সম্ভব হলে বিদেশি ঋণ না নেয়াই শ্রেয়
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ১৮-২০ ফেব্রুয়ারি জার্মানির মিউনিখে অনুষ্ঠিত ৫৮তম মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। কোভিড-১৯ মহামারীর বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে এই বছরের সম্মেলনটি সীমিত পরিসরে অনুষ্ঠিত হলেও মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন সঙ্কট নিয়ে আলোচনার আধিপত্যই লক্ষ্য করা গেছে। ১৯৬৩ সাল থেকে প্রতিবছর মিউনিখে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নীতিকে কেন্দ্র করে এই সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ইতোমধ্যেই ইহা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নীতি-নির্ধারকদের মতামত বিনিময়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নিরপেক্ষ ফোরাম হয়ে উঠেছে।
১৯ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ‘ইন্দো-প্যাসিফিকে আঞ্চলিক ব্যবস্থা ও নিরাপত্তায় বড় পরিবর্তন’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় অংশ নেওয়ার সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে, বাংলাদেশের অবকাঠামোর ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে চীন ‘আগ্রাসী এবং সাশ্রয়ী’ প্রস্তাবসহ 'টাকার ঝুড়ি’ নিয়ে এগিয়ে এসেছে যখন অনেক দেশের সাহায্যই কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশে চলমান উন্নয়ন প্রক্রিয়ার, বিশেষ করে অবকাঠামোগত উন্নয়নের, কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন যে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে আরও তহবিল প্রয়োজন। তবে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে নানা শর্ত যোগ করার ফলে তা গ্রহণ করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্কর যথার্থই বলেছেন যে প্রতিটি দেশ সুযোগের খোঁজ করবে এবং তারা কী করতে পারে তা দেখবে। তিনি বলেন, "দেশগুলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের স্বার্থের ব্যাপারে বিচক্ষণ হতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, তারা আসলে কী পেতে যাচ্ছে। আমাদের অঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানে আমরা ঋণে জর্জরিত দেশ দেখতে পাচ্ছি। আমরা এমন প্রকল্প দেখেছি যেখানে বাণিজ্যিকভাবে টেকসই নয় এমন বিমানবন্দর নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানে ফ্লাইট আসে না। আমরা এমন পোতাশ্রয় নির্মাণ হতে দেখছি, যেখানে জাহাজ ভেড়ে না। তাই আমি মনে করি, কী পাচ্ছি, তা নিজেকে জিজ্ঞেস করাটা ন্যায়সংগত হবে।”
যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে কোয়াড সদস্য দেশগুলোতে, চীনা ঋণের টোপ নিয়ে বিতর্ক চলছে হয়তো সেই প্রেক্ষিতে মন্ত্রী মহোদয় উপরের কথাগুলো বলার তাগিদ অনুভব করেছেন। হয়তো তিনি চীনের নাম উল্লেখ করেছেন এ কারণে যে চীন বাংলাদেশের অনেক প্রকল্পের অর্থায়নেই জড়িত। এদিকে দুদিন আগে, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জানানো হয় যে চীন নিজস্ব অর্থে চট্টগ্রামে মেট্রোরেল নির্মাণ করতে চায় এবং বিনিময়ে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে চীন বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের উপকূলে একটি স্মার্ট শহর তৈরি করবে। তবে চীন ছাড়াও বেশ কিছু দেশ ও সংস্থা রয়েছে যারা আমাদের উন্নয়ন সহযোগী।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং জাইকা থেকে যথেষ্ট পরিমানে ঋণ নিয়েছে। আমাদের অর্থনৈতিক অঞ্চলে বা অন্যান্য বেসরকারি স্থানেও বেশ কয়েকটি খাতে আমাদের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে।
দেশে আরও অবকাঠামোগত সুবিধার চাহিদার কথা উল্লেখ করে মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কিন্তু আমাদের কাছে টাকা নেই। আমাদের কাছে প্রযুক্তিও নেই।’ নিঃসন্দেহে, আমরা বিদেশি ঋণ, বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তিকে স্বাগত জানাই। কিন্তু এখন আমরা আর ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নই। আমরা গর্ব করে বলতে পারি যে, আমরা পদ্মা সেতুর মতো একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি এবং তা আমাদের নিজস্ব অর্থেই সম্পন্ন করতে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের বন্ধ দৃষ্টি উন্মোচন করে দেখিয়েছেন ‘আমরাও পারি’। ইহাই হতে পারে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমাদের সমস্ত মিথস্ক্রিয়া এবং লেনদেনের অনুপ্রেরণা।
ইহা সত্য যে বাংলাদেশের এখনও অবকাঠামোগত নেটওয়ার্ক, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থানের সুযোগ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সুবিধা, সুশাসন ইত্যাদিসহ সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য যথেষ্ট নিজস্ব তহবিল নেই, যদিও তার নিজস্ব তহবিল থেকে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং আগামীতে নিজেদের অর্থেই দেশের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। ততদিন পর্যন্ত অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশও তার সার্বিক উন্নয়নের জন্য বিদেশি ঋণ গ্রহণ বা বিদেশি বিনিয়োগকে অভ্যর্থনা না জানিয়ে পারবে না। তবে বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদেরকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।
২০১৯ সালের মার্চ মাসে ‘ডেইলি সান’ পত্রিকায় আমি আমার লেখায় কয়েকটি দেশে চীনা ঋণ দ্বারা অর্থায়ন করা কিছু প্রকল্পের কথা উল্লেখ করেছিলাম। সেসব প্রকল্প শুধু অর্থনৈতিকভাবে অনুপযুক্তই ছিল না, বরং সেসব দেশের জন্য ঋণের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোর চীনা ঋণে নির্মিত দুটি বিমানবন্দর ঋণ পরিশোধ করতে না পারার কারণে সংশ্লিষ্ট চীনা কোম্পানির মালিকানায় চলে যায়। চীন কলম্বোতে ইক্যুইটির জন্য কঠিন ঋণের ব্যবস্থা করতে বাধ্য করেছে, উদাহরণস্বরূপ হাম্বানটোটা বন্দরের অপারেশনাল নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া। একটি চীনা রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ৯৯ বছরের জন্য সেই বন্দরটি ইজারা নেয়। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। পাকিস্তান অবকাঠামো নির্মাণ কর্মসূচির জন্য চীনের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে এবং তা পরিশোধ করা খুবই কঠিন হবে। আমরা লাওস এবং কম্বোডিয়ায় এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতি দেখতে পাচ্ছি। কিরগিজস্তান, আফগানিস্তান, মালদ্বীপ, মঙ্গোলিয়া এবং তাজিকিস্তানের মতো আরও অনেক দেশে বিদেশি ঋণের সম্ভাব্য হুমকি উপেক্ষা করা যায় না। আমাদের প্রতিবেশী মিয়ানমারে চীনা ঋণের ভবিষ্যৎ যে ব্যতিক্রম কিছু ঘটাবে মনে হয় না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, ২০২১ সালের জুন মাসে আমাদের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের জিডিপির ২২ শতাংশের সমতুল্য। দুই বছর আগে ঋণের সঙ্গে জিডিপি অনুপাত ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ থাকলেও করোনা মহামারির কারণে তা অনেকটাই বেড়ে গেছে। এই প্রেক্ষাপটে উল্লেখ করা যায় যে, বাংলাদেশে চলমান বেশ কয়েকটি প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত তহবিল এবং সময় বাড়ানোর অনুমোদন আমাদের ঋণের বোঝাকে আরও বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সম্ভবত, এই সমস্যাটি আমাদের ঋণ বৃদ্ধির জন্য দায়ি বড় ত্রুটিগুলোর মধ্যে একটি। এটি এড়ানো যেতে পারে, যদি প্রাকৃতিক কারণ ব্যতীত অন্য কোন কারণেই তহবিল বা সময় বাড়ানো কোনো সুযোগ না দেয়া হয়, বরং এ বিষয়টি মাথায় রেখে শুরু থেকেই প্রকল্পগুলোর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের চিন্তা করা হয়।
কষ্টার্জিত অর্থ না হওয়ায় ঋণ প্রায়শই মানুষকে অপব্যয়ী করে তোলে। ঋণ করা অর্থের যেন কোনো অপচয় না হয় আমাদেরকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এছাড়া, এ অর্থ ব্যবহারের সময় দুর্নীতি ঘটার সমূহ সম্ভাবনা লক্ষ্য করা যায়, সে বিষয়েও সজাগ থাকা আবশ্যক। আরেকটি কথা, আমাদেরকে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে যাতে বিদেশি ঋণ না নিতে হয়। তাতে না হয় আমরা আরও আত্মসংযমী হলাম, কষ্টই করলাম। আত্মসম্মান অনেক বড় জিনিস। তা অর্জন এবং রক্ষা করার প্রবল ইচ্ছাই আমাদেরকে একদিন আত্মনির্ভর জাতি হিসাবে গড়ে তুলবে। আমাদের নেতৃবৃন্দের মধ্যে তেমন দৃঢ় প্রত্যয়ই আমরা প্রত্যাশা করি।
আমরা বিশ্বাস করি, ঋণ পরিশোধের ঝুঁকি এড়াতে বিদেশি ঋণের উৎপাদনশীল ব্যবহার অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়নের নামে এমন কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত নয় যা আমাদের দেশ ও জনগণের জন্য অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে না। একটি প্রকল্প যদি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে না পারে, তাহলে আমাদের নিজের টাকা দিয়েও ওই প্রকল্পকে বিবেচনা করা উচিত নয়। আমরা জানি, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা একইসঙ্গে এই পরিস্থিতি এবং দেশের অর্থনৈতিক-সামর্থ্য সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত আছেন। তারা অবশ্যই বিদেশি ঋণ বা বিনিয়োগ গ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্যই সতর্ক থাকবেন। কোনো প্রকল্পের জন্য বিদেশি ঋণ তখনই নেওয়া উচিত যখন আমরা আমাদের নিজস্ব তহবিল থেকে তা বহন করতে অক্ষম, অথচ প্রকল্পটি দেশের জন্য অতীব প্রয়োজন। তবে, আমরা আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলোসহ অন্যান্য দেশ থেকে ঋণ নেয়ার কথা তখন অবধি ভাববো যতক্ষণ না তা পরিশোধের জন্য কোনো ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকে। মোদ্দা কথা, সম্ভব হলে বিদেশি ঋণ না নেয়াই শ্রেয়।
লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত