বিশেষ নিবন্ধ
ডা. মুরাদের দম্ভ চূর্ণ এবং অন্যদের জন্য শিক্ষা
অর্থ এবং ক্ষমতা মানুষকে দাম্ভিক করে তোলে। আর দাম্ভিকতা মানুষকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। এ ক্ষেত্রে প্রকৃতি বড়ই নিষ্ঠুর। প্রকৃতি কাউকে ক্ষমা করে না। তার কাছে ধনী-দরিদ্র, ক্ষমতাবান কিংবা ক্ষমতাহীন সবাই সমান। দুনিয়ার বিচারালয়ে বিচার না পেলেও প্রকৃতির বিচার অনিবার্য। তাকে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ কারও নেই। কিন্তু মানুষ এটা বোঝে না। বুঝতে চায় না।
মহান সৃষ্টিকর্তা তার বান্দাকে সীমা অতিক্রম না করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু অর্থ এবং ক্ষমতা পেলে মানুষ বেসামাল হয়ে যায়। দাম্ভিকতা তাকে পেয়ে বসে। সে ভুলে যায় তার সীমার কথা। তখন সে কথায় কথায়, কারণে অকারণে সীমা অতিক্রম করে। আমরা সবাই জানি, আমাদের দেশে অর্থ সবকিছুর নিয়ন্ত্রক হয়ে গেছে। এখানে নীতি-নৈতিকতা বলে কিছু নেই। ন্যায়-অন্যায় কেবল বইয়ের পাতায় শোভা পাচ্ছে। মানবজীবনে তার কোনো প্রতিফলন আমরা দেখি না। অর্থ আছে তো সাত খুন মাফ। যুগযুগ ধরে এসব কথা আমরা শুনে আসছি। এখনো শুনছি। অর্থ থাকলে বাঘের চোখও নাকি মেলে। অর্থ দিয়ে খুনের আসামিও পার পেয়ে যায়। আর ভালো মানুষ হয়ে যায় খুনি!
সাম্প্রতিক সময়কালে অসংখ্য ঘটনা আমরা দেখেছি। অর্থ কিভাবে সত্য ঘটনাকে মাটিচাপা দিয়েছে তার অসংখ্য উদাহরণ আমরা দিতে পারব। আবার এমন উদাহরণও দিতে পারব, যে সব ঘটনা অর্থ দিয়ে চাপা দেওয়া হয়েছিল; সেগুলো যারা ঘটিয়েছিল তাদেরকে খুব সহসাই প্রকৃতি কঠিন সাজা দিয়েছে। দুনিয়ার বিচারালয়ে বিচার পেতে দেরি হলেও প্রকৃতি দেরি করে না।
মন্ত্রিসভার সদস্য ডা. মুরাদ হাসান বেশ কিছুদিন ধরেই বেফাঁস কথা বলে সমালোচিত হচ্ছিলেন। কখনও কখনও তিনি এমন সব মন্তব্য করেছেন যা, তার শপথ ভঙ্গের কারণ হয়েছিল। রাশ টানা যায়নি কিছুতেই। তিনি অনেক সময়ই প্রধানমন্ত্রীকে বিব্রত করেছেন। দলকে তো করেছেনই। তিনি কথায় কথায় বলতেন, তিনি নাকি যা বলেন, তা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই বলে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী কি তাকে খালেদা জিয়া, তাঁর ছেলে বা তাঁর নাতনি সম্পর্কে আজে-বাজে মন্তব্য করার কোনো নির্দেশনা দিয়েছিলেন! এও কি সম্ভব!
আসলে গত কয়েকমাস ধরেই ডা. মুরাদের আচার আচরণ, কথাবার্তা, চাল-চলন কোনও কিছুই ঠিক ছিল না। কখনও কখনও মনে হয়েছিল, তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তার কথাবার্তা ছিল অসংযত। অসুস্থ মানুষের মতো। সেটা মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরাও অনুভব করেছেন। তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদও মঙ্গলবার সাংবাদিকদের ব্রিফ করার সময় এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, গত কয়েক মাস ধরেই তাকে আমার স্বাভাবিক মনে হয়নি।
অবশ্য গত সোমবার খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে ডা. মুরাদের বক্তব্য প্রত্যাহারের ব্যাপারে মতামত জানতে চান সাংবাদিকরা। তিনি জোর দিয়ে বলেন, বক্তব্য প্রত্যাহারের প্রশ্নই ওঠে না। তিনি যা বলেছেন তা নাকি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই বলেছেন। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আরও বলেন, আপনারা বিভ্রান্ত হবেন না। আমাকেও বিভ্রান্ত করবেন না। ডা. মুরাদের বক্তব্য যে সঠিক ছিল না; তা একদিনের মধ্যেই প্রমাণিত হলো। প্রধানমন্ত্রী তাকে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন।
ডা. মুরাদ নিজেই স্বীকার করেছেন, তার মুখ খুব খারাপ। তাই বলে মন্ত্রীর পদে বসে যা খুশি তা বলা যায়? যা খুশি তা করা যায়? অবশ্য হিতাহিত জ্ঞান হারালে মানুষ যা খুশি তা বলতেই পারেন?
গত সোমবার সকাল থেকেই ডা. মুরাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় বিএনপিসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। এর আগেও বিএনপি প্রতিমন্ত্রী মুরাদের বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছিল। সোমবার বিএনপি ডা. মুরাদের অপসারণ দাবি করে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সমাবেশে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ডা. মুরাদ এক সময় ছাত্রদল করত। পরে সে ছাত্রলীগে যোগ দেয়। ছাত্রদলের স্থানীয় কমিটি থেকে প্রেরণ করা সাংগঠনিক কমিটির তালিকাতেও মুরাদের নাম দেখা গেছে। এ বিষয়ে ডা. মুরাদ নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা দেবেন।
শুধু ডা. মুরাদই নন, মন্ত্রিসভার আরও কয়েকজন সদস্য প্রায়ই বেফাঁস কথা বলে সরকারকে বিব্রত করে থাকেন। বেশি কথা বললে বেফাঁস কথা বলবেন এটাই স্বাভাবিক। কথা বলার সময় তারা ভুলে যান যে, তারা দায়িত্বশীল পদে আছেন। দায়িত্বে থাকলে অনেককিছুই করা যায় না। অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। আবার সহ্যও করতে হয়। কঠিন সমালোচনার মুখোমুখি হলেও হাসিমুখে পরিস্থিতি সামলাতে হয়। অথচ আমাদের মন্ত্রীরা সমালোচনা সহ্যই করতে পারেন না। তারা প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে পুরো পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে ঠেলে দেন।
সবারই মুখের লাগাম টানা দরকার। সেই সঙ্গে নিজের লাগামটাও টেনে ধরা দরকার। ডা. মুরাদের লাগামহীন কথাবার্তাই তার জন্য কাল হয়েছে। গত কয়েক মাস তিনি বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। তার কর্মকাণ্ড সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল। কেউ কেউ তাকে লাগাম টানার পরামর্শও দিয়েছিল। কিন্তু তিনি গুরুত্ব দেননি। তাকে প্রধানমন্ত্রী হয়তো স্নেহ করতেন। কিন্তু তার মূল্য দেননি ডা. মুরাদ।
প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। তিনি সময়মত সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আগাছা কখন তুলে ফেলতে হয় তা তিনি ভালো করেই জানেন। জানেন বলেই তিনি গণমানুষের নেত্রী। তিনি দক্ষ শাসকও। তিনি এও জানেন, কখন এবং কোথায় থামতে হয়। সে অনুযায়ী তিনি সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর ধ্যানজ্ঞান হচ্ছে বাংলাদেশ। এই দেশের ভালোর জন্য, দেশকে গড়ে তোলার জন্য যা যা করা দরকার তা তিনি করবেন। আশা করি, মন্ত্রি-এমপিরা এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নেবেন এবং নিজেদেরকে সংযত রাখবেন। যথাযথভাবে তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, ঢাকাপ্রকাশ ও সাহিত্যিক