নয়। আমি আইনি নোটিশ দিয়েছি। জবাব পাওয়ার পর আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।
এ বিষয়ে বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এসআইএইচ