মরে যাওয়া ভালবাসা
'হারানো নদীকে দেখেছেন? আমার জীবনটা ঠিক তেমনই। আমার অবয়বে ধারণ ক্ষমতা যথেষ্ট। কিন্তু তা পূর্ণতা পায়না জলের অভাবে। মরুভূমির অভিশাপ লেগেছে হয়তো। বীণা আপনি আমাকে আর দুঃখ দিয়েন না। আমি আপনার সাথে মিশতে চাই না। মৃত নদীর যৌবন ফিরে আসুক আমি তা চাইনা। সম্পর্কটাকে তুমিতে পরিণত করার আগ্রহ এই মুহুর্তে নেই। আমাকে রিপ্লে দেওয়ার দরকার নেই। ভালো থাকুন আপনি।'
বীণার মোবাইল স্ক্রিনে ক্রিং শব্দে এই মেসেজটিই ভেসে উঠলো। তাতে চোখ বুলাতেই ২ ফোটা অশ্রু অচমকা ফোনের স্ক্রিনটা ভিজিয়ে দিল।
আজ দু'বছর পর দীপুর সাথে তার দেখা। হালকা গড়নের ছেলেটির শরীরের মাংস ধরেছে। ভাঙা চোয়ালযুক্ত সুন্দর অবয়বে ভদ্রতার মিশ্রণ ঘটেছে। কাঁধে সাইড ব্যাগ ঝুলিয়ে হয়তো এয়াপোর্টের দিকে যাচ্ছিল। উত্তরা থেকে বীণা যে বাসটিতে উঠেছে সে বাসেই হঠাৎ তার সাথে চোখাচোখি। বাসে উঠবে কিনা তা নিয়ে দীপু যে কিছু একটা ভাবছিল তা তার চোখে পড়েছে। কিছুটা সংকোচ মনোভাবেই বাসে উঠলো সে। বলা যায় বাধ্য হয়েই।
বাস মিস করলে তার লেট হবে। এয়ারপোর্টের এই রাস্তার কাজ চলায় প্রত্যহ সে ৩০ মিনিট সময় হাতে করেই বেরোয়। আজ বাসে তেমন ভীড় নেই। যানজটের ভোগান্তি থেকে বাঁচতে অনেকেই হাঁটি পথ বেছে নিয়েছে। কিন্তু দীপুর ধুলোতে বড্ড এলার্জি।
সিট নির্বাচন করে বসতেই কপালে ছোট্ট টিপ আঁকা মসৃণ চেহারার বীণার গভীর চোখে দৃষ্টি যায় দীপুর। বাসের মৃদু চলনে উজাড় চুলগুলো সে দৃষ্টিকে আরও প্রগাঢ় করে তুলল। দুই বছর না দেখার ক্লান্তি যেন মুহুর্তেই বিলিন হয়ে গেল। পেছন ফিরে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকে অনুসরণ করছিল বীণা। দু'বছর পর রং চটকানো একটি বাসে দুজনের দেখা হবে, তা দু'জনের কেউই ভাবেনি। পাশের সিটে বসা মেয়েটিকে অনুরোধ জানিয়ে সিটটায় বসতে লজ্জাহীনভাবে আহ্বান জানাল বীণা।
কেমন আছেন? দীপু উর্ধ্ব নিশ্বাসে হতবিহ্বল সুরে জিজ্ঞেস করলো।
'তোমায় দেখে অনেক ভালো লাগছে, তুমি কেমন আছো, দীপু?'
