জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েই লবিস্ট ইস্যুকে দেখতে হবে
গত ১০ ডিসেম্বর র্যাবের সাত কর্মকর্তার উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এ নিয়ে তারপর থেকেই নানারকম বিচার বিশ্লেষণ হচ্ছে। সরকার এ নিয়ে বিব্রত হয়েছে। হতাশও হয়েছে। আমরাও খানিকটা হতাশ এবং বিব্রত। দেশের দুটি বাহিনীর কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আরোপ করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে–কারা এর পেছনে আছে, তাদের কর্মকাণ্ডে দেশের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কি না? এটি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কীভাবে সংযুক্ত হওয়া যায়? এই বিষয়গুলোই আলোচনার প্রধান ট্রেন্ড।
এ ক্ষেত্রে আলোচনায় আসে লবিস্ট নিয়োগের প্রশ্নটি। লবিস্ট নিয়োগ মার্কিন প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে বৈধ। বিভিন্ন দেশের সরকার, প্রতিষ্ঠান জাতীয় স্বার্থে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এ ধরনের লবিং করে থাকে। কাজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে লবিস্ট নিয়োগ করা অথবা নিয়োগ পাওয়া কোনো বেআইনি কাজ নয় এবং একেবারে অপ্রচলিত ব্যবস্থাও নয়।
লবিস্ট নিয়োগ কেন? এই বিষয়টির সঙ্গে আমরা বিশেষভাবে পরিচিত না। এ কারণেই বিভিন্ন ধরনের বিতর্ক হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে লবিস্ট নিয়োগ বৈধ এবং তাদের আইনি প্রক্রিয়ায় সেটি আছে। তাদের জুডিশিয়ারি অর্থাৎ জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট তাদের আইনের অনুমোদন নিয়েই তারা সেটি করে। প্রশ্ন হলো–এসব কারা করছে, কেন করছে? আমি মনে করি, বাংলাদেশের পক্ষে যা জাতীয় স্বার্থের পক্ষে, বিষয়টি তেমন হলেই উত্তম। বাংলাদেশের স্বার্থ বলতে তো আমরা এটিকে মিলিয়ে গুলিয়ে ফেলি। সেখানে আমার মনে হয় একটি স্বচ্ছতা দরকার। আমরা যেটি জাতীয় স্বার্থ বলি, তার মধ্যে সরকার থাকে, এর পাশাপাশি জনগণের স্বার্থের একটি বিষয় থাকে। এই দুটির সমন্বিত অবস্থাকেই জাতীয় স্বার্থ বলা হয়। কাজেই বিভিন্ন দেশ থেকে যে লবিস্ট নেওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রে, তারা সাধারণত তাদের জাতীয় স্বার্থটুকুই দেখে। যেমন–সরকার থেকে বিজিএমইএ পর্যন্ত এই উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়। এখন যদি কেউ সরকারের দিক থেকে করে সরকার সেটি জাতীয় স্বার্থের জন্য কাজ করবে ধরে নেওয়া হয়। সবসময় যে সেটি হয়, তাও না। আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের আলোকে আমরা সবসময় সবখানে সেই স্বচ্ছতাটুকু পাই না। সরকার যখন করেন আমরা ধরেই নিই যে সরকার সেটি দেশের পক্ষেই করছেন।
আমাদের তৈরি পোশাক খাত রপ্তানি বাণিজ্যের অন্যতম উপাদান হিসেবেই আছে এবং দেশের জনগোষ্ঠীর বিরাট একটি অংশ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রায় পঞ্চাশ লাখ মানুষ এ পেশায় জড়িত এবং তার বেশিরভাগই নারী। তা ছাড়া আমাদের একটি উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি হয়েছে, তারা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানি হয়। বিদেশের মানুষ যখন বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত পণ্য দেখে তখন তারা বুঝতে পারে যে, বাংলাদেশ আর দারিদ্রপীড়িত দেশ নয়। বাংলাদেশ এমন একটি জায়গায় এসেছে, যেখান থেকে তারা এই ধরনের কোয়ালিটি পণ্য রপ্তানি করে। এই বিষয়গুলোকে যদি আমরা সমন্বিতভাবে দেখি, তাহলে বুঝতে পারব এই বিষয়টিতেও জাতীয় স্বার্থ জড়িত। কাজেই সেই বিবেচনায় এটিকে ইতিবাচক প্রেক্ষাপটে দেখতে পারি।
বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরে আইনি কাঠামো আছে। আমরা যে কাজটি করছি সেটি সেটি সেই কাঠামোর ভিতরে পড়ে কি না। সেটি বৈধ উদ্দেশ্য নিয়ে করা হচ্ছে কি না। নাকি এটি বিশেষগোষ্ঠী বিশেষ স্বার্থের হয়ে কাজ করছে। সেটি বিচার বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ স্বচ্ছতা বজায় রাখার প্রয়োজনে এ বিষয়টি নিয়ে ভাবার প্রয়োজন আছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই যে সাত জন কর্মকর্তাকে নিয়ে সমস্যাটি হলো–যে ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও সাতটি প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘের কাছে আরও আবেদন করেছে যে, র্যাব কর্মকর্তাদের যেন জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা না হয়। যদিও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি; কিন্তু এটি পরোক্ষভাবে বা নৈতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করার একটি পন্থা।
এখন এখান থেকে বেরুনোর পথ কি হওয়া উচিত। আমাদের অভ্যন্তরীণভাবেই কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের যদি ঘাটতি থাকে, সেগুলো আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করব। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যে দেশের পক্ষে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। আমি মনে করি, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যটি ইতিবাচক। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মানবাধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার। তাহলে এই ধরনের ঘটনা এভয়েড করা যাবে। তারা যে কাজটি করেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করবেন। কূটনৈতিকভাবেই এর সমাধানে চেষ্টা করতে হবে।
অনেকগুলো প্ল্যাটফর্ম আছে, সেগুলো আমরা ব্যবহার করতে পারি। এ বিষয়ে রাজনৈতিকভাবে বহুমুখী আলাপ-আলোচনা আমি মনে করি, মূল বিষয়টিকে ভিন্নদিকে নিয়ে যেতে পারে। কাজেই যে বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, সেগুলোর বস্তুনিষ্ঠ সমাধান নিয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। আমাদের দেশ থেকে কয়েকজন প্রতিনিধি যাবেন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের বক্তব্য তুলে ধরার জন্য। আমরা যে বিশ্বাসযোগ্য সমাধানের পক্ষে, এটি তাদের বোঝাতে সক্ষম হতে হবে। আমাদের দেশে যে রেমিট্যান্স আসে, তারমধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম রেমিট্যান্স কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেই আসে। প্রথম অবস্থানে আছে সৌদি আরব, দ্বিতীয় অবস্থানে ইউএই এবং তিন নম্বরে আছে যুক্তরাষ্ট্র। যেটি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সক্রিয় করার জন্য ভূমিকা পালন করছে। তা ছাড়া আমাদের দেশের রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জোরালোভাবেই আমাদের সমর্থন দিয়েছে। তবে ভবিষ্যতেও আমাদের সমস্যা সমাধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দরকার হবে। ভবিষ্যতে মিয়ানমারকে যদি বাধ্য করা হয়, সে ক্ষেত্রেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আমাদের দরকার হবে। অর্থনৈতিকভাবে এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে যেন কাজে লাগে, সেক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত দুইবছর থেকেও বলছেন। আমাদের অর্থনৈতিক জায়গা অর্থাৎ যেখানে আমাদের সবচেয়ে বেশি কাজে লাগবে, সেই জায়গাটিতে যদি আমরা তাদের পাই, সে ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বহুমুখী সম্পর্ককে আমাদের সমৃদ্ধ করতে হবে। সেজন্য আমাদের উদ্যোগটি চালু করতে হবে এবং এ ধরনের বিষয়গুলো যেন আমাদের ইরিটেট করতে না পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
বাইডেন সরকার গত কয়েকবছর ধরে যে সমস্যাগুলো মোকাবিলা করছে, সেগুলো দূর করতেই মানবাধিকারের প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করেছে। বৈশ্বিক গুরুত্ব যদি আমরা মনে রাখি, তাহলে আমাদের জন্য তাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করা সহজতর হবে। আমরা তো বাংলাদেশে নির্ভেজাল গণতন্ত্রটুকুই চাই। ত্রিশ লাখ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রাণ দিয়েছে গণতন্ত্রের জন্য। এখনো পর্যন্ত মানুষ গণতন্ত্র চর্চার জন্য উদগ্রীব। এরিস্টটলের ভাষায়, ‘গণতন্ত্র হচ্ছে সবচেয়ে ভালো শাসন ব্যবস্থা।’
আমাদের মতো একটি দেশ যেখানে লাখো প্রাণের বিনিময়ে দেশটি পেয়েছি, সেই দেশে বিভেদ, বিভাজন, বৈষম্যমুক্ত এবং শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রাখব বলে গণতন্ত্র চর্চা করব তা কিন্তু না। আমাদের অভ্যন্তরে একটি শান্তিপূর্ণ সুশাসন, শিক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে সঠিকভাবে গণতন্ত্রচর্চার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করব এবং ভবিষ্যতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের মানোন্নয়নসহ এই সম্পর্ককে চলমান করতে সচেষ্ট করব। এ ধরনের সমস্যাকে খুব বেশি গুরুত্ব বা রাজনৈতিক ইস্যু না করে সমাধানের পথ তৈরি করার মাধ্যমে এই বহুমাত্রিক সম্পর্ককে আরও বেশি সমৃদ্ধ করতে হবে।
লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত
এসএ/