" জিয়নকাঠি "
ছেঁড়া অংশটা চুপটি করে মিলিয়ে গেল লুঙ্গির সুবঙ্কিম ভাঁজে। ভোরের মোলায়েম আলো পঙ্কিল প্রান্তর ছুঁয়ে দেখবার আগেই রাজহাঁসের মতো নিঃশব্দে মিলিয়ে পড়ে বাবা। একপায়ি থামে না, বাবাকে নিয়ে এগিয়ে চলে সন্তর্পণে। বহুদূর যায় একপায়ি। ওপারে গিয়ে জিরোয়। তীর্থের কাকের মতো অপলক চেয়ে থাকে ও। ওপারে ডানাকাটা নধরদেহী রাঙা মেঘেদের বাসা। বাবা কি তাহলে সকাল সকাল মেঘের বাড়ি যায়? ও ঠিক বুঝে না। তবে ফেরার সময় বাবার নিয়ে আসা হাওয়াই মিঠাইগুলোকে ওর কাছে মনে হয় রঞ্জিত বন্দী আপের মতো। রাতে ও মজা করে আপ খায় আর নিপুণ চাঁদ ও মেঘেদের সাথে কথা বলে বেড়ায়। ও ভাবে বাবা হয়তো আকাশ থেকে আপ পেড়ে আনে ওর জন্যে। তাই হয়তো রাতের আকাশে সাদা মেঘগুলোকে আর দেখা যায় না। সাদা মেঘকে ও বলে উড্ডীন আপ। ওর খুব ভালো লাগে আপ খেতে। খুব মিষ্টি, তুলোর মতো নরম; মুখে দিলেই হাওয়া।
শন শন শন হাওয়ায় উড়ে পাল। ময়ূরের মতো পেখম তুলে ঢেউয়ের চূড়ায় নেচে নেচে চলে একপায়ি। বাবার পালতোলা ছই নৌকোকে ও বলে একপায়ি। এক পা দিয়েই পানিতে হেঁটে বেড়ায় ও। সেগুন কাঠের কালামুখো বৈঠাই ওর পা। রাই দিঘির নির্মল জলের বুক কুড়িয়ে ও জলজ শাপলা তুলে আনে। শাপলা ফুলকে ও বলে কেউকেটা মরা সাপ। আর মরা সাপ দিয়েই যত্নকরে বাবার জন্য কণ্ঠমালা গেঁথে রাখে। গলদঘর্ম শরীরে বাড়ি ফিরতেই বাবার গলা জড়িয়ে ধরে টুপ করে পড়িয়ে দেয় শাপলার মালাটা। বাবার মুখ চুইয়ে পড়ে মুগ্ধতার লুকনো হাসি। ওদেরকে দেখে মৃদু হাসে আকাশের চাঁদ।
পাখির মতো কিচিরমিচির ভাষায় কথা বলে ও। রাতে ওকে আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দেয় বাবা। মাঝেমধ্যে খুব বকেও দেয়। দুপুরে ঠিকমতো ভাত মুখে তুলে না। একেবারে ধান শালিকের মতো চিকনা হয়ে গেছে। মা'কে ও দেখেনি। অবশ্য তাতে ওর দুঃখ নেই। ও বলে, " আমার মা এবং বাবা, দুইডাই তুমি আব্বা। " নিজ হাতে ইলিশ মাছ বেছে খেতে পারে না ও। বাবা কাটা বেছে দিলে তবেই মুখে তুলে। এক নলা বাবার মুখে পুড়ে দিয়ে বলে, " হুদা আমারেই খাওয়াইবা, তুমিও খাও আব্বা।" প্রতিদিন বাবার জন্য বৈছা পুড়ে রাখে ও। বাবা আসলেই লাল লাল বৈছা দিয়ে বলে, " তোমার লইগ্যা পুইড়া রাখছি আব্বা। নেও খাও। " বাবা যখন জিজ্ঞেস করে, " কইত্তে পাইসস বৈছা? " ও হাসিমুখে বলে, " রাই দিঘির জলে ওড়না দিয়া ধরছি আব্বা। " ছোটছোট চিংড়ি মাছের দলকে ও বলে বৈছা মাছ। ইলিশ এবং বৈছা ওর খুব প্রিয়, বাবার ও।
