রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট
বাংলাদেশের আগাম পরিকল্পনা নিয়ে রাখতে হবে
গত কয়েকদিনের বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে মূলত ইউক্রেন-রাশিয়ার সামরিক অভিযানই প্রধান খবর হিসেবে উঠে এসেছে। শুধু খবর নয়, এটি সারা বিশ্বের জন্য চিন্তা এবং ধাক্কার সৃষ্টি করেছে। চিন্তার কারণ হলো–অনেকদিন ধরে বিশ্বযুদ্ধ নেই। এখন আবার নতুন করে যুদ্ধ বা সংঘাতের আলামত আমরা দেখতে পাচ্ছি।
গত চার দিন আগে রাশিয়া তিন দিক থেকে ইউক্রেন আক্রমণ করে। এই আক্রমণের প্রেক্ষাপট নতুন নয়। ২০১৪ সালে প্রথম রাশিয়া ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে দেশটিতে সামরিক হস্তক্ষেপ করে। যে কারণে ইউক্রেনের জনগণ খুব ভালো করেই জানতেন যে, ইউক্রেনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ পরেও থাকবে।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যে ১৩টি রাষ্ট্রের জন্ম হয়, ইউক্রেন তাদেরই একটি। রাশিয়া চাচ্ছিল, ন্যাটো যেন ইউক্রেনে না আসে। তারা এটাই বলছিল যে, তাদের এমন একটি প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, ইউক্রেন ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত হবে না। রাশিয়ার দাবি, এটি তাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি। কাজেই এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাশিয়ানরা আগে থেকেই ইউক্রেনের বিরুদ্ধচারণ করে এসেছে।
আবার এখন ন্যাটোর যে কাঠামো আছে তাতে, যে কোনো দেশকে নেওয়ার ক্ষমতা ন্যাটোর আছে। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়াকে লিখিতভাবে অঙ্গীকার দেওয়ার সুযোগ তাদের নেই। যে কারণে রুশ-মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যকার বৈঠকে ফলপ্রসূ কিছু হয়নি। তারই ফলশ্রুতিতে রাশিয়ানরা ইউক্রেন আক্রমণ করে বসেছে। আজকের ঘটনাটি তারই বহিঃপ্রকাশ।
এখন যেটি হচ্ছে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার অজুহাতে যে কোনো দেশ যে কোনো কিছু করতে পারে–এই ধারণার পরিবর্তন হচ্ছে না। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের পরাজয়ের প্রেক্ষাপট ছিল এ রকমই। আমরা দেখলাম, নাগরিক অধিকার রক্ষার যে ব্যাপারগুলো নিয়ে একটি চিন্তাভাবনা চলছিল, সেখানে আজকের ঘটনাটি একটি বড় ধরনের হুমকি। ছোট দেশকে বড়রা আক্রমণ থেকে শুরু করে শোষণ করে–এটি অনেকদিন ধরে চলে আসা একটি রীতি। গতকাল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে। যদিও রাশিয়া ভেটো দেওয়ার ফলে তা গৃহীত হয়নি।
ইউক্রেনের উপর হামলার জের ধরে এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপানসহ একাধিক দেশ রাশিয়ার উপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যার বেশিরভাগই অর্থনৈতিক। এ সংকটের প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর। তেলের দাম বাড়ছে, সেটারও একটা প্রভাব ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর পড়বে। এই যুদ্ধের প্রভাবে এর মধ্যেই বাড়তে শুরু করেছে জ্বালানি তেলের দাম।
দ্রুত সমাধান না হলে এই সংকটের বড় প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর। বিশেষ করে জ্বালানি ও খাদ্য পণ্যের দাম বাড়লে তার প্রভাব সব ক্ষেত্রেই পড়ে। যে কোনো অবরোধ যখন দেয়া হয়, সেটার মাত্রাটা ব্যাপক হলে বাংলাদেশ কেন, সারা বিশ্বের জন্যই একটা চিন্তার ব্যাপার হয়ে যায়। আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে তো চিন্তার কারণ আছেই, প্রভাবটা কতো ব্যাপক হবে, সেটা নির্ভর করবে এই সংকট কতদিন ধরে চলে, তার উপর। যদি নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে সেটার মাত্রা বাড়তেই থাকবে। পক্ষ-বিপক্ষের প্রশ্ন আসবে। তখন তা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যার কারণ হয়ে উঠবে।
একটা যুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন তা বহুমুখী সমস্যার সৃষ্টি করে। সেটা শুধু সেই দুটি দেশ বা জোটের মধ্যে থাকে না, প্রত্যেকেই আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশের উপর কী বা কতটা প্রভাব পড়তে যাচ্ছে, তা হয়তো এখনো পরিষ্কার নয়। পরাশক্তিগুলোর বিরোধে বাংলাদেশ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য এখনই সতর্ক হতে হবে।
আমাদের এক ধরনের নিরপেক্ষতা ধরে রাখতে হবে। আমরা কোনো পক্ষ নেব না। তবে যুক্তরাষ্ট্র কড়া নিষেধাজ্ঞা দিলে সেটা আমাদের মেনে নিতে হবে, সেটা লঙ্ঘন করার উপায় আমাদের নেই। রাশিয়াও সেটা বুঝবে। ফলে আমাদের দেখতে হবে, সেই নিষেধাজ্ঞা না ভেঙে, রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের যে ব্যবসা-বাণিজ্য আছে, বিশেষ করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যাপারে–সেটা কীভাবে আমরা অব্যাহত রাখতে পারি, সেই চেষ্টা করতে হবে।
খুব তাড়াতাড়ি হয়তো রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের বড় প্রভাব বাংলাদেশে দৃশ্যমান হবে না; কিন্তু এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে, রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞার আওতা আরও বাড়লে বাংলাদেশ কী করবে, বাংলাদেশকে সেই আগাম পরিকল্পনা এখনই নিয়ে রাখতে হবে।
লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত
এসএ/