রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত কার্জন হল
কার্জন হল বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপনা। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এ স্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিবিজড়িত স্থান হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। ১৯০৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল জর্জ কার্জন এ হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর ভবনটির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। এক সময় এটি ঢাকা কলেজের ক্লাসরুম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে কার্জন হল তার অন্তর্ভুক্ত হয়। বর্তমানে কার্জন হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান অনুষদের শ্রেণিকক্ষ ও পরীক্ষার হল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ও ১ জানুয়ারি কার্জন হলে অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন। ঐ সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাঙালিত্বের অহঙ্কার প্রকাশ করে যে বক্তৃতা দেন, তা বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির অগ্রযাত্রার ইতিহাসে এক মাইলফলক হয়ে আছে। ওই অভিভাষণে ভাষা ও সাহিত্যের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন তিনি। বাঙালিত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে তিনি বলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙ্গালী। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব সত্য। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙ্গালীত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই।’ কার্জন হলের ঐ সাহিত্য সম্মেলনে প্রাদেশিক সরকারের শিক্ষা দফতরের সেক্রেটারি ফজলে আহমেদ ফজলী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ভাষণটির সমালোচনা করেন এবং রুষ্ট হয়ে সভাস্থল পরিত্যাগ করেন।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে কার্জন হল স্মরণীয় হয়ে আছে পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সমাবর্তন বক্তৃতায় উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার কারণে। ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ তিনি এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেন–‘উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হইবে’। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সমবেত ছাত্রগণ তাৎক্ষণিকভাবে এর প্রতিবাদ করেন। হলের মধ্যে কিছু সংখ্যক ছাত্র ‘না, না’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। ওই সভার প্রত্যক্ষদর্শী সরদার ফজলুল করিম লিখেছেন, “কার্জন হলের অনুষ্ঠানে প্রথমে ছিল শিক্ষকদের বসার জায়গা, তার পেছনে ছিল ছাত্ররা। ...জিন্নাহ সাহেব তাঁর স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড ল্যাঙ্গুয়েজে ইংরেজিতে ভাষণ দিলেন। ...জিন্নাহ সাহেব যখন রাষ্ট্রভাষার কথায় এলেন তখন তিনি রেসকোর্সের কথাটাই রিপিট করলেন, ‘আই টেল ইউ, এ্যাজ ফার এ্যাজ ল্যাঙ্গুয়েজ ইন কনসার্নড উর্দু এ্যান্ড উর্দু এ্যালোন শ্যাল বি দি স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান।’ এ সময়ে ছাত্ররা যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে তিনটা আওয়াজ বের হয়েছিল ‘নো, নো, নো’। জাস্ট তিনটা শব্দ। ...জিন্নাহ সাহেব হেজিটেটেড ফর এ সেকেন্ড এ্যান্ড স্টপড, বাট দেন হি কনটিনিউড হিজ ওউন স্পিচ এজ হি ওয়ান্টেড টু।”
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমদ্দীন আহমদ বলেন, “কায়েদে আজম উঠলেন বক্তৃতা দিতে। তিনিও এসে পড়লেন রাষ্ট্রভাষার খচখচানিতে।... দাঁড়িয়ে গিয়ে বললাম, ‘কায়েদে আজম আমরা মাস্টার ডিগ্রি পেয়েছি, কাজেই ভাষার সবক নিতে আর রাজি নই।’...কায়েদে আজমের বক্তৃতা বন্ধ হয়ে গেল।”
ভাষাসংগ্রামী আবদুল মতিন লিখেছেন, “আমি আগের বছর বিএ পাশ করেছি। সনদ গ্রহণের জন্য কার্জন হলে সমাবর্তন সভায় যাই। যথারীতি সমাবর্তন সভা শুরু হলো। জিন্নাহ প্রধান অতিথির ভাষণের একপর্যায়ে তাঁর রেসকোর্স ময়দানের বক্তৃতার পুনরাবৃত্তি করে বললেন, ‘উর্দু, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললাম, ‘নো, নো’।”
কার্জন হলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণায় তাঁর সামনে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করা তখনকার দিনে ছিল অতি দুঃসাহসী কাজ। ফলে ওই সময়কার পত্র-পত্রিকায় এ সংবাদ খুব গুরুত্বসহ প্রকাশিত হয়।
কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় বলা হয়, “মি. জিন্না যখন পুনরায় ঘোষণা করেন যে, একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে, আর কোন ভাষা নহে, তখন কতিপয় গ্র্যাজুয়েট, যাহাদিগকে কিছুক্ষণ পূর্বে ডিপ্লোমা বিতরণ করা হইয়াছে, তাঁহারা ‘না না’ বলিয়া প্রতিবাদ করিয়া উঠেন। ছাত্রদের মধ্য হইতে এই অপ্রত্যাশিত প্রতিবাদে সমগ্র সভামণ্ডপ মধ্যে কিছুক্ষণ যাবৎ মৃদু গুঞ্জন চলে। সমাবর্তনের পর কায়েদে আজম যখন সমাবর্তন মণ্ডপ ত্যাগ করেন, ছাত্রেরা ঐ সময় ‘কায়েদে আজম জিন্দাবাদ’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ‘উর্দুর সঙ্গে বাংলা আমরা রাষ্ট্রভাষা করিতে চাই’ বলিয়া চিৎকার করিতে থাকেন।”
কার্জন হল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রতিবাদের স্মারক হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর অন্যায় ঘোষণার প্রতিবাদে পূর্ব-বাংলার ছাত্রসমাজ মাতৃভাষা বাংলার প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার যে দৃষ্টান্ত সেদিন স্থাপন করেছিলেন, তা ইতিহাসে মর্যাদার আসন লাভ করেছে।
লেখক: গবেষক-প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
এসএ/