আমের থোকা থোকা বোল গুলো বড় হয়ে গেছে। বাতাসে সুমিষ্টঘ্রাণ। সাদা পায়রা পাখা মেলে হাওয়া খায় আকাশে। ও পায়রাকে বাবার কথা জিজ্ঞেস করে। পায়রাও ডানা ঝাপটিয়ে উত্তর দেয় কথার।
বাবা চলে গেলে তিন্নির সাথে ধাপ্পা খেলে ও। সাদা, সাদা নুড়ি পাথর দিয়ে খুব দ্রুত ধাপ্পা খেলতে পারে। তিন্নি বলে, ও নাকি ধাপ্পা খেলার রাণী। সেবার ধাপ্পা খেলতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল কুন্তি। বাবা কাঁদতে কাঁদতে নিঃশেষ করে ফেলেছে চোখের জল। এ গায়ে ডাক্তার নেই। বড় নৌকায় করে ওপারে নিয়ে গিয়েছিল বাবা। অনেক দূরের নদীপথ। নীল পানির বিশাল জমিন। কিন্তু ফিরে আসার পর বাবাকে খুব বকেছে ও। ডাক্তার চিকিৎসা দেওয়ার সময় ও অজ্ঞানই ছিল। গায়ে আসতেই ও চোখ মেলে তাকায়। আর তাতেই মন খারাপ করে বসে পড়ে। বাবা ওকে মেঘের বাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আসলো না কেন! সেজন্য খুব হেঁড়ে হয়েছিল ও। সেদিন খুব কেঁদেছিল বাবা। কিন্তু কুন্তি জানে না সেকথা।
বাবা ওকে ডাকে কুন্তি বুড়ি বলে। এগারো বছরের বাক্যবাগীশ মেয়ে কুন্তি। রাই দিঘির সাথে জমপেশ আড্ডা মারে ও। মেঘের সাথেও ভাব জমেছে ওর। ও কথা বলে জুনিপোকার সাথে। জুনিপোকাকে ও বলে মাডির তারা। আকাশে যেমন তারা মিটমিট জ্বলে, মাডিতে জ্বলে জুনিপোকা। প্লবগ ঘাসফড়িং আর কুতকুতে পানকৌড়ির সাথে গত বর্ষায় সই পেতেছিল ও। গত ঈদে ওর জন্যে বাবা খয়েরি রঙের ফ্রক এনেছিল। কতটাই না খুশি হয়েছিল কুন্তি। সেদিন ওর খুশি দেখে কে! বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, " আমার আব্বা সবাইর সেরা আব্বা। " এদিকে দু'বছরের পুরনো সেই নীল লুঙ্গিটা আজও বাবার অঙ্গে শোভা পায়। লুঙ্গির ছেঁড়া অংশগুলোকে কিভাবে ভাঁজের মধ্যে লুকিয়ে ফেলতে হয়, তা বোধহয় বাবার চেয়ে ভালো কেউ জানে না।
একদিন বালিহাঁস খেতে চেয়েছিল কুন্তি। নদীর মাঝ থেকে এক ডুবে বালিহাঁস ধরে এনেছিল বাবা। রাজহাঁসের সাথে খুব বেশি জমে না ওর। রাজহাঁসকে ও বাবার ভয় দেখিয়ে বলে, " আর কোনদিন ঠোকর দিলে, আব্বারে দিয়া মাইর খাওয়ামু তোরে। " হস্তিমূর্খ রাজহাঁসও খুব ভয় পায় ওকে। ওর ধারে কাছেও আসে না আর। বাবা আম খায় না অথচ আম নাকি তার খুব প্রিয়। বাবাকে ও জোর করে আম খাওয়ায়, তা-ও একটার বেশি মুখে তুলে না। কিন্তু কুন্তি কি কখনো জানতে পারবে কাঁচামিঠা গাছের আম ওর খুব প্রিয় বলেই, মুখে তুলে না বাবা?
