এইচএসসির ফল-একই কারিকুলামে
পাসের হারে বোর্ডের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন
২০২১ সালের এইচ.এস.সি এবং এইচ.এস.সি ভোকেশনাল, এইচ.এস.এস.সি ব্যবসা ব্যবস্থাপনা ও ডিপ্লোমা-ইন-কমার্স পরীক্ষার ফল ১৩ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়। করোনা পরিস্থিতির কারণে ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়েছিলেন। এবার এইচ এস সি ও সমমানের পরীক্ষায় গড় পাসের হার ৯৫.২৬ শতাংশ। তবে ৯টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডের অধীনে শুধু এইচ.এস.সি পরীক্ষায় গড় পাসের হার ৯৫ দশমিক ৫৭। মাদ্রাসা বোর্ডে পাসের হার ৯৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং কারিগরি বোর্ডে পাসের হার ৯২ দশমিক ৮৫ শতাংশ । ২০১৯ সালে পাসের হার ছিল ৬২ দশমিক ১৯ শতাংশ। ২০২০ ছিল আটোপাস, আর পাসের হার ছিল ১০০শতাংশ। এই আটোপাস দ্বারা কিছুই বুঝা যাচ্ছিলোনা আর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মানসিক তৃপ্তি বলতে কিছুই ছিল না।
ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৯৬ দশমিক ২০শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫৯ হাজার ২৯৯জন। রাজশাহী বোর্ডে পাসের হার ৯৭ দশমিক ২৯শতাংশ এবং জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩২ হাজার ৮০০জন। দিনাজপুর বোর্ডে পাসের হার ৯২ দশমিক ৪৩ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৫ হাজার ৩৪৯জন। বরিশাল বোর্ড থেকে এবার ৬৮ হাজার ৪৪১ জন বেশি শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ফরম পূরণ করেছিল। কিন্তু পাস করেছে ৬৩ হাজার ৯৬৪ জন। ৯ হাজার ৯৭১ জন পরীক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। এ বছর এ বোর্ডে ৯৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। গতবছর অর্থাৎ ২০২০ সালে বরিশাল বোর্ডে ৫ হাজার ৫৬৮জন পরীক্ষার্থী এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছিল। কুমিল্লা বোর্ডে ১৪ হাজার ১৫৩ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। এ বছর বোর্ডের ৯৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। গত বছর এ বোর্ডের ৯ হাজার ৩৬৪জন পরীক্ষার্থী এইচ.এস.সিতে জিপিএ-৫ পেয়েছিল। সিলেট বোর্ডে পাসের হার ৯৪ দশমিক ৮০শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪ হাজার ৭৩১জন। চট্টগ্রাম বোর্ডে পাস হরার ৮৯ দশমিক ৩৯শতাংম, জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৩ হাজার ৭২০জন। ময়মনসিংহ বোর্ডে পাসির হার ৯৫ দশমিক ৭১শতাংশ জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭ হাজার ৬৮৭ জন। যশোর বোর্ডে পাসের হার ৯৮ দশমিক ১১শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ২০ হাজার ৮৭৮জন। রাজশাহীতে ৯৭ দশমিক ২৯ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৮৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ পাস করেছে।
২০২১ সালে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড ও মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাবোর্ড মিলিয়ে মোট ১৪ লাভ ১৪৫ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষার্থী অংশ নেয়। পরীক্ষা শুরু হয় ২ ডিসেম্বর, শেষ হয় ৩০ ডিসেম্বর। একমাসের মধ্যে ফল প্রকাশের ঘোষণা দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেই হিসেবে জানুয়ারির শেষে কিংবা ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ফলপ্রকাশের কথা। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত পরীক্ষা উত্তর আসতে বিলম্ব হওয়ায় ফল তৈরিতে বিঘ্ন ঘঠে। আমরা জানি, এবার সব বিষয়ে পরীক্ষা হয়নি। শুধু বিভাগভিত্তিক তিনটি করে নৈর্বাচনিক বিষয়ে এ পরীক্ষা নেওয়া হয়। তবে, অন্যান্য বিষয়ে এসএসসি ও জেএসসিতে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ‘সাবজেক্ট ম্যাপিং’ করে শিক্ষার্থীদের গ্রেডিং দেওয়া হয়।
২০২০ সালে এগারটি শিক্ষা বোর্ডের ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ জন শিক্ষার্থীর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল ১ এপ্রিল ২০২০। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে শুরু করলে ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর গত ৭ অক্টোবর পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার মতো এইচএসসি পরীক্ষাও বাতিলের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিশেষ ব্যবস্থায় মূল্যায়নের কাজটি করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। বিভাগ পরিবর্তনজনিত কারণে যেমন বিজ্ঞান থেকে মানবিক বিভাগে যারা গিয়েছে সে কারণে যে সমস্যাটি হওয়ার কথা তা ঠিক করতেও বিশেষজ্ঞ কমিটি কাজ করেছিল। বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামত অনুযায়ীই ফল প্রকাশ করা হয়েছিল। তাদের মতামত অনুযায়ী জেএসসি/সমমানের আবশ্যিক বাংলা, ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ের নম্বরের ২৫ শতাংশ এবং এসএসসি/সমমান পরীক্ষার আবশ্যিক বাংলা, ইংরেজি ও আইসিটির ৭৫শতাংশ নম্বর বিবেচনা করে এইচএসসি-র আবশ্যিক বাংলা, ইংরেজি ও আইসিটি-র নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে। বিভিন্ন গ্রুপের নম্বরের ক্ষেত্রে গ্রুপ ভিত্তিক বিষয়ের নম্বর প্রায় একইভাবে বিবেচনা করা হয়েছিল। বিভাগ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে জেএসসি/সমমান পরীক্ষার গণিত এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বরের ২৫ শতাংশ, এসএসসি/সমমান পরীক্ষার গ্রুপ ভিত্তিক পর পর তিনটি বিষয়ের ৭৫ শতাংশ নম্বর বিবেচনা করে যথঠক্রমে এইচএসসি-র মানবিক ও অন্যান্য গ্রুপে তিনটি বিষয়ের নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছিল। এটি নিয়ে আমরা অনেক সমালোচনা করতে পারি, কিন্তু এছাড়া খুব অতিরিক্ত কিছু করার উপায় ছিল না। তাই মন্ত্রণালয়কে এ ধরণের সিদ্ধান্তই নিতে হয়েছে। তবে, ইংরেজি মাধ্যমের ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষার্থীরা আগের নিয়মেই পাবলিক পরীক্ষায় বসে ফল পেয়েছে যেটি সাধারণ ধারার শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে হয়নি।
২০১৯ সালের উচচ মাধ্যমিক সার্টিফিটেক ও সমমানর পরীক্ষায় গড় পাসের হার ছিল ৭৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ফলাফলে সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫পেয়েছিল ৪৭ হাজার ২৮৬ জন যা মোট পরীক্ষার্থীর ৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। পরীক্ষার্থী ছিল ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬২৯ জন, পাস করেছিল ৯ লাখ ৮৮ হাজার ১৭২জন। এবার ১ লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ জন পরীক্ষার্থীকে জিপিএ-৫ দেয়া হয়েছে। ৯টি সাধারণ বোর্ড থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬১৪ জন , আর আলিমে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪হাজার ৪৮ জন। কারিগরিতে-জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪ হাজার ১৪৫ জন অর্থাৎ ৩ দশমিক ১০ শতাংশ। ২০১৮সালের তুলনায় ২০১৯ সালে জিপিএ-৫ বেড়েছে তিনগুণ। এসএসসিতে যারা জিপিএ-৫ পায়নি তাদের ১৭ হাজার জিপিএ-৫ পেয়েছে যা উল্টো মনে হচ্ছে কারণ উচ্চ মাধ্যমিকে সাধারণ এসএসসির চেয়ে ফল নিম্নমানের হয়ে থাকে। দু’একজনের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হয়। কিন্তু ২০১৯ সালে যেটি হয়েছে সেটি ব্যতিক্রম নয়, অস্বাভাবকিতা।
