মাইক্রোচালককে দায়ী করছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ, আটক গেটম্যান
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়ায় দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাসে ১৮ জন যাত্রী ছিলেন। এর মধ্যে ১১ জন নিহত ও আহত হয়েছেন ৫ জন। আহতরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠনের পাশাপাশি মাইক্রোচালককে দায়ী করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে গেটম্যান সাদ্দামকে আটক করেছে পুলিশ। দুর্ঘটনাস্থলের আশেপাশে মাইক্রোবাসের যন্ত্রাংশ, হতাহতদের কাপড়, জুতা পড়ে থাকতে দেখা যায়। ঘটনাস্থলে পুলিশ অবস্থান করছে।
মাইক্রোবাসের মধ্যে ৪ জন কোচিংয়ের শিক্ষক ও ১২ জন শিক্ষার্থী ছিলেন। বাকি দুইজন চালক ও হেল্পার।
নিহতদের মধ্যে ৪ জনের পরিচয় জানা যায়। তারা হলেন- হাটহাজারী উপজেলার জিয়াউর রহমান কলেজের শিক্ষার্থী আমান বাজার এলাকার মো. মহিউদ্দিন মনসুরের ছেলে মো. মাহিন (১৮), একই এলাকার আবদুর রহিমের ছেলে তানভীর হাসান (১৮), একই এলাকার জুনায়েদ হোসেন (১৮) ও হাটহাজারীর চিকনদন্ডী ইউনিয়নের হাজী মো. ইউসুফ আলীর ছেলে মাইক্রোবাসচালক গোলাম মোস্তফা নিরু (২৮)।
৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন
ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ আরোহী নিহতের ঘটনায় ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা আনসার আলীকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন- রেলের বিভাগীয় নির্বাহী প্রকৌশলী-১ আবদুল হামিদ, বিভাগীয় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (লোকো) জাহিদ হাসান, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ড্যান্ট রেজানুর রহমান ও বিভাগীয় মেডিকেল অফিসার (ডিএমও) মো. আনোয়ার হোসেন।
তদন্ত কমিটিকে আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের পরিবহন কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান।
মাইক্রোবাস চালককে দায়ী করছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ
ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ জন নিহতের ঘটনায় মাইক্রোবাস চালককে দায়ী করছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। যদিও দুর্ঘটনায় মাইক্রোবাস চালক নিহত হয়েছেন।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু জাফর মিঞা বলেন, লেভেল ক্রসিংয়ে সাদ্দাম নামে গেটম্যান দায়িত্বে ছিলেন। তার সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তিনি সময়মতো ক্রসিং বার ফেলেছিলেন। কিন্তু মাইক্রোবাস চালক সাদ্দামের কথা অমান্য করে বারটি তুলে রেললাইনে গাড়ি তুলে দেন। আর এতেই দুর্ঘটনা ঘটে।
আটক গেটম্যান
দুর্ঘটনার সময় লেভেল ক্রসিংয়ের গেট ফেলা হয়েছিল কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে এ নিয়ে সুস্পষ্ট কিছু জানা যায়নি। কারণ এ বিষয়ে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে। কেউ কেউ বলছেন, রেল ক্রসিংয়ে গেট ফেলা ছিল না। আবার অনেকেই বলছেন, গেট ফেলা ছিল। কিন্তু গেটম্যান ছিলেন না।
তবে এ ঘটনায় দায়িত্বরত গেটম্যান সাদ্দামকে আটক করেছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নাজিম উদ্দিন।
মাইক্রোবাসকে ১ কিলোমিটার ঠেলে নিয়ে যায় ট্রেনটি
এদিন দুপুর দেড়টার দিকে মিরসরাই উপজেলার খৈয়াছড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। মিরসরাইয়ে লেভেল ক্রসিংয়ে উঠে পড়া মাইক্রোবাসটিকে প্রায় ১ কিলোমিটার ঠেলে নিয়ে যায় মহানগর প্রভাতী ট্রেনটি।
দুর্ঘটনাকবলিত এলাকার আশেপাশে পড়ে আছে মাইক্রোবাসের যন্ত্রাংশ, ব্যাগ, কাপড়, জুতা
ট্রেনটি মাইক্রোবাসকে প্রায় ১ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে যায়। পুরো রেললাইন এলাকাজুড়ে চলে তাণ্ডব। দুর্ঘটনাস্থলের বিভিন্ন স্থানে পড়ে আছে মাইক্রোবাসের যন্ত্রাংশ, ব্যাগ, হতাহতদের কাপড়।
রেলের মানুষ বাঁশ ফেললে আমার ভাই মরত না
দুর্ঘটনার খবর ছড়িতে পড়ার পর শুক্রবার বেলা ৩টা থেকেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভিড় করতে থাকেন স্বজনরা। স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠে চমেক হাসপাতালের পরিবেশ।
নিহতদের একজন জিয়াউল হক সজিব। ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ বাবা মো. হামিদ। ছেলের কথা বলতে গিয়ে তিনি বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আশা ছিল ছেলে বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু আমার সেই আশা আর পূরণ হলো না। এখন আমাদের কী হবে? সজিবকে ছাড়া আমরা থাকব কীভাবে?
সজিব ২০১৮ সালে ওমরগণি এমইএস বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের গণিত বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু টাকার অভাবে তাকে দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি করাতে পারেনি তার পরিবার। সজিব তিন মাস আগে হাটহাজারী আমান বাজারে চালু করেন আর এন জে কোচিং সেন্টার। তিনি সেখানে শিক্ষকতা করতেন।
বাবা মো. হামিদের পাশেই ছিলেন সজিবের ছোট ভাই তৌসিফ। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ও ভাই, ভাই গো, তুই চলে আয়। ভাই যখন বেরিয়ে যায় তখন আমি ঘুমে। সে আমাকে অনেক আদর করত। সকালে আমাকে বলে, ভাই ভ্রমণে যাচ্ছি। এটাই তার সঙ্গে আমার শেষ কথা।
তিনি আরও বলেন, তখন রেলের লোক কোথায় ছিল? তারা বাঁশ ফেললে আমার ভাই মরত না। এমন দুর্ঘটনা ঘটত না। আমরা দোষীদের শাস্তি চাই।
যা বলল বেঁচে যাওয়া মাইক্রোযাত্রী হৃদয়
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ যাত্রী নিহত ও ৫ জন আহত হন। আহতদের একজন ছিলেন হাটহাজারীর কলেজছাত্র তানভীর হাসান হৃদয়। আমানবাজারের আর এন জে কোচিং সেন্টারে পড়তেন তিনি।
এই কোচিং সেন্টারই ভ্রমণের আয়োজন করে। ওই মাইক্রোবাসে চালকসহ ১৮ জন ছিলেন। হৃদয় বলেন, আমি তখন ঘুমিয়ে ছিলাম। কীভাবে কী হয়ে গেল তা বুঝে উঠতে পারিনি। ঘটনার পর অজ্ঞান ছিলাম।
গাড়িতে এত লাশ ছিল ভাবতেই পারিনি
ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী ট্রেনটিতে ভ্রমণ করছিলেন কণ্ঠশিল্পী জনি খোন্দকার। তিনি বলেন, টায়ার পোড়া গন্ধ পেয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি ট্রেনের নিচে একটি হাইস গাড়ি। ভেতরে কয়েকজন মানুষ নড়াচড়া করছিল। কাছে আসতেই একের পর এক লাশ দেখছি। ভাবতেই পারিনি গাড়িতে এত লাশ ছিল। শেষ পর্যন্ত ১১টি লাশ বের করা হয় গাড়ি থেকে।
এসজি/