টনটন গাড়ি খুব পছন্দ ওর। গত দুদিন ধরে বাবার সাথে একটা কথাও বলে না ও। কতবার করে বাবাকে বলেছে পিঙ্গল রঙের টনটন গাড়িটা আনতে, তবুও আনে না বাবা। এ গায়ে টনটন গাড়ি পাওয়া যায় না। প্রধান বাড়ির মেয়ে রিনুর হাতে টনটন গাড়ি দেখে, ওর মনেও টনটন গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধ জাগে। কি সুন্দর নহবতের শব্দ করে সে গাড়ি- টন টনা টন টন। কিন্তু বাবা ওর জন্য টনটন গাড়ি আনে না। খুব দামি যে। কিন্তু ও বুঝে না। ওর টনটন গাড়ি চাই তো চাই। ওপারে নিমতলি বাজারে টনটন গাড়ি পাওয়া যায়। নিমতলি বাজার অনেক দূরের পথ। কিন্তু বাবার কাছে টাকা নেই যে। তবুও বাবা ওকে নিরাশ করে না। তিনদিন পর বাবা ঠিকই নিয়ে আসে টনটন গাড়ি। টনটন গাড়ি পেয়ে ও খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরে বাবাকে। আর বলে, " আমার আব্বা ভালা, আমার আব্বা ভালা। " কিন্তু পরক্ষণেই বাবার হাতে চোখ পড়তেই হেঁড়ে হয়ে উঠে ওর মনটা। ও কথা বলে না বাবার সাথে। বাবা ওকে বুকে টেনে নিয়ে বলে, " কি অইছে মা? তুই খুশি হছ নাই? " " তুমি আংটি বেইচা আমার লইগ্যা টনটন গাড়ি কেন আনছ আব্বা? তুমি কি মনে করছ আমি বুঝি না! " " আনটি দিয়া কি করমু রে মা, আমার কুন্তি বুড়ির মুহে আসি না থাকলে! " " আমারে তুমি এ-তো কেন ভালোবাস গো আব্বা! " " মাইয়ারে ভালোবাসমু না তো কারে বাসমু। " ও খাইয়ে দেয় বাবাকে। আর গল্প জুড়ে দেয় সারারাত ভর। বাবাও গল্প শুনে হাসে আর ঘুম পাড়িয়ে দেয় ওকে।
ও ঘুমিয়ে পড়ে, সাথে বাবাও। সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখে বাবা নেই। কাজে চলে গেছে। শ্রাবণের মেদুর বিকেলে আকাশপটে রংধনু দেখে ও অভিভূত হয়। রংধনুকে ও বলে, সাতরঙা ট্যাংড়া লাইন, ঠিক মনিবুবুর চোখের মতো ত্যারচা। মনিবুবু খুব আদর করে ওকে। মনিবুবু ওর চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। ওকে কাঁচা আম খেতে দেয়, নৌকায় করে ঘুরতে নিয়ে যায়। মনিবুবুর সাথে ও মাছ ধরতেও বের হয়। কখনো বা শালুক তুলে আনে। একবার শালুক তুলতে গিয়ে পায়ে খুব ব্যথা পেয়েছিল কুন্তি। তাই বাবা ওকে আর শালুক তুলতে দেয় না। তবুও লুকিয়ে লুকিয়ে মনিবুবুর সাথে ও শালুক তুলতে যায়। মনিবুবুকে বলে, " আব্বারে কইয়ো না মনিবুবু, এই তোমার পায়ে পরি, কানে ধরি। "
সেদিন আম পাড়তে গিয়ে পিছল গাছের উপর থেকে পড়ে বুকে খুব ব্যথা পায় ও। বাবা ওকে আম গাছে উঠতে বারবার মানা করেছে। কিন্তু ও শুনে না বাবার কথা। এদিকে বাবা জানেও না সেকথা। জানতে পারলে খুব বকবে হয়তো। তাই ও বাবাকে কিছু বলে না। সকাল থেকে আকাশের অবস্থাটাও ভালো না। ঝড় আসতে পারে যেকোন সময়। রেডিওতে শুনেছে ঝড় নাকি দুর্নমিতভাবে ধেয়ে আসছে মেঘের বাড়ি চিঁড়ে। সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আর ঝড়ো বাতাসের প্রকোপ। বাবাও কাজে যায়নি আজকে। ঝড়ের সময় এপার থেকে ওপারে নৌকা চলে না।
বিকেলে হঠাৎই রক্তবমি শুরু করে কুন্তি।
ছোটবেলায় বুকে খুব ব্যথা পেয়েছিল একবার। গাছ থেকে পড়ে গিয়ে আবারও সেখানটায় মারাত্মক ব্যথা পেয়েছে। বমির সাথে সাথে কাতর কণ্ঠে ও বলে উঠে, " আমার খুব কষ্ট অইতাছে আব্বা। মইরা যামু আমি। আমি মইরা যামু। কষ্ট আর সহ্য অয় না আব্বা। " ঝড়ের সাথে সাথে বাড়ছে কুন্তির আর্ত অসহায় চিৎকারও। ঝড়ের শব্দে নির্বাপিত হচ্ছে ওর আর্তনাদ। ভয় পেয়ে যায় বাবা। কি করবে এই দমকা ঝড়ের সময়। বাবা আযান দিতে থাকে খুব জোরে জোরে। পাশের বাড়ির মল্লিক চাচা কত বাঁধা দিলো, এই ঝড়ের সময় ওপারে যাইস না। কিছুখনের মাঝেই সুস্থ হয়ে উঠবে ও। কিন্তু কথা শুনে না বাবা। মেয়ের আর্ত চিৎকার আর সহ্য হয় না তার। ঝড় কিছুটা কমতেই বৃষ্টিকে বিদীর্ণ করে মেয়েকে নৌকায় তুলে বেড়িয়ে পড়ে শহরের উদ্দেশ্যে। ওপারেই শহর, ডাক্তার আছে বড়বড়। ডাক্তারের কাছে গেলেই সুস্থ হয়ে উঠবে কুন্তি। কুন্তির মুখ চুইয়ে রক্ত পড়ছে অঝোরে। মাঝপথে আবারও শুরু হয় তীব্র ঝড়। ঝড়ের বিপরীতে বৈঠা দিয়ে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে নৌকা বাইতে থাকে বাবা। আর আল্লাহ, আল্লাহ করতে করতে বলে, " এইতো মা, আর কতক্ষণ, এরপরই ডাক্তারের কাছে যাইতাছি। ভালা হইয়া যাবি মা, ভালা হইয়া যাবি। " কিন্তু কুন্তির ব্যথা কমে না; কমে না ঝড়ও। ঝড়ের বেগের সাথে বাবা একা পারে না কিন্তু হারও মানে না।
কোনমতে নৌকা নিয়ে ওপারে চলে আসে বাবা। বাবার হাত পা ফুলে গেছে সর্বশক্তি দিয়ে দাঁড় টানতে টানতে। অভুক্ত শরীরে দুইঘণ্টা নৌকা চালিয়ে এপারে ডাক্তারের কাছে নিয়ে এসেছে মেয়েকে। ঝড় কমে গেছে আগের চেয়ে। কুন্তিকে কোলে নিয়ে ডাক্তারখানায় নিতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে ও। বাবা ডাক্তারের পায়ে পড়ে বলতে থাকে, " আমার মাইয়া রে বাঁচান ডাক্তার সাহেব, আমার মাইয়া রে বাঁচান। " কিছুক্ষণ পর ডাক্তার ফিরে এসে বলে, তাড়াতাড়ি ও পজিটিভ রক্তের প্রয়োজন। বাবা এবং মেয়ের রক্তের গ্রুপ একই। ক্লান্ত শরীরেই রক্ত দিতে উদ্যত হয় বাবা। কিন্তু ডাক্তার বলে উঠে, " এরকম পরিশ্রান্ত শরীরে রক্ত দেওয়া আপনার জন্য মারাত্মক বিপদজনক। " কিন্তু পাগল হয়ে গেছে বাবা। তার মুখে একটাই কথা, " আমার মাইয়ারে বাঁচান। আমার মাইয়ারে বাঁচান। " ডাক্তারের কথা অমান্য করেই অভুক্ত শরীরে দুই ব্যাগ রক্ত দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে বাবা। রক্ত দেওয়ার ঘণ্টা খানেক পর চোখ মেলে তাকায় কুন্তি। কিন্তু আসেপাশে তাকিয়ে দেখে বাবা নেই। ও বাবাকে খুঁজতে থাকে অবিশ্রান্তভাবে। পাশের রুমে নিভৃতে বাবাকে শুয়ে থাকতে দেখে ও কাঁদতে থাকে হাউমাউ করে আর বলতে থাকে, " কতা কও আব্বা, কতা কও আব্বা। " কিন্তু কথা বলে না বাবা। পশ্চিম দিগন্তের মেঘগুলো মিলিয়ে পড়ছে কাঁদতে কাঁদতে, দিগন্তে আলোক সমারোহ ক্রমশ সংকোচিত হচ্ছে; নামছে চির আঁধার। উঁচু তালগাছগুলোর মাথায় সূর্যের আলো চিকচিক করে ডুবে গেলো। বিরান আকাশের মেঘ চিঁড়ে ওঠার সময় কাঁদতে কাঁদতে সায়ংকালীন চাঁদ বলে উঠে, " মেয়ের জীবনের তরে নিজের জীবনকে বানাইলো যে নৌকার লাঠি, জীবনের বিনিময়ে জীবন দিয়া মেয়েরে দিয়া গেলো জিয়নকাঠি! "
শিক্ষার্থী, পশুপালন অনুষদ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ-২২০২
ডিএসএস/