নদী দখলদার চিহ্নিত কিন্তু তারপর?
বীরভোগ্যা বসুন্ধরা এবং সর্বংসহা ধরিত্রী কথা দুটো শুধু প্রচলিত তাই নয় বাংলাদেশে বহুল ব্যবহৃতও বটে। দেশের নদী দখল ও দূষণের চিত্র দেখলে আর তার দখলদারদের চরিত্র দেখলে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। চোখে দেখার সাথে সাথে নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন দেখলে সন্দেহ সত্যে পরিণত হয়। একথা এখন সত্য যে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক জনগণ কথাটি কাগজে লেখার বাইরে সমাজে ভিত্তি পায়নি। নদী মাতৃক বাংলাদেশে সবচেয়ে বিপন্ন দশায় পড়েছে আমাদের নদীগুলো।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের গত ২০১৯ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দেশের ৭৭০টি নদীর জমি দখল করেছে ৫৭ হাজার ৩৯০ ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান। তারা এটাও উল্লেখ করেছিলেন দখলদারদের অনেকেই স্থানীয় এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী।
সংসদীয় কমিটির কাছে জমা দেয়া কমিশনের প্রতিবেদন এনআরসিসি জানায়, প্রতিটি বিভাগেই নদী ও নদীর তীরে বিশালাকার কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। দখলদাররা স্থানীয়ভাবে শক্তিশালী এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় সেগুলো ভেঙ্গে ফেলা যায়নি। প্রতিবেদনে এনআরসিসি আরও বলেছে, বার বার চেষ্টা করেও বিভিন্ন সরকারি অবকাঠামোগুলোও সরানো যায়নি। একদিকে উচ্ছেদ অন্যদিকে দখল সমানতালেই চলছে। ফলে ঢাক ঢোল পিটিয়ে দখলদার উচ্ছেদ ও দখল মুক্ত করা হলেও ২০২০ সালে দেশের ৬৪ জেলায় নদী দখলদারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৩ হাজার। এই হিসাব তুলে ধরা হয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে। যা ২০১৮ সালের হিসাবে ছিল ৫০ হাজারের মতো। কমিশনের ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে নদী দখলদারদের সংখ্যা ছিল ৫৭ হাজার।
প্রতিবেদন অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি নদী দখলদার খুলনা বিভাগে। সেখানে সংখ্যাটি ১১ হাজার ২৪৫ জন। । নদী দখলদারের সংখ্যা সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে ২ হাজার ৪৪ জন। ঢাকা বিভাগে নদী দখলদারের সংখ্যা ৮ হাজার ৮৯০ জন। ঢাকা জেলায় বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, ইছামতি, বালু, বংশী, গাজীখালী, কালীগঙ্গাসহ মোট ১১টি নদী ও ২০১টি খালের উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে।
ঢাকা জেলায় নদী দখলদারের সংখ্যা ৬ হাজার ৭৫৮ জন। নদী দখলের সঙ্গে যুক্তদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক পরিচয়ে প্রভাবশালী। কমিশনের হিসাব অনুযায়ী শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জে নয়টি নদী ও ২১৮টি খাল রয়েছে। সেখানে নদী ও খাল দখলদারের সংখ্যা ৭৮৫ জন। ছোট বড় সবকটি নদী ও খাল দখল হয়েছে। বেশি দখল হয়েছে শিল্পায়নের নামে। সরাসরি নদীর জমি দখল করেই নির্মাণ করা হয়েছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান।
ফরিদপুর জেলায় ১৩টি নদী ও ১৫টি খাল রয়েছে এখানে দখলদারের সংখ্যা ১ হাজার ৮৩৪ জন। টাঙ্গাইল জেলায় নদী দখলদারের সংখ্যা ১ হাজার ৭৮৮ জন। দখলদারের সংখ্যা ও নাম জানা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও সক্ষমতা না থাকার কারণে পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রত্যাশিত উচ্ছেদ অভিযান চালানো সম্ভব হয়নি বলে কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সেইসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে যে, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে গত বছর উচ্ছেদ অভিযান বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
১ হাজার ৪৫৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন তাদের কার্যাবলী, দেশের নদ-নদী পরিদর্শন