সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতার অনেক বেশি অভাব
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই পরিবর্তন হয়। আগে যে অবস্থা ছিল এখন নিশ্চয়ই সে অবস্থা নেই। সেটি শিক্ষার ক্ষেত্রেও সত্য, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও সত্য। সকল ক্ষেত্রেই সত্য। কাজেই পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। এখন সেটি ভালোর দিকে যাচ্ছে না কি খারাপের দিকে যাচ্ছে সেটিই দেখার বিষয়।
আমরা দেখেছি, আগে সাংবাদিকদের বেতন ভাতা সুযোগ সুবিধা অনেক কম ছিল। কিন্তু সাংবাদিকতার মান অনেক ভাল ছিল। কারণ বস্তুনিষ্ট সংবাদের দিকে সাংবাদিকদের ঝোঁক বেশি ছিল। এখন সাংবাদিকেরা অপেক্ষাকৃত ভালো পরিবেশে কাজ করার সুযোগ পায়। কিন্তু দেখা যায় বস্তুনিষ্ঠতার অনেক বেশি অভাব। আগে সাংবাদিকতার একটা ভিশনারি মিশন ছিল যে, আমরা সমাজকে সেবা করবো। এরকম একটি আদর্শ নিয়েই তারা সাংবাদিকতায় আসতেন। গণমাধ্যম যারা প্রতিষ্ঠা করতেন, তাদের ইচ্ছা ছিল, তথ্য সেবার মাধ্যমে জনগণের সেবা দেয়া, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করা। পত্র পত্রিকার জৌলুশ তাদের ছিল না। ছোট ছোট পত্রিকা অফিস সেখানে অল্প কিছু লোক কাজ করতেন। এখন সাংবাদিকদের ক্ষেত্র বেড়েছে, বড় বড় প্রতিষ্ঠান হয়েছে, কিন্তু কাজের গুণগত মান বাড়েনি। নৈতিকতার চেয়ে কি করে দ্রুত ধন সম্পদের মালিক হওয়া যায় এরকম একধরনের মানসিকতা দেখা যায়।
আগের দিনে সাংবাদিকরা সত্যের জন্য জেল জুলুম এমনকি মৃত্যুকে পরোয়া করতো না। এখন সেরকম ত্যাগের মহিমা নেই বলেই মনে হয়। আগে সাংবাদিক বড় হলেও ঘর ছিল ছোট, জীবনযাত্রা ছিল অতি সাধারণ। এখন সাংবাদিক ছোট কিন্তু গাড়ি বাড়ি টাকা পয়সার অভাব নেই। এই ট্রেডিশন চালু হয়ে গেছে। শুধু বাংলাদেশে নয় সারা পৃথিবীব্যাপি সংবাদপত্র শিল্পটি অর্থ নির্ভর হয়ে গেছে। তবে আমি বলবো, এখনও অনেক সাংবাদিক আছেন যারা ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠায় আপোষহীন। তবে সাংবাদিকতারও সুদিন আসছে আমি দেখছি। এতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। আমাদের আশাবাদী হতে হবে।
আমার মনে হয় না কোনো দেশের মানুষই বলতে পারবে যে, বর্তমানে যে অবস্থা বিরাজমান সেটি শিক্ষাক্ষেত্রে হোক, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে হোক, চিকিৎসা ও অন্যান্য মাধ্যমেই হোক শতভাগ সন্তুষ্ট বলা যাবে না। প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে আরও ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল। আরও সংশোধন করা দরকার ছিল। আমরা আমাদের দেশে যে গণতন্ত্র চর্চা করছি, সেটি খুব অল্প সময়ের। আমরা ৭১ সালে স্বাধীন দেশ পাবার পর ৭২এ যখন সংবিধান রচিত হয়, তখন এই সংবিধানটি ছিল পৃথিবীর জন্য উন্নত সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক একটি সংবিধান। কিন্তু সেই সংবিধানকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ৭৫এ হত্যাকাণ্ডের পরে এই সংবিধানকেও একধরনের হত্যা করেছিল। এদেশে সামরিক শাসন, স্বৈরশাসন, অপশাসন দানা বেধেছিল। বহুদিন এভাবেই এইদেশ পরিচালিত হয়েছে। সংবিধানকে কাটা ছ্যাড়া করা হয়েছে। গণতন্ত্র নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। ১/১১তে আমরা দেখেছিলাম গণতন্ত্রের নির্বাসন। এদেশের গণতন্ত্র হাটি হাটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্র এখন যে জায়গায় আছে, তা থেকে আমরা আরও উন্নত জায়গায় যেতে চাই।
আমরা দেখেছি নির্বাচন কমিশন সংসদে আইন পাশ করেছে। ইতিমধ্যে সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কাজেই আমরা আশা করবো একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আমরা দেখতে পাবো। নির্বাচনই গণতন্ত্রের মূলকথা নয়। কিন্তু নির্বাচন একটি মৌলিক জায়গা। একটি গুরুত্বপুর্ণ জায়গা। নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার দেশ শাসনের একটি অনুমতি পায়। এই নির্বাচনের মূল জায়গাটিই হচ্ছে জনগণের ভোটের অধিকার। ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা। প্রতিটি প্রার্থী যেন তাদের প্রার্থীতা দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা করতে পারেন। এটি একটি উল্লেখযোগ্য এবং যারা নির্বাচিত হয়ে আসবেন, তারা যেন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশ শাসন করেন, সুশাসন উপহার দেন সেটিও দেখার দরকার আছে। যে সকল দেশ ৩০০/৪০০ বছর ধরে গণতন্ত্র চর্চা করছে তাদের নিয়েও প্রশ্ন অথবা বিতর্ক আছে। সেখানে আমাদের গণতন্ত্রের অভিজ্ঞতা কম সময়ের। আমরা আশা করবো আমাদের দেশ যত এগিয়ে যাবে, ততই আমরা গণতান্ত্রকে আরও উন্নত, সমৃদ্ধ এবং জনগণের কাছে নিয়ে আসতে সক্ষম হবো।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সাড়ে সাত কোটি মানুষ একসঙ্গে যুদ্ধ করেছে। ত্রিশ লাখ মানুষ রক্ত দিয়েছে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের জায়গায় এখন ষোল কোটির উপরে সবাই। একই রাজনীতি করবে, একই মতাদর্শে বিশ্বাসী হবে। এটি ঠিক যে ভিন্ন মত থাকবে, ভিন্ন দল থাকবে, ভিন্ন দর্শন থাকবে। কিন্তু গণতান্ত্রিক একটি দেশে স্বাধীনতার বিরোধী কোনো শক্তি থাকবে না। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, স্বাধীনতার সাথে সাথে স্বাধীনতার বিরোধী একটি শক্তি দাঁড়িয়ে গেছে। দেশের প্রতি অশুভ দৃষ্টি পড়েছে। সেখান থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। এক দেশ এক নেতা এক জাতি সবাই আমরা দেশ ও জনগণের স্বার্থে এক এই নীতিতে বিশ্বাসী হতে হবে।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়