করোনা মহামরীর পরিবর্তিত পরিস্থিতি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, শ্রেণিকক্ষের মূল্যায়ন, অবিরত মূল্যায়ণ বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। সামেটিভ মূল্যায়ন পদ্ধতি দিয়ে একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃত মুল্যায়ন হয় না। আমাদের শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সর্বোপরি পুরো ব্যবস্থা অবিরত মূল্যায়ন অর্থাৎ ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতির জন্য প্রস্তুত করতে হবে। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, উচ্চ শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে যাতে রিজন্যাবল পরীক্ষা নেওয়া হয় সে বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে। শিক্ষার্থীরা বহুদিন যাবত বইয়ের সঙ্গে, প্রকৃত লেখপড়ার সঙ্গে সেবাবে সংযুক্ত নেই। তাদেরকে আমরা কোনোভাবেই সেজন্য দায়ি করতে পারি না। পরীক্ষা দিয়ে ফল অর্জন করার মধ্যে যে আনন্দ সেই আনন্দ থেকে শিক্ষার্থীরা বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হচেছ কিন্তু উচচশিক্ষার ক্ষেত্রে সেটি যাতে না হয় সেদিকে আমাদের সকলের দৃষ্টি দিতে হবে। গতবারের চেয়ে এবার ৩৩হাজার ৯০১ জন পরীক্ষার্থী বেশি ছিল। গ্রুপভিত্তিক তিনটি বিষয়ে নম্বর ও সময় কমিয়ে দেড় ঘণ্টার পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বহুনির্বাচনী ও সৃজনশীল অংশের পরীক্ষার মধ্যে কোনো বিরতি ছিল না। দেশের ১৯৩৪ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাসের হার শতভাগ তবে, ৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ পাস করতে পারেনি। শতকরা পাস করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৯টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডের ৭৩৬টি, মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের এক হজার ৩টি ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ১৯৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫২২ শিক্ষার্থী। মাদ্রাস শিক্ষা বোর্ডের অধীন আলিম পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪ হাজার ৮৭২ জন, আর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫হজার ৭৭৫জন।
পাসের হারের দিক দিয়ে শীর্ষে রয়েছে যশোর বোর্ড। এ বোর্ডে পাসের হার ৯৮ দশমিক ১১ আর সবচেয়ে পেছনে রয়েছে চট্টগ্রাম বোর্ড। এ বোর্ডে পাসের হার ৮৯ দশমিক ৩৯শতাশং। জিপিএ-৫ প্রাপ্তির দিক দিয়ে সববোর্ডের শীর্ষে আছে রাজশাহী বোর্ড, আর পিছিয়ে আছে সিলেট বোর্ড। পাসের হারে এক বোর্ড থেকে আরেক বোর্ডের এগিয়ে থাকা কিংবা পিছিয়ে যাওয়ার কারণ কোনো বছরেই খতিয়ে দেখা হয় না। সব বোর্ডেই একই কারিকুলাম অনুসরন করা হয়, একইভাবে সব বোর্ডেই সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকরা পড়ান, সবার কর্মঘণ্টা একই, সব বোর্ডেই গ্রাম ও শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, কর্মদিবস একই তারপরেও কেন এত পার্থক্য? এই কারণ আমাদের খোঁজা উচিত, জানা উচিত, সবাইকে জানানো উচিত। প্রতিটি বোর্ডেই এজন্য একটি গবেষণা সেল থাকা একান্ত প্রয়োজন কিন্তু কেউই বোধ করছি বিষয়টি নিয়ে একেবারেই চিন্তিত নন।
লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক