আমরা রাজনীতির কবি হিসেবে দেখি বঙ্গবন্ধুকে
৭ই মার্চের ভাষণ মূলত বঙ্গবন্ধুর কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। পহেলা মার্চ ১৯৭১এ পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান দুপুরের পরপরই বেতার ভাষণে হঠাৎ করেই ঘোষণা দেন, আগামী ৩ তারিখ থেকে পাকিস্তানের যে জরুরি অধিবেশন বসার কথা ছিল, সেটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হলো। ৩রা মার্চ যে অধিবেশন বসবে সেটি আগে থেকেই বলা ছিল। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে পার্লামেন্টের বাইরে বোর্ডের সভা করবেন ১ তারিখে হোটেল পূর্বাণী ইন্টারন্যাশনাল এ। সেভাবেই পরিকল্পনা করা আছে। কাজেই ১ তারিখের ঘোষণার সাথে সাথেই ঢাকা শহর মিছিলের ও প্রতিবাদের শহরে রূপান্তরিত হয়ে গেল। সবার মুখেই একই শ্লোগান ‘বীর বাঙ্গালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ সেইসময় প্রায় তিনশ সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সভা এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে পরিণত হলো। বঙ্গবন্ধু আসলেন। জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করা হলো, এখন আপনি কি করতে যাচ্ছেন?
বঙ্গবন্ধু স্বভাবসুলভভাবেই বললেন, আগামীকাল ঢাকা শহরে হরতাল কর্মসূচি এবং আগামী পরশু সারাদেশে শহরে হরতাল কর্মসূচি পালন করছি। আগামী ৭ তারিখে জনগণের সামনে আমি আমার পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবো। ৭ তারিখে রেসকোর্সের ময়দানে বিশাল জনসভা প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতি। ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা খুবই সীমিত। কাজেই ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে বোঝা যায়, ঢাকা শহরের কোন বাড়িতে পুরুষ কোন সদস্য ঘরে বসে ছিলেন না। সবাই উপস্থিত হয়ে অপেক্ষা করছিলেন এটি দেখতে যে, বঙ্গবন্ধু কি বলেন? বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি শাসক গোষ্ঠীর নির্যাতন নিপীড়ন অত্যাচারের ইতিহাস তুলে ধরলেন এবং তাঁর পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করলেন।
এই ভাষণের মূল কথাটি হলো, পাকিস্তানের একটি অংশের বিলুপ্তি, এবং বিশ্বের বুকে নতুন একটি দেশের অভ্যুদয়। তিনি দেখছেন যে, একটি দেশের অংশ মানচিত্র থেকে শেষ হয়ে যাবে,আরেকটি নতুন দেশের জন্মলাভ হবে। সেখানে দাঁড়িয়ে যে ভাষায় যেভাবে কথা বলতে হয়, সেই ভাষায় কথা বললেন বঙ্গবন্ধু। কারণ আপোষের কোন সুযোগ ছিল না। তবে বঙ্গবন্ধুর আপোষহীনতা যেমন ছিল, তেমনি কতটা মানবিক ছিলেন যে, তিনি শত্রুকে বলেছেন, তোমরা আমার ভাই। চিন্তা করা যায় না যে শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন সেই তাদেরকে আবার বলছেন, তোমরা আমাদের ভাই। তোমরা ব্যারাকে ফিরে যাও। তোমরা আমার মানুষের বুকে গুলি করো না। এরকমই ছিল বঙ্গবন্ধুর মানবিক দিক। নব নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে জাতীয় সংসদে তাঁর শপথ নেওয়া হলো না, তিনি ৩রা জানুয়ারি জনগণকে সাক্ষী নিয়ে জনগণের সামনে শপথ নিলেন। সেখানেই তিনি বললেন যে, সংগ্রাম শেষ হয়নি। সংগ্রাম কেবল শুরু হতে যাচ্ছে। সেই মেসেজটিই তিনি দিলেন। তোমরা ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। যার যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাক। এবং আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি, তোমরা এই কাজগুলি করবে। হয়ত তিনি বুঝতে পারছিলেন,সময় বেশি বাকি নেই। এটিই হয়তো শেষ সুযোগ। জনগণের সাথে সরাসরি কথা বলার জন্য।
আমরা রাজনীতির কবি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে দেখি। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পরে তাকে নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সাময়িকী প্রচ্ছদ করেছিল যেখানে বঙ্গবন্ধুকে poet of politics বা রাজনীতির কবি হিসেবে অভিহিত করা হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ১০ লাখ মানুষের সাথে কথা বলেছেন। এরা সকলেই সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতিনিধি, তাদের সাথে কথোপথন করেছেন। জনগণের কথাই বঙ্গবন্ধুর নিজের কথায় প্রতিফলিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর কথায় ৫টি প্রশ্ন ছিল যেগুলি প্রকৃতপক্ষে মানুষেরই কথা। কি পেলাম আমরা? কাদের সাথে বসব? কিসের আর টি সি?
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমার মানুষের পয়সায় যে গোলাবারুদ কেনা হয়, সেটা আমার মানুষের বুকের উপর পড়ে। তাদের সাথে বসব? বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন সেই সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ভাষণ চলা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু খবর পেলেন সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আপনারা বাঙালি কর্মকর্তা যারা আছেন, তারা বেরিয়ে আসেন। সবাই বঙ্গবন্ধুর কথায় বেরিয়ে আসলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তখন শিরোধার্য।
পরবর্তীতে ২৫শে মার্চের কালোরাত্রিতে বর্বর পাকিস্তানি যখন নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেই মুহূর্তে তিনি ঘোষণা করেন, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। এটিই হচ্ছে আইনগত আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা। তারপর সাড়ে সাত কোটি মানুষ অটল পাহাড়ের মতো ঐক্যবদ্ধ থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। শত্রু কবল মুক্ত হয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে? একজন মানুষের দীর্ঘ সংগ্রামের ফল আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রচণ্ডভাবে এক বিশ্বাসযোগ্য শক্তি এবং এই শক্তির কারণেই আমরা ৭ই মার্চের ভাষণ দেখেছি। আমরা দেখেছি জাতির পিতার সাথে সমগ্র জাতির মনের বন্ধন, যেটির শুভ সূচনা হয়েছিল ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।