ওজোন স্তরে ফাটল ধরেছে
যদিও বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি, কিন্তু অভিযোগ রয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের জনগণের খাদ্যাভ্যাসের কারণে সমগ্র বিশ্বে অতিমারী (কোভিড-১৯) ছড়িয়ে পড়েছে। যার ফলে বিশ্ববাসীকে নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে ২০২০ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত। প্রাণঘাতী এই ভাইরাস বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে যেমন, তেমনি বিশ্ব অর্থনীতিকে পর্যুদস্ত করে দিয়েছে। কবে নাগাদ সেই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবে বিশ্ববাসী তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। যদিও ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন প্রয়োগ চলছে বিশ্বের জনগণের মাঝে, তথাপিও বিশ্ববাসী এখনও নিরাপদ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্পষ্ট জানিয়েছে, করোনা বা কোভিড-১৯ বিশ্ব থেকে শিগগিরই বিতাড়িত হচ্ছে না। তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়িয়েছে। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বিশ্বে থেকেই যাচ্ছে। প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, তবে কি চীনের জনগণের ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে এখন বিশ্ববাসীকে? আবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, চীনের ‘ভাইরাস ব্যাংক’ থেকে কোভিড-১৯ ছড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলে থাকেন বাদুড় থেকে কোভিড-১৯ ছড়িয়েছে। সেক্ষেত্রেও স্থানটি চীনেরই একটি প্রদেশের কথা বলা হয়েছে। যদিও অভিযোগগুলো এখনো প্রমাণিত হয়নি, আবার অভিযোগের ভিত্তি নেই সে কথাও বলা যাবে না। কারণ প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের উৎপত্তি চীন থেকেই এটা সত্যি। কীভাবে ছড়িয়েছে তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অভিযোগের তীর চীনের দিকেই তাক করানো আছে। সেই অভিযোগটির রেশ কাটতে না কাটতেই চীন আরেকটি অভিযোগের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। হালে চীন ক্লোরোফ্লুরো কার্বন বা সিএফসি উৎপাদন করে পৃথিবীর ছাদে ফাটল ধরাচ্ছে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াতে বসানো এয়ার মনিটরিং স্টেশনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। চীনের এই অগ্রাহ্য মনোভাব মানবজাতি তথা সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য এক অশনিসঙ্কেত বলে মনে করছি আমরা। সেই বিষয়েই অর্থাৎ সিএফসি গ্যাস উৎপাদনের কুফল নিয়ে আলোকপাত করছি এখন। তার আগে আমরা জেনে নেই পৃথিবীর ছাদ সম্পর্কে, যেটি ওজোন গ্যাস বা ওজোনস্তর নামে পরিচিত।
ওজোন গ্যাস সম্পর্কে সর্ব সাধারণের খুব একটা ধারণা নেই। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত এমন মানুষও বিষয়টি নিয়ে হ-য-ব-র-ল পাকিয়ে ফেলেন। লাজ-লজ্জ্বার কারণে বিষয়টি কারো কাছে জেনে নিতেও পারছেন না। এছাড়াও অধিকাংশ মানুষ বিষয়টির বিপরীত বোঝেন। যেমন, ‘ওজোন দিবস’ সামনে এলে মানুষের মনে প্রশ্নবিদ্ধ হয়, কোন ধরনের ওজোনকে বুঝানো হচ্ছে? পরিমাপ নাকি অন্য কিছু! তাই ‘ওজোন’ সম্পর্কে বিস্তারিত জানানোর প্রয়োজন বোধ করছি আমরা। তাতে কিছুটা হলেও স্বচ্ছ ধারণা পাবেন পাঠক। বিষয়টি সম্পর্কে আলোকপাতের আগে শব্দটার বাংলা বানানের পার্থক্য ও অর্থ জানিয়ে দিচ্ছি আমরা। যেমন- বাংলা শব্দ ‘ওজন’ হচ্ছে পরিমাপ, আর ইংরেজী শব্দ ‘ওজোন’ হচ্ছে একধরনের গ্যাসের নাম, যার অবস্থান বায়ুমণ্ডলের ১৫-৩০ কিলোমিটার (মতান্তরে ২৫-৫০ কিলোমিটার) উচ্চতায়। ওজোনস্তর তীব্র গন্ধযুক্ত হালকা নীল বর্ণের গ্যাসীয় পদার্থ। এটি ক্ষতিকর গ্যাস হলেও পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে। ফলে বলা যায়, এটি হচ্ছে প্রকৃতির পর্দা বা পৃথিবীর ছাদ। যে পর্দা বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে অথবা ভূপৃষ্ঠে বিকিরণ ঘটাতে বাধা সৃষ্টি করে। সোজাকথা, ওজোনস্তর হচ্ছে পৃথিবীর ফিল্টার। সূর্যের প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে ছেঁকে বিশুদ্ধ করে পৃথিবীর জন্য ১০-৪২ (কমবেশি হতে পারে) ডিগ্রি সেলসিয়াস পাঠায়। যা আমাদের কাছে সুষম তাপমাত্রা হিসেবে পরিচিত।
আমরা জানি, সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত অতিবেগুনি তেজস্ক্রিয় রশ্মি পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। এই রশ্মি ওজোন গ্যাসের কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বা ওজোন গ্যাস তেজস্ক্রিয় রশ্মি শোষণ করে নেওয়ার ফলে ভূপৃষ্ঠের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। ফলে জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় থাকে এবং ক্ষতিকর রোগ থেকে মানুষ মুক্তি পায়। বিশেষ করে সূর্যের তেজস্ক্রিয় রশ্মি ওজোন গ্যাস শোষণ করে নেওয়ায় ত্বক ক্যান্সার ও চোখের রোগ থেকে মুক্তি মিলে। সেই প্রকৃতির রক্ষাকবচ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আজ। বিশেষ করে ভূপৃষ্ঠে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহারের কারণে ওজোনস্তর ক্ষয়ে যাচ্ছে। তবে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ‘সিএফসি’ (এ গ্যাস বিভিন্ন ধরনের স্প্রে, এয়ারকন্ডিশনের যন্ত্র এবং রেফ্রিজারেটরে বেশি থাকে) গ্যাসের বহুল ব্যবহারের কারণে ওজোনস্তর দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে। এতে বড় ধরনের গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে ওজোনস্তরে। সেই গর্ত গলে তেজস্ক্রিয় রশ্মি ভূপৃষ্টে নেমে আসছে। বলে নেয়া ভালো, ওজোনস্তরের পুরুত্ব খুব বেশি নয়। মৌসুমভেদে ও ভৌগলিক কারণে এই পুরুত্বের পরিমাণ কমবেশি হয়।
ওজোনস্তরের পুরুত্ব পাতলা হয়ে দক্ষিণ মেরুতে এন্টার্কটিকার ওপরে বিশাল গতের্র সৃষ্টি করেছে, যে গর্তের আয়তন প্রায় ৪০ লাখ বর্গকিলোমিটার। সুখবর হচ্ছে, সেই গর্ত ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে আসছিল বিশ্ববাসীর সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে। অথবা বলা যায়, পরিবেশবিদদের আন্দোলনের ফলে বিশ্ববাসী সচেতন হয়েছেন। সেই সচেতনার মধ্যেও চীন পুনরায় ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে। যার ফলে সঙ্কুচিত হয়ে আসা ওজোনস্তরে ফাটল ধরাচ্ছে চীনের উৎপাদিত ক্লোরোফ্লুরো কার্বন বা সিএফসি গ্যাস।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট