বায়ুদূষণে শীর্ষে ঢাকা: দায় কার?
বিশ্বখ্যাত মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনে সিনা গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে বলেছিলেন, মানুষের ভেতরে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বা অন্য কোনোভাবে যদি ধুলাবালির কণা না ঢুকত, তাহলে মানুষ লাখো বছর বাঁচত। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘায়ু লাভের ক্ষেত্রে ধুলাবালির কণামুক্ত নির্মল ও বিশুদ্ধ বায়ুর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। ঠিক উল্টোদিক থেকে বিষয়টি নিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, দূষিত বাতাস বা দূষিত পরিবেশ দীর্ঘায়ু কমানোর ক্ষেত্রে নেতিবাচকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পৃথিবীতে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনা, ধূমপান এবং ডায়াবেটিসে যে পরিমাণ মানুষ মারা যায়, তার চেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় বায়ুদূষণের কারণে। পরিবেশ ও চিকিৎসাবিদ্যা মতে, বায়ুদূষণ থেকে ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিস (সিওপিডি) নামে শ্বাসতন্ত্রের যে রোগ হয়, যা বিশ্বজুড়ে মানুষের মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ। ২০১২ সালে শুধুমাত্র এই রোগেই পৃথিবীতে যে পাঁচটি দেশে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। কারণ, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোয় বায়ুদূষণের মাত্রা অত্যন্ত বেশি। এরই মাঝে দুঃখজনক খবর হলো–চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি বেলা ১১টার দিকে বায়ুদূষণে বিশ্বের শহরগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান ছিল শীর্ষে। ওইদিন রাত ১০টা ৭ মিনিটেও ঢাকার অবস্থান একই ছিল। বৈশ্বিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘আইকিউ এয়ার’ ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে এ তথ্য জানায়।
‘এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স (ইপিআই)-২০১৮’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা যায়, পরিবেশ রক্ষায় বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা একটি দেশ বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে পরিচালিত ওই গবেষণায় বলা হয়, পরিবেশ রক্ষা সূচকে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৯। ২০১৬ সালের তালিকায় ১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭৩। ২০১৪ সালের তালিকায় ১৭৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৯। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, প্রতিবছরই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ তালিকার নিচের দিকে অবস্থান প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, বায়ুর মান উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে।
অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবেশ দূষণের শিকার হয়ে এখন সারা বছর যত লোক বিশ্বে মারা যায়, তার দুই-তৃতীয়াংশ মৃত্যু ঘটে বায়ুদূষণের কারণে। বাংলাদেশে বায়ুদূষণের সমস্যা যেন মহামারি আকার ধারণ করেছে। ঢাকার বায়ুদূষণে ধুলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গাড়ি ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া। বর্তমানে বাতাসে ধুলা আগের চেয়ে পরিমাণে বেড়েছে। ঢাকায় আগে এখনকার মতো এত মেগা প্রজেক্ট ও গাড়ি ছিল না। পাশাপাশি ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার জলাশয় ভরাট হওয়ায় ধুলার নতুন উৎস জন্মেছে। এখন প্রশ্ন হলো–পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশ এভাবে আর কতকাল পিছিয়ে থাকবে? খোঁজ নিলে দেখা যাবে, পরিবেশদূষণ রক্ষার জন্য বাংলাদেশে আইন ও প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। তারপরেও যদি পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ে, তাহলে বুঝতে হবে এসব আইন ও প্রতিষ্ঠান পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে।
বলা বাহুল্য, পরিবেশ রক্ষায় আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে এদেশে বড় ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। পাশাপাশি জনগণের অসচেতনতা এবং পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যকালাপ তো রয়েছেই। মুলত এসব কারণেই ঢাকা তথা বাংলাদেশের পরিবেশের আজ এই করুণ অবস্থা। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে জনগণের পক্ষে এ দেশে ভালোভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়াটাই এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
বলা হয়ে থাকে, বিপদ-আপদ, দুর্ঘটনা, ভূমিকম্প, সুনামির উপর কারও হাত নেই এবং তা রোধ করাও সম্ভব নয়; কিন্তু একটু সচেতন হলেই একই রাস্তা অসৎ উদ্দেশে বারবার খোঁড়াখুঁড়ি করে জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলাসহ ধুলাবালির বৃহৎ উৎস সৃষ্টি করা, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলে ভাগাড় সৃষ্টি করে দুর্গন্ধময় পরিবেশ তৈরি করা, ধুলাবালি, ধোঁয়াকে জনগণের নিত্যসঙ্গী বানানো থেকে তো অন্তত শহরবাসীকে রক্ষা করা যেতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপাত্তের ভিত্তিতে ২০১৬ সালের ১৭ জুন যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় যে, বাতাসে ভাসমান মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মিহি ধূলিকণার মাত্রা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে রাজশাহী শহর বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক সাফল্য অর্জন করেছে। বায়ুদূষণ কমানোর ক্ষেত্রে রাজশাহীর এই গৌরবজ্জ্বল দৃষ্টান্ত থেকে একটা বিষয় সুস্পষ্ট যে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সত্যিকার অর্থে আন্তরিক প্রয়াস এবং সবার সহযোগিতা থাকলে একটি শহরের শুধু বায়ুদূষণ কমানোই নয়, ওই শহরকে ভালোভাবে বসবাস উপযোগী করে তোলাও সম্ভব। এ ক্ষেত্রে যদি ঘটনা উল্টোভাবে ঘটে, তাহলে এই জায়গায় রাজশাহীকে দেখতে না পেয়ে প্রথমেই দেখা যাবে ঢাকা এবং এর পর গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনার মতো অন্যান্য শহরকে, যা মাত্রাতিরিক্ত দূষণে পরিপূর্ণ। এ যেন ইতিবাচক মনোভাবাপন্ন কতিপয় ব্যক্তিকে নরকে পাঠিয়ে দেওয়ার পর কয়েকদিন পর নরকটি স্বর্গে পরিণত হওয়া এবং নেতিবাচক মনোভাবাপন্ন কতিপয় ব্যক্তিকে স্বর্গে পাঠিয়ে দেওয়ার পর স্বর্গটি নরকে পরিণত হওয়ার গল্পের মতো।
এখন প্রশ্ন হলো–রাজশাহী শহর বায়ুদূষণ কমানোর ক্ষেত্রে যদি সারা বিশ্বের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়; তাহলে কেন ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ দেশের অন্যান্য শহরগুলোতে বায়ুদূষণসহ পরিবেশদূষণ কমানো যাচ্ছে না? না কি ওই শহরগুলোয় বসবাসরত লোকজন পরিবেশদূষণ পছন্দ করেন? নিশ্চয় না। দেশের অন্যান্য শহরে বায়ুদূষণ বা অন্যান্য দূষণ কমানোর ক্ষেত্রে কোনো জাদুর কাঠির প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আন্তরিক হওয়া, প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হওয়া, সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী নগরায়ন করা, আইনের সঠিক প্রয়োগ ঘটানো ইত্যাদি।
পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে শুধু সরকার নয়, ব্যক্তি পর্যায়েও সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন। পরিবেশ রক্ষায় সারা দেশে বাস্তবমুখী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে নিশ্চয় রাজশাহীর মতো ঢাকা শহরেও বায়ুদূষণসহ অন্যান্য দূষণ কমিয়ে আনা সম্ভব, সম্ভব নির্মল পরিবেশে বাসযোগ্য পরিবেশ গড়ে তোলা। আর এ লক্ষ্যে সরকার, জনগণ, পরিবেশবিদ, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে একযোগে দ্রুত এগিয়ে এসে কাজের কাজ শুরু করতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
এসএ/