রাধা, কৃষ্ণ কও
১৯৭১ সাল।
আগস্টের শেষের দিকে হবে। চারিদিকে বর্ষার পানি থৈথৈ করছে। একদিন বিকেলের দিকে নৌকা করে আমাদের বাড়িতে একজন পঞ্চাশার্ধো লোক আসে। লোকটি আমার বাবার পূর্ব পরিচিত। কিন্তু কেউ আমরা তাকে চিনিনা। আগে কখনও দেখিনিও।
লোকটি আমাদের বাহিরবাড়ির কাচারি ঘরে বসে বাবার সাথে কী যেন আলাপ আলোচনা করেন। আমরা কেউ সে কথা শুনতে পারিনি। লোকটি প্রায় ঘন্টাখানেক বাবার সাথে কথাবার্তা সেরে নৌকা করে আবার চলে যান।
লোকটি চলে যাবার পর বাড়ির ভিতর বাবা এসে মাকে বলেন - কাল একটি শরণার্থী পরিবার আমাদের বাড়িতে উঠবেন। তাকে আশ্রয় দিতে হবে। উনি খুব বিপদে আছেন। প্রত্যান্ত গ্রামে ওনার কোনো আত্মীয় স্বজন নেই। এর আগে অন্য একটি গ্রামে অন্য একটি বাড়িতে ওনারা কয়েক মাস ছিল। কিন্তু সেখানে থাকাটা নিরাপদ মনে করছেন না। তাই আমাদের বাড়িতে ওনারা হয়তো কটা মাস থাকবে।
বাবার মতামতের উপর কারোর কোনও দ্বিমত পোষণ করার ক্ষমতা নেই। আমাদের বাড়িতে বেশ কয়েকটি ঘর আছে । তারই একটি ঘরে ঐ পরিবারের থাকার ব্যবস্থা করা হয়।
পরের দিন সকালবেলা একটি ছইওয়ালা ছোট নৌকা করে ঐ ভদ্রলোক তার পরিবার নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে আসেন। সাথে ওনার স্ত্রী এক মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়েটির বয়স আঠারো ঊনিশ হবে। আর ছেলেটির বয়স আট নয়।
ভদ্রলোকের নাম শওকত হোসেন। সে নাকি মহুকুমা অফিসের একজন কেরানী। কিন্তু বাবা আমাদের তার পূর্ণ পরিচয়, পেশা, এগুলো সবার কাছে বলে বেড়াতে নিষেধ করলেন।
আমি তখন অষ্টম ক্লাসে পড়ি। নিতান্তই গ্রামের ছেলে। শহরে অত যেতাম না কখনও। শহরের কাউকে দেখলে একটু বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখতাম। যেমন বিস্ময় চোখে দেখেছিলাম ওনাদের। বিশেষ করে সাথে আসা মেয়েটিকে। মেয়েটি দেখতে কেমন যেন 'রূপ লাগি আঁখি ঝুরে', বেতস পাতার মতো কোমল মুখশ্রী। মায়াকাটা চোখ, নির্মোহ চাহনি। মার্জিত পরিধেয় পরনে।
ওনারা আসার সময় কোনও কিছু আনেনি। না কোনও বিছানা পত্তর, না কোনও হাড়ি পাতিল। আমার মা সবকিছু ব্যবস্থা করে দিলেন। বাবার সাথে শর্ত ছিল তারা নিজেরাই রান্নাবান্না করে খাবেন।
মেয়েটির নাম আলেয়া। শহরের গার্লস কলেজে ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। আমি ওনাকে আপু বলে ডাকি। আপু খাঁচায় করে একটি ময়না পাখি নিয়ে এসেছিল। এই পাখিটিকে সে খুব ভালোবাসে ও আদর করে। শহরের বাড়ি থেকে ওনারা যখন পালিয়ে গ্রামে আসে তখন আলেয়া আপু অন্য কিছু না আনলেও এই পাখিটিকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে।
একদিন আমি আপুকে বলি - পাখিটি কথা বলে না?
- বলে। কিন্তু পাখিটি অভিমান করেছে। সে এখন আর কথা বলে না।
- ও কী কখনও আর কথা বলবে না?
- বলবে একদিন।
- কবে?
- যেদিন দেশ স্বাধীন হবে সেই দিন।
ওনাদের ভিতর একটি রক্ষণশীলতা দেখতে পাই। আশেপাশে মানুষের সাথে খুব একটা মিশত না। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বেশি বের হতো না। শওকত চাচার স্ত্রী মার সাথে প্রয়োজনীয় সুবিধা অসুবিধার কথা ছাড়া বেশি কথা বলত না। শওকত চাচাও তাই। উনি একটি রেডিও এনেছিলেন সাথে করে। রেডিওটি কানের কাছে নিয়ে আস্তে আস্তে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনত। আর শুনত আকাশবাণী ও বিবিসির খবর। আর মাঝে মাঝে ভিতর বাড়ির বারান্দায় বসে বাবার সাথে গল্প গুজব করত। ওনারা কী কথা বলত আমরা তা শুনতে পেতাম না।
আলেয়া আপু আমাকে খুব পছন্দ করত। আমিও তাকে খুব পছন্দ করতাম। আমি তার চেয়ে প্রায় চার পাঁচ বছরের ছোট ছিলাম। আলেয়া আপু ছিল শহরের মেয়ে। কী সুন্দর করে কথা বলত। গুনগুন করে গান গাইত। আমি একদিন আপুকে বলি - তুমি গান গাইতে পারো?
- পারি।
- আমাকে একটি গান শোনাও না।
- আমি যে হারমোনিয়াম আনিনি। খালি গলায় শোনাতে হবে।
- খালি গলায়ই শোনাও।
আলেয়া আপু গাইছিল --
'গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে,
বলো কী হবে
জীবন পাতার ছিন্ন পাতায় শুধু
বেহিসাবে পড়ে রবে।'
আলেয়া আপু প্রায়ই আমাকে গান শোনাত। আমি গ্রামে থাকতাম । অনেক ভালো গান তখন কখনও শুনিনি, জানতাম না অনেক গানের কথা। মনে পড়ে একদিন কালি সন্ধ্যায় আলেয়া আপু বলেছিল, চলো পুকুর ধারে যাই। জলের শব্দ শুনব। জলের উপর দেখব চাঁদের ছায়া। আমি বললাম, পুকুর তো বন্যার জলে ভেসে গেছে।
তবুও চলো, দেখব।
সেদিন আকাশে উঠেছিল ত্রয়োদশী চাঁদ। সত্যি অপূর্ব জোছনায় ভাসছিল জল। কাঁঠাল গাছের গুড়িতে বসে আমরা জলছবি দেখি। আলেয়া আপু আবৃত্তি করছিল -
"কেন মিছে নক্ষত্রেরা আসে আর? কেন মিছে জেগে ওঠে নীলাভ আকাশ?
কেন চাঁদ ভেসে ওঠেঃ সোনার ময়ূরপঙ্খী অশ্বত্থের শাখার পিছনে?
কেন ধুলো সোঁদা গন্ধে ভরে ওঠে শিশিরের চুমো খেয়ে- গুচ্ছে গুচ্ছে ফুটে ওঠে কাশ?'"
আলেয়া আপু প্রতিদিন সকালে উঠে ময়না পাখিটিকে খাবার খাওয়াতো। হাতের আঁজলায় জল নিয়ে ময়নার ঠোঁট খুলে জল ঢেলে দিত মুখে। আমি আমাদের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতাম সেই দৃশ্য। কোনও কোনদিন কাছে গিয়ে বলতাম -
ময়নাটা কেমন কিচিরমিচির করছে। তোমার সাথে কথা বলতে চায়।
- ও বলবে না কথা। রাগ করেছে।
- রাগ ভাঙাও।
আমি বললাম, আমি যদি তোমার ময়না পাখি হতাম ঠিকই তোমার সাথে কথা বলতাম। কখনোই রাগ করতাম না!
আলেয়া আপু আমার থুতনিতে টোকা দিয়ে বলে-- ও আমার ময়না পাখিরে! তাই !
আমাদের বাড়িতে পিয়ারা গাছ ছিল। আমি কাঁচা ঢাসা পিয়ারা পেড়ে এনে আলেয়া আপুকে খেতে দিতাম। মাঝে মাঝে কাঁচা পিয়ারায় কামড় দিয়ে আপু বলত, এটি আমি খেতে পারছি না। এটি তুমি খাও।' আমাদের একটি জাম্বুরা গাছও ছিল। জাম্বুরা পাকলে ভিতরের কোয়া গুলো টকটকে গোলাপি রঙের হতো। আলেয়া আপু জাম্বুরার কোয়াগুলো খেয়ে ঠোঁট ও জিহবা গোলাপি রঙ করে ফেলত। আমি বিস্ময় চোখে তাকিয়ে দেখতাম তা। আলেয়া আপু বলত - আমার ঠোঁট তোমার ভালো লাগছে! বলতাম, হ্যাঁ।
আলেয়া আপু বলে - তুমিও কী রাঙাবে তোমার ঠোঁট? এস, রাঙিয়ে দিই।
আর একদিন বিকালবেলা বাবাকে বলে নৌকায় করে ধনিদহ বিলে আমি আলেয়া আপু ও আলেয়া আপুর ছোট ভাই আদিব শাপলা আর কলমীলতা দেখতে যাই। নৌকা বাইছিল আমাদের বাড়ির কৃষি কর্মী সমীর আলী। দিগন্ত জুড়ে পানি থৈথৈ করছে। উপরে নীল আকাশ। সমীর আলীর বৈঠার শব্দে পানি ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হচ্ছে। গাংচিল উড়ছে আকাশে। আমাদের নৌকা বিলের শাপলা ফুলের ভিতর দিয়ে চলছিল। আলেয়া আপু শাপলা ফুল ছিঁড়ছিল আর জল ছুঁইছিল দুহাত দিয়ে। কী অদ্ভুত করে নেমে আসছিল সেদিন সন্ধ্যা। আলেয়া আপু আমাকে ডাক দেয় - রঞ্জন!
বললাম - জ্বি।
- এখন তো গানের সময়! গান শুনবে না?
- শুনব, গাও।
আলেয়া আপু খালি কণ্ঠে গাইতে থাকে --
এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়
একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু
কোন রক্তিম পলাশের স্বপ্ন
মোর অন্তরে ছড়ালে গো বন্ধু!
....…
বাতাসের কথা সে-তো কথা নয়
রুপকথা ঝরে তার বাঁশিতে
আমাদেরও মুখে কোন কথা নেই
শুধু দু'টি আঁখি ভরে রাখি হাসিতে।
আলেয়া আপুর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমিও তার সাথে গাইছিলাম --
'কিছু পরে দূরে তারা জ্বলবে
হয়ত তখন তুমি বলবে
জানি মালা কেন গলে পড়ালে গো বন্ধু।'
দেখতে দেখতে দুই আড়াই মাস চলে যায়। দিনে দিনেই যুদ্ধের মোড় বদলাতে থাকে। বন্যার পানি সরে গিয়ে চরাচর জাগতে থাকে। মনে হচ্ছিল বিজয় আসতে এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। মন প্রফুল্ল হওয়ার পাশাপাশি মনটা বিষাদেও জড়াচ্ছিল খুব । মন বলছিল - এই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে আলেয়া আপু'রাও শহরে চলে যাবে। কতদূর সেই শহর!
আমি আর আলেয়া আপু দুজন ইতোমধ্যে খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠি। কত খুনসুটি, কত লেনদেন। কত কথা বলতাম চাঁদনি রাতে উঠোনে শীতল পাটিতে বসে। আলেয়া আপু গুনগুন করে সুর তুলত -- 'আকাশে ঐ মিটিমিটি তারার সাথে কইব কথা, নাইবা তুমি শুনলে।' যদিও অসম বয়স ছিল আমাদের। বিজয় ধেয়ে আসছে ভেবে মনবীণার তারে কেমন যেন টান লাগতে থাকে। মনে হচ্ছিল এই তার বুঝি ছিঁড়ে যাবে যে কোনও দিন, যে কোনও ক্ষণে।
সেদিন ছিল হেমন্তের সন্ধ্যা। আমাদের কুসুমপুর গ্রাম ছিল গাছপালায় আশ্চর্য ছায়াছন্ন। প্রসন্ন নির্জনতায় আঁধার নেমে আসছিল তখন। বাড়ির পূর্বদিকে পুকুরপাড়। ঠিক তার পিছনটায় বাঁশ ঝাড়। রাত্রি আগমনের পদধ্বনি বাজছিল পাখিদের গানে। বুলবুলি, দোয়েল, হাঁড়িচাচা শিস দিচ্ছিল। আমি আর আলেয়া আপু হাঁটছিলাম বাঁশবনের পথে। পায়ের স্পর্শ লেগে শুকনো পাতাগুলো মর্মর করে শব্দ হচ্ছিল। দুজনেই নিশ্চুপ ছিলাম কিছুক্ষণ। আমি কম্পিত স্বরে আলেয়া আপুকে ডাকি - আপু।
- কী!
- তুমি চলে গেলে আমি খুব কাঁদব।
- পাগল ছেলে, কাঁদবে কেন?
আলেয়া আপু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। গভীর মমতায় আলিঙ্গনাবদ্ধ করে রাখে অনেকক্ষণ।
সেই সজলঘন নির্জনতায় বুকের সঙ্গে বুক জড়িয়ে নিবিড় গাঢ় স্বরে আপু বলে -- 'তুমি কী আমাকে ভালোবাসো?'
- হ্যাঁ, আপু। তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
- এখনও তুমি অনেক ছোট। এত ছোট বয়সে বড়ো করে ভালোবাসতে নেই। কষ্ট পাবে। তোমার স্পর্শ বুকে নিয়ে কেবল বয়ে বেড়ানো যায়। অন্য কিছু না। তুমি আরও বড়ো হও। বড়ো হয়ে যেদিন আমায় অনেক ভালোবাসা দিতে পারবে সেদিন আমি নিজেই উন্মুখ হয়ে আমার সবকিছু তোমাকে দিয়ে দেবো।
অবশেষে চলে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ!
১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ইং, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বারবার ঘোষণা হচ্ছিল --
'পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশি যৌথ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে, পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সব সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। "
বিজয়ের সেই ক্ষণে কুসুমপুর গ্রামের মানুষেরা আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ে। জয়বাংলা শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠতে থাকে। রেডিওতে গান বাজতে থাকে -"পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্তলাল রক্তলাল! প্রলয় এসেছে কোন্ সমুদ্রে রক্তলাল রক্তলাল" 'জয় বাংলা বাংলার জয়।"
তখন অপরাহ্ন সময়। আলেয়া আপু রেডিওতে ঘোষণা শুনে দৌড়ে ঘরের ভিতর চলে যায়। ভিতর থেকে ময়না পাখির খাঁচাটি উঠোনে নিয়ে আসে। তা ধিন্ ধিনের মতো নেচে নেচে ময়না পাখিকে সে বলে - "রাধা, কৃষ্ণ কও।"
ময়না পাখিও বলে ওঠে - "রাধা, কৃষ্ণ কও।"
আলেয়া আপু'রা ছিল হিন্দু পরিবার৷ এই কথা বাবা ছাড়া কেউ জানত না।
আলেয়া আপু'রা আরও দুই দিন আমাদের বাড়িতে ছিল। যেদিন আপু'রা চলে যাবে সেদিন সকালবেলা একটি ঘোড়ার গাড়ি এসে আমাদের বাড়ির পাশে এসে থামে। দেখলাম - শওকত চাচার পরনে সাদা ধূতি ও পাঞ্জাবি। চাচীমার সিঁথিতে সিঁদুর। আলেয়া আপু পরেছে লাল সবুজ সালোয়ার কামিজ। ওনারা সবাই টমটমে গিয়ে উঠে। যাবার সময় আলেয়া আপু আমাকে কাছে ডেকে বলে -' তুমি তোমার এই জয়ন্তী দিদিকে কখনও ভুলে যাবে না।'
জয়ন্তী দিদি'রা চলে যাবার তিনমাস পর বাবা একদিন শহরে যান। মহুকুমা অফিসের সেরেস্তায় গিয়ে জানতে পারেন - শ্রী সুবিমল রায় ( শওকত চাচা) বদলি হয়ে চলে গেছেন দূরের অন্য আর এক শহরে।
এরপর কত বছর চলে গেছে। এরপর কতদিন, কত রাত্রির উপরে চুপিসারে আমার দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়েছে। মহাকালের ললাটে অশ্রুবিন্দুও ঝরেছে অনেক। অস্ফুট করে জয়ন্তী দিদিকে কতো ডেকেছি বেদনা মর্মর মুহূর্তে। বলেছি - 'দিদি, আমি কত বড়ো হয়ে বুড়ো হয়ে গেলাম। কই, তুমি উন্মুখ হয়ে আমাকে আর ভালোবাসা দিতে এলে না তো।'
ডিএসএস/