'হ্যাঁ, ভালো আছি। এভাবে দেখা হবে কখনো কল্পনা করিনি'।
বীণা পরের শব্দগুলো গুছিয়ে নিতে পারছিল না। ঢাকার এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সে। কথাবার্তা এবং আচরণে আধুনিক ঢাকাই মেয়েদের মতোই তার কোন জড়তা নেই। কিন্তু দীপু, আজকে দীপু 'আপনি' বলে সম্বোধন করছে কেন? কত কঠিন ঝাঁজালো শব্দ, অথচ সম্মানের। বীণা কি আজ এই সম্মান প্রত্যাশা করেনি? ভাবতেই তার ভেতরটা কেদে উঠলো।
দীপু তার বড়, অন্তত শিক্ষার দিক দিয়ে।
২ বছর আগে রোজ এই ছেলের চেহেরাটা দেখতো হতো। বাহিরে বেরুতে বীণা প্রার্থনা করতো যেন তার সামনে না পড়তে হয়। কিন্তু সে বিপদের নিস্তার মিলতো না। সারাক্ষণ বীণার পিছু করাই যেন কাজ ছিল তার। বাসার সামনের গলিতে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেওয়া, গান গাওয়া আর হৈ হুল্লোড়ের মাধ্যমে ক্লান্ত করে বীণার এক দৃষ্টি প্রার্থনায় দিন কাঁটতো দীপুর। বিরক্ত হয়ে পরিবারকে জানালে আরও বেশি উদ্ভট হয়ে ওঠতো সে।
কিন্তু কোন এক ঝোড়ো হাওয়ায় হঠাৎই দীপুর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। তবে বীণার জীবনে তা বয়ে দেয় ফাল্গুনী হাওয়ার আনন্দ। দীপুর পাগলামির জন্য পরিবার থেকে নানবিধ নিষেধ মেনে চলতে হতো তাকে। হঠাৎ দীপুর শূন্যতা বীণার মনের এই উচ্ছ্বাসের কারণ। দীপুর কথা আর ভাবা হয়নি। না ভাবার মধ্যেই ২ টা বছর কেটে গেছে। দুই বসন্তে বীণার জীবনে বেশ কয়েকজন পুরুষের আগমন ঘটেছে। কিন্তু কোথাও সে প্রশান্তি পায়নি। দীপুর প্রস্তাবকে সে বার বার প্রেম করবে না বলে প্রত্যাখ্যান করতো। কিন্তু একসময় সে দীপুর শূন্যতা অনুভব করতে থাকে। মানসিক এই অস্থিরতাই তাকে একাধিক পুরুষের কাছাকাছি আনে। সেই অনুভূতি কেউ স্পর্শ করতে পারেনি। আজ দুই বছর পর যখন দীপুর সাথে তার দেখা, তখন সে অন্য এক দীপু। মনে হলো ছেলেটি তার কত কাছের, কিন্তু দীপুর কাছে সে এখন বনেদি ঘরের শ্রদ্ধেয় কোন মেয়ে।
'দীপু এখন কি করো?'
'এয়ারপোর্টে ছোটখাটো একটা জব করছি।'
'হঠাৎ কোথায় চলে গিয়েছিলে?'
এক দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে বীণা আবার জিজ্ঞেস করলো। দীপুর চোখ স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। ঠোঁটগুলো তবু অন্যায় ভাবে হাসছিল। উত্তরটি অনেক বড়। তবে দীপু আজ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখে গেছে। দুইটি শব্দে সে উত্তর দিল, 'জীবনকে দেখতে'।
এরপর আর কোন প্রশ্ন করা হয়নি বীণার। বাসের হেল্পারের জোর গলার আওয়াজে ব্যস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ওঠে দীপু। 'আমায় নামিয়ে দিন' বলেই চাপা সুরে সে বিদায় জানায় বীণাকে। তার কাছে আজ সময়ের কত মূল্য। বীণা ফোন নম্বরটা সেভ করে রাখে।
এমন দিন কল্পনাতেই কেবল ফিরে। বীণা আজ তার মনের দূর্বলতা বুঝতে পেরেছে। পরিবর্তন কত অদ্ভুত বিষয়। নিজের অজান্তেই কত পরিবর্তন ঘটে চারপাশে।
রাত ৯ টায় ঘুমানোর পূর্বে বীণা ছোট্ট এক মেসেজ দিল, 'খেয়েছো?'। দীপু তখন গাড়ির মধ্যে। চোখ বুলিয়ে ফোনটি আবারো পকেটে গুজে। বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে বীণাকে মেসেজ লিখে দীপু। ক্রিং শব্দে ভেসে ওঠে বীণার ফোনে। তাতে 'খেয়েছি' যুক্ত কোন বাক্য ছিল না। 'রিপ্লাই দেবার দরকার নেই' লাইনটি বীণাকে ফুপিয়ে কাদিয়ে তুললো। একাকী এমন বহুরাত নিঃসঙ্গ কল্পনায় ভবিষ্যৎ এঁকেছিল দীপু। স্বপ্নের সেই নারীকে নিয়ে হাজার বছর বাঁচার ইচ্ছে ছিল তার। বীণা জানতে পারে পৃথিবীতে দীপুর আপন বলতে আর এখন কেউ নেই।
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ডিএসএস/