ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিলেন মোদি
পাঠক হঠাৎ চমকে যাবেন না। আপনারা যে ইতিহাস পড়েছেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে, তা ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি সংসদের উভয়কক্ষে গলা চড়িয়ে বললেন, ভারত ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন হয়নি। ভারত স্বাধীন হয়েছে ২০১৪ সালের ২৩ মার্চ, যেদিন তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী আসনে বসেছিলেন। তার এই উক্তির সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী কংগ্রেসসহ অন্যান্য দল যখন চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলো, তখন তিনি যে উক্তিটি করলেন তা আরও মারাত্নক। তিনি বললেন, স্বাধীনতা আন্দোলনে পন্ডিত নেহরুর কোনও ভূমিকা ছিল না। ভূমিকা ছিল মহাত্না গান্ধী, বাবা সাহেব আম্বেদক এবং সর্দার বল্লভভাই প্যটেলের। সারা দেশের এবং বিশ্বের ইতিহাসবিদেরা মোদিকে শুধু শিক্ষিতই বলেননি। তারা মনে করেন, এহেন অর্ধশিক্ষিত একজন মানুষ বিগত আট বছর ধরে ভারতবর্ষে ১৩৮ কেজি মানুষকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিভ্রান্তির পর বিভ্রান্তিতে ফেলেছেন।
ভারতের সংবিধাননীতি এবং প্রথা অনুযায়ী প্রতিবছর রাষ্ট্রপতির ভাষণের মাধমেই সংসদের উভয় সভা চালু হয়। সংসদীয় নিয়মানুযায়ী রাস্ট্রপতির বক্তব্যের উপর ধন্যবাদ প্রস্তাব আনা হয়। সেই প্রস্তাবের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিচ্ছিলেন। সেই ভাষণেই তিনি এই উক্তি করেন। হত্যার পর রেডিওতে ডালিম বলেন, এবার বাংলাদেশ সত্যিকারের স্বাধীন হল। আর জয় বাংলা ধ্বনি নয়, এবার থেকে ধ্বনি হবে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। ভারতের সংসদে মোদির উক্তির সঙ্গে মেজর ডালিমের উক্তির একটা মিল পাওয়া যাচ্ছে না কি?
এবার একটু পর্যালোচনা করে দেখা যাক, গত আট বছর ধরে মোদি সরকার কীভাবে ভারতবর্ষের একটার পর একটা ক্ষতি করে চলেছেন।
গত দু'বছর ধরে করোনা আবহে দেশের মানুষ যখন অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটিয়েছে, তখন মোদি বলেছেন, এই সময়ে দেশের মানুষ স্বনির্ভর হয়েছে। তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো হয়েছে। তিনি নাকি সবাইকে বাড়ি করে দিয়েছেন। অথচ আসল চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন। প্রধানমন্ত্রী মোদি পি এম কেয়ার্স তহবিল গঠনের পর যে ১৩ হাজার কোটি জমা পড়েছে। সেই টাকার কোনও হিসেব দিতে চাননি তিনি। যুক্তি হিসেবে বলেছেন, এটাকা জনগণের টাকা। তাই এই টাকার কোনও অডিট হবে না। অর্থাৎ এই ১৩ হাজার কোটি টাকার কোনও হিসেব দেশবাসী জানবে না। এই টাকা কোথায় গেল, প্রশ্ন তোলা যাবে না।
ওয়াকিবহাল মহল মনে করে, যেহেতু দেশের পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন আসন্ন, আর সেই সব রাজ্যে শাসক বিজেপির অবস্থা ভালো নয়, তাই রাস্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদসূচক প্রস্তাবের পক্ষে বলতে গিয়ে তিনি কৌশলের নির্বাচনী প্রচার করে গেলেন। তার এমন বক্তৃতার নেপথ্যে আর একটি কারণ হল, হিন্দু মুসলমান ধর্মীয় মেরুকরণ করা। এই মেরুকরণের কাজ শুরু করেছিলেন মোদি এবং তার সহযোগী দল আরএসএস। তার বক্তৃতার মধ্যে ছিল দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন আরএসএস এর জন্মদাতা বীর সাভারকার এবং দীনদয়াল উপাধ্যায়। এই দুজনেই মুচলেকা লিখে আন্দামান জেল থেকে মুক্ত হন এবং ব্রিটিশ সরকারকে সমর্থন করেন। পাশাপাশি গান্ধীজির আন্দোলনের বিরোধিতা করেন। এই ইতিহাস সকল ইতিহাসবিদ এবং শিক্ষিত মানুষই জানেন, জানেন না শুধু নরেন্দ্র মোদিও তার অনুচরেরা এবং আর এস এস এর ‘পন্ডিত’ রা। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মোদি ‘কংগ্রেসমুক্ত’ ভারত গড়ার ডাক দিয়েছিলেন। এবার তিনি সরাসরি পন্ডিত নেহরুকে আক্রমণ করেছেন। এমনও বলেছেন আজকের করোনা পরিস্থিতির জন্য নেহরুর নীতিই দায়ী।
মোদির এই উক্তির সঙ্গে আমরা একটি উক্তির হুবুহু মিল পাচ্ছি। বাংলাদেশের জাতির পিতা বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর জিয়াউর রহমান বলেছিলেন বাংলাদেশে একটি সামরিক সরকার দরকার। তারা ৪ মাস মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে যে ৪ নেতা, তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলি এবং আবু হেনা কামরুজ্জামান,তাদের জেলে বন্দী করে রাতের অন্ধকারে গুলি করে হত্যা করেছিল মেজর ডালিম। সাম্প্রতিককালে ভারতে দেখা যাচ্ছে, গুজরাটের দুই ব্যবসায়িক গোষ্ঠী আম্বানি এবং আদানিরা দেশের সম্পদের ৭৫শতাংশ গ্রাম করেছেন। একথা সকলেই জানেন, আম্বানিদের আজকের রম্প্রমার নেপথ্যে রয়েছেন দেশের প্রাক্তন রাস্ট্রপতি এবং প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী প্রনব মুখার্জি। মনমোহন সিংয়ের আমলে একটি আইন করা হয়েছিল--তথ্য ছানার অধিকার সংসদে সংখ্যাধিক্যের জোরে এই আইনটি এখন বিজেপির পক্ষে আনা হয়েছে।
কিছুদিন আগে দক্ষিন ভারতের অন্ত্রপ্রদেশে একটি মন্দিরে মোদিকে দেখা গেছে লাল বস্ত্র পরে কপালে তিলক কেটে তিনি ঘুরেছেন। যেন দেখতে চাইছেন, তার চেয়ে বড় হিন্দু আর নেই। তার এই হিন্দুদের প্রচারের মাঝেই শুরু হয়ে গেছে আর এক অশান্তি। বিজেপির বরাবরের রাজনৈতিক তাস হিন্দু-মুসলিম বিভাজন নতুন রূপ পেয়েছে। দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে কর্ণাটকে পন্ডিচোরিতেও। মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরার বিরোধিতা করে বিজেপি আরএসএস পথে নেমেছে। হিন্দু মৌলবাদকে সঙ্গী করে গেরুয়া কাপড় দিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হয়েছে বিজেপি আর এস এসের কর্মীদের। তারা ছাত্রীদের হিজাব পরতে দেখলেই তার বিরোধিতা করছে। আর এই নিয়েই বেজেছে অশান্তি। মুসলিম মহিলারা এর বিরোধিতা করেছেন। পাকিস্তানের নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাইয়ের নেতৃত্বে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। এভাবেই ধর্মীয় বিভাজনের ফলে সম্প্রীতি নষ্ট করতে আরও একটি বড় চক্রান্ত আর এস এস বিজেপি। কয়েকদিন আগে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত দক্ষিণ কলকাতার একটি বাড়িতে এক গোপন বৈঠক করেন। সেখানে তিনি বলেছেন, হিজাব পরলেই তার বিরোধিতা করা হবে। এই খবর প্রচার হয়ে যাওয়ার পরেই কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়াংকা গান্ধী লখনউয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন, সমস্ত মহিলাদের তাদের পছন্দমতো পোশাক পরার অধিকার রয়েছে। এটি ভারতের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। এই অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না। আমি বলছি, মুসলিম ছাত্রীরা অবশ্যই হিজাব পরবেন। এই স্বাধীনতা সংবিধান তাদের দিয়েছে। যারা এই অধিকার কেড়ে নিতে চাইছেন,তাদের সেই কাজের আমি তীব্র বিরোধিতা করছি।
মোদির অসত্য ও যুক্তিহীন কথা আর কাজের প্রসঙ্গে আরও একটি কথা বলা যায়। তিনি যে বলেছেন, ভারত ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হয়নি হয়েছে ২০১৪ সালে, সেই যুক্তি মানলে তারই দলের অটলবিহারী বাজপেয়ী ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী রইলেন কী করে? পরাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী? এ প্রশ্নও তাকে করা হয়েছে। মোদি উত্তর দেননি। এড়িয়ে গেছেন। অবান্তর কথার জাল বুনতে ওস্তাদ মোদিজি এবং আর এস এস প্রধান মোহন ভগবত বলেছেন, আগামী ১০০ বছর দেশের শাসন ক্ষমতায় থাকবে বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী থাকবেন মোদি। রীতিমতো হাস্যকর কথা। মোদির বর্তমান বয়স ৭৩ বছর। ১০০বছর পর তার বয়স হবে ১৭৩ বছর। তখন তিনি জীবিত থাকবেন এবং দেশ চালাবেন। বিজেপি ক্রমাগত এমন অবান্তর কথা বলে চলেছে। আসলে আসন্ন পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন নিয়ে তাদের উৎকণ্ঠা মাত্রা ছাড়িয়েছে। তাই যা পারছে বলে যাচ্ছে। মরণকালে বুদ্ধিনাশ।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক