রমজানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি অভ্যাসগত সমস্যা
রমজানে দ্রব্যের মূল্যস্ফীতি আমাদের দেশে আমরা দেখে আসছি অনেকদিন আগে থেকেই চলছে। অধিকাংশ দেশে এগুলি ঘটে না। গরীব দেশগুলিতে সাধারণত এগুলো হয়ে থাকে। এরা রমজানকে একটি উসিলা বানিয়ে দেয় অতিরিক্ত লাভ করার জন্য। এটি সাধারণত পাইকারি এবং খুচরা বিক্রেতারা এমনকি আমদানিকারক যারা তারাও এই কাজটি করে থাকে। ২০% থেকে ৩০% বৃদ্ধি এখানেই ঘটে যায়। এটি তাদের অভ্যাসগত সমস্যা যেটি তারা অতীত থেকে শিখে আসছে এবং সমাজও এটি গ্রহণ করে নিয়েছে। দ্রব্যমুল্যের তালিকা লটকাইয়ে দেওয়া হোক না কেন সেটি আসলে কোন কাজ করে না। তাদের তর্ক বিতর্ক থাকে তারা আড়তদারদের থেকে বেশি দামে কিনে আনে, সুতরাং তালিকা অনুযায়ী তাদের বেচাকেনায় ঘাটতি দেখা যায়। এক্ষেত্রে যেটি করা দরকার সেটি হচ্ছে মনিটরিং। কোথাও স্টক করে রাখছে কি না, বেশি প্রফিট করা হচ্ছে কি না, যোগানে কৃত্রিম সংকট তৈরি হচ্ছে কি না, আইনভংগ করে কেউ এগুলি করছে কি না। বড় বড় সাপ্লাইয়ার একত্রিত হয়ে দাম বৃদ্ধি সৃষ্টি করা। এটিও এক ধরণের বেআইনি। এগুলি নিয়ে আমি সংকিত। বিশেষ করে এ বছরের ব্যাপারটি নিয়ে আমি আরও বেশি সংকিত। এ বছর কিন্তু চাউলের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। পানির দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। গ্যাসের দামও বাড়বে। এর ফলে কস্ট অফ প্রডাকশন বাড়বে। তখন এমনিতেই দাম বাড়বে। কেউ যদি বলে মানুষের ক্রয় করার ক্ষমতা বেড়েছে। গড়ে অন এন এভারেজ বেড়েছে। ৩০% লোকের ক্রয় করার ক্ষমতা কমেছে।
কোভিডের কারণে অনেকেই চাকরি হারাচ্ছে। অনেকে বিনা কাজে দুইটি বছর বেকার ছিল। যাদের সঞ্চয় ছিল তারা ভেঙ্গে ভেঙ্গে খরচ করে ফেলছে সাংসারিক কাজে। সুতরাং মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে সেটি টপ ১০% যারা তাদের অনেক বেড়েছে। কিন্তু যারা লোয়ার ৩০% তাদেরটি পুনঃপরিক্ষা করে দেখা দরকার। তারা জিনিসগুলি ভাল বলতে পারবে। গুটি কয়েক মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানো হলেও কিন্তু যাদের নির্দিষ্ট উৎস থেকে যাদের নির্দিষ্ট অর্থ আসে,তারা আছে বেকায়দায়। এরা খুব অসুবিধায় আছে। টিসিবি থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলির দাম সাশ্রয়ী । অনেক মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে যারা একসময় লাইনে দাঁড়ায়নি। এখন দেখা যাচ্ছে। আগে তাদের যে ক্রয়ক্ষমতা ছিল, এখন সেটি নেই। তারা আগে যেভাবে ক্রয় করতে পারতো, এখন সে অবস্থায় নেই বলেই এরা লাইনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। এখন সম্ভব হচ্ছে না বলেই তারা এই পন্থা নিয়েছে। একসময় এরা লাইনে দাঁড়ায়নি। গত দুইবছর আগেও এদের দেখা যায়নি কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে। এটি কিন্তু একটি রিফ্লেক্সশন দ্রব্যমূল্যের মূল্যস্ফীতির কারণে নিচের দিকের মানুষগুলি অতিরিক্ত দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে।
সারা পৃথিবীতেই মূল্যস্ফীতি দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যসহ সারা পৃথিবীতেই এর প্রভাব বিস্তার করেছে। বাইরে থেকে আমরা যেসকল খাদ্যদ্রব্য আমদানি করি, সেগুলির দাম এমনিতেই বাড়বে। সেখানে যদি কাঁচামাল হয়, তার একটা প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে। সেজন্য বাংলাদেশের ভোক্তাদেরও মনস্তাত্বিক দিক থেকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এখন বলা যেতে পারে, যাদের আয় নেই,তাদের কি হবে? যারা সরকারি বেসরকারি পদে চাকরি করে তারাওতো সমন্বয় করে নিবে। যারা কোন চাকরি করে না, করলেও আয় স্থির থেকে যাচ্ছে, তাদের জন্য অনেক সমস্যা হবে। মূল্যস্ফীতি কিন্তু একটি গ্লোবাল ফেনোমেনা ।গত বিশ বছর কিন্তু মূল্যস্ফীতি কম ছিল। কোন কোন দেশে নেগেটিভ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এখানে কিন্তু সেটি উল্টোরূপ ধারণ করেছে।
আমার পরামর্শ হচ্ছে, সরকারকে নিজে আমদানিকারক হতে হবে। চাল, সয়াবিন তেল, চিনি, খেজুর ইত্যাদি আমদানিতে ব্যক্তিগত খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। রমজানকে সামনে রেখে এই প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আরও বৃদ্ধি আরও সম্প্রসারিত করতে হবে। এটি উপজেলা পর্যায়ে অর্থাৎ রুরাল পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। সরকারের একটি বাজেট ভিত্তিক ভর্তুকি লাগবে।
এটি সরকার দেখুক কোথা থেকে সাশ্রয়ী করা যায় কি না। আমি দেখি সরকার এমন এমন জায়গায় ভর্তুকি দিচ্ছে যেখানে ভর্তুকি দেয়া উচিত না। যেগুলি কমার্শিয়াল ভিত্তিতে চালানো যাচ্ছে না, লাভ দিচ্ছে না, সরকার সেখানেও ভর্তুকি দিয়ে চালাচ্ছে।
সরকারের কি দায় পড়েছে স্বাধীনতার ৫০ বছর হয়ে গেছে, এখনো কোম্পানিগুলো সরকার ভর্তুকি দিয়ে চালাচ্ছে। কোভিড পরবর্তী সময়ে সরকারের উচিত এসব আনপ্রোডাক্টিভ অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভর্তুকি কমিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বাজেট বাড়িয়ে দেয়া উচিত। সাশ্রয় যদি না হয়, তাহলে ইকোনমি কখনো দক্ষ হবে না। আর ইকোনমি দক্ষ না হলে তখন কম্পিটিভলি আমরা প্রটেকশন করতে পারবো না। সরকারের এসব উদ্যোগ উপর মহল থেকে নিতে হবে। জনপ্রশাসনেও অতিরিক্ত খরচ করা হচ্ছে। এখানেও অনেক কাটছাঁট করা যেতে পারে। কোভিড পরবর্তী সময়ে অপ্রয়োজনীয় খাতে কাটছাঁট করে নিয়ে অন্তত দুই তিন বছর সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষগুলির জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন কি করে করা যায় সরকারকে সে বিষয়ে ভাবতে হবে এবং সেক্ষেত্রে সরকারের যথাযথ দায়িত্ব পালন করা উচিত বলে মনে করি।
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়