আই লাভ ইউ
চ্যাটিং এ প্রাপ্ত ঠিকানা আর মোবাইল নম্বর সম্বল করে বিকেল তিন-সাড়ে তিনটার সময় তনুকার স্কুলের সামনে এসে পৌঁছেছে তমাল। পাশের টি স্টলে বসে স্কুল প্রাঙ্গণের সবকিছু লক্ষ্য করছিল খুঁটে খুঁটে।
চারটার কিছু সময় পরে দোকানের কর্মচারী ছেলেটা বলে উঠল,
-ওই যে তনুকা ম্যাডাম আসছে, আজ বোধহয় বকেয়া টাকাগুলো দিয়ে যাবে।
হাতে ধরা চায়ের কাপ থেকে ছলকে পড়ল কিছুটা চা তমাল তালুকদারের কাপ থেকে। উৎসাহী চোখে চেয়ে দেখল- দীর্ঘাঙ্গী,শ্যামলা, হালকা পাতলা তনুকা, হেঁটে আসছে স্কুলের মাঠ পেরিয়ে গেটের দিকে। পরনে তার উজ্জ্বল নীল রঙের শাড়ি, সাদারঙের ফুলহাতা ব্লাউজ, ঘনকালো লম্বা চুল বারবার ডিস্টার্ব করছে। উড়ে এসে গালে, চোখে মুখে পড়ছে আর তনুকা বিরক্তির সাথে বাম হাতের চম্পক আঙুলে সরিয়ে দিচ্ছে।
তমাল তালুকদার ভাবছে, বয়স কমপক্ষে পঁয়ত্রিশ আপ হবে, অথচ ফেসবুক প্রোফাইলে লিখেছে ২৫ বছর। প্রোফাইল ছবিটাও অন্তত পাঁচ কি সাত বছর আগেকার।
আনমনে হাসল তমাল তালুকদার! সে-ও কী আর কম করেছে! সেও তো তার প্রোফাইল পিক দিয়েছে দশ বছর আগের চেহারার! দেখলে মনে হবে নায়ক উত্তম কুমার।
বয়স লিখেছে সাঁইত্রিশ, অথচ এখন তার বয়স সাতচল্লিশ।
বয়সটাই প্রায় শেষ করে ফেলল সে যাত্রা থিয়েটার আর গান-বাজনা করে করে। বাপের রেখে যাওয়া সম্পত্তির প্রায় অর্ধেক শেষ করেছে এসবের পেছনে।
এখনো থানা সদরে তিনটে বাড়ি, পাঁচটা দোকান ঘর, ভাড়া দিয়েছে। গ্রামের জমিজমা কন্ট্রাক্ট আছে গ্রামের কিছু লোকের কাছে, প্রতি আবাদ মৌসুমে বেশ মোটা টাকা আসে সেখান থেকে। বাড়ি ভাড়া, দোকান ভাড়া উঠে প্রায় লাখ খানেকের মতো।
এ যাবৎ শ'খানেকবার প্রেমে পড়েছে সে, অথচ কী দুর্ভাগ্য! একটি প্রেমও স্থায়ী হয়নি তার। প্রায় বাধ্য হয়েই ব্যাচেলর হয়ে আছে আজও।
বছর তিনেক হলো ফেসবুকে পরিচয় তনুকার সাথে। পরিচয় থেকে প্রেম। যদিও জানে সে, যে-ইনবক্সে প্রেম করা আর ট্রেনের চাকায় পাম্প করা একই কথা। তবুও তনুকার ডাকে আর স্থির থাকতে পারেনি তার দীর্ঘ বছরের উপবাসী মন।
সুদূর রংপুর থেকে ছুটে এসেছে আজ ঢাকায়। রহস্যপ্রিয় তমাল রহস্য করতেই প্রায় ছুটে এসেছে কোনো পূর্বাভাস না দিয়েই। ভাবনা শেষে চমকে উঠল তমাল তালুকদার। দেখল, তনুকা টি-স্টলে না ঢুকে হন হন করে হেঁটে যাচ্ছে শাহবাগ বাসস্ট্যান্ডের দিকে। চট করে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরল সেও তনুকার উদ্দেশে।
ততক্ষণে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেছে তনুকা। একবার ভাবল, ফোন করে জানিয়ে দেয় যে, সে এসেছে। কিন্তু রহস্যপ্রিয় মন তাতে সায় দিল না। তাড়াহুড়ো করে সেও হাঁটা ধরল তনুকার পেছন পেছন।
ততক্ষণে অনেক দূর এগিয়ে গেছে তনুকা। শাহবাগ বাস্ট্যান্ডে গিয়ে থামল তনুকা, তার থেকে গজ দশেক পেছনে তমাল, ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে প্রায়। হঠাৎ একটা লোকাল বাস এসে পড়ায় সেটাতে উঠে পড়ল তনুকা।
ধড়াস করে উঠল তমালের হৃৎপিণ্ড, এই বোধহয় হারালাম! ছুটে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া বাসের হ্যান্ডল চেপে ধরে ঝুলতে থাকল, তারপরে কোনোমতে উঠে পড়ল বাসে। সন্ধানী দৃষ্টিতে খুঁজল মহিলা সিটে। না! নেই সে! দাঁড়ানো লোকজনের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেল বাসের বামধারে পুরুষ সিটে বসে আছে তনুকা।
মুখোমুখি দুটি সিটে দুজন করে চারজন প্যাসেঞ্জার, তারমধ্যে তনুকাই একমাত্র নারী। তার সামনের সিটে মুখোমুখি প্যাসেঞ্জার দুজনের একজন কিশোর, বড় জোর ক্লাস এইট/নাইনে পড়তে পারে। দাঁড়ানো লোকজনের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে ঠেলেঠুলে কোনো মতে ওই সিটের কাছে গিয়ে অভিনয় শুরু করল সে।
-বাবাজি, একটু জায়গা পাওয়া যাবে? আমার কোমরে ব্যথা (ল্যম্বেগো)। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে নিষেধ করেছেন ডাক্তার।
বিনয়ের অবতার ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-বসুন আঙ্কেল, আমি তো সামনের স্টপেজেই নেমে যাচ্ছি।
ছেলেটির মাথায় হাত দিয়ে মিছেমিছি দোয়া করল পাক্কা অভিনেতা তমাল তালুকদার। তারপর ধুপ করে বসে পড়ল তনুকার মুখোমুখি হয়ে।
যাক বাবা বাঁচা গেল! আর পালাতে পারবে না, মনে মনে স্বগতোক্তি করল সে।
পরের স্টপেজে কিশোর ছেলেটাসহ বাকি দুজন পুরুষও নেমে গেলে, তনুকাই প্রথমে কথা বলল-
-আপনি কোনখানে নামবেন?
-আগে বল "আই লাভ ইউ" তারপরে বলছি কোথায় নামব,
হাসতে হাসতে বলল তমাল তালুকদার।
কথাটা শুনে ধমকে উঠল পয়ত্রিশোর্ধ্ব ব্যাচেলর বুড়ি,
- কী ! এতবড় স্পর্ধা! আপনি আমাকে লাভ ইউ বলতে বলছেন!
মিটি মিটি হাসছে চল্লিশোর্ধ বুড়ো এবং একটা চুইংগাম দিতে গেল অগ্নিমূর্তিধারী বয়স্কা সুন্দরীকে। আবার জ্বলে উঠল বিগতযৌবনা নারী,
-আমি কচি খুকি না কি, যে চুইংগাম খাব?
- এ বয়সে যেমন চুইংগাম চোষা মানায় না,
লাভ ইউ বলাও তেমনি শোভা পায় না, তাই না ডার্লিং? হাসতে হাসতে বললেন বয়স্ক ভদ্রলোক।
আবার ক্ষেপে উঠল বিগতযৌবনা।
-কী! আপনি আমাকে ডার্লিং বল্লেন? জানেন আমি কে?
-জানি তো তুমি তনুকা, প্রাইমারি স্কুলের টিচার? এখনো অবিবাহিত, ঠিক আমার মতো।
বিস্ময়াভূত তনুকা!
-কীভাবে জানলেন আমি অবিবাহিত!
-হাহাহা, হাহাহা, দাদরা তাল এর ছয় মাত্রার হাসি দিয়ে বললেন বয়স্ক লোক,
-ফেসবুক চ্যাটিং এ তো তুমিই বলেছিলে গো!
-তারমানে! কে আপনি?
কিচ্ছু বলছে না লোকটা, মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে, হাতে ধরা মোবাইল ফোনে ডায়াল করল। রিং টোন বেজে উঠল তনুকার ফোনে-
তুমি সুন্দরো যদি নাহি হও, তাই বলে কিবা যায় আসে? প্রেমের কী রূপ সেই জানে, সেই জানে, ও গো যে কখনো ভালবাসে-এ-এ-এ, যে কখনো ভালোবাসে।
রিং টোনের গানটা শেষ না হতেই রিসিভ করে হ্যালো বলল সে। উত্তরে মুখোমুখি বসা নির্লজ্জ লোকটার কণ্ঠে ভেসে এল,
-ইয়েস তনুকা, আই লাভ ইউ।
ঝট করে সুইচ অফ করে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল তনুকা
-তুমিই তমাল!
মিষ্টি হাসির সাথে সম্মুখে হ্যাঁ-বোধক মাথা দোলাচ্ছে বয়স্ক তমাল তালুকদার।
আনন্দাতিশয্যে কাঁপতে কাঁপতে ঝট করে উঠে পড়ে, ধ্বপ করে বসে পড়ল তনুকা তমালের পাশে। কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে গেল আবেগাতিশয্যে, তবুও কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
-তুমি এত দুষ্টু কেন! আই লাভ ইউ।
হাতের ব্রিফকেস খুলে প্যাক করা একগুচ্ছ সাদা গোলাপ বের করে, তনুকার দিকে বাড়িয়ে ধরল তমাল। কাঁপা কাঁপা হাতে পুষ্পগুচ্ছ নিয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে উচ্চারণ করল তনুকা,
-থ্যাঙ্ক ইউ।
দু'চোখের কোণে তার আনন্দাশ্রু, শীতের শিশির বিন্দুর মতো চিক চিক করে নাচছে।
প্রকাশ চন্দ্র রায়: কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী।
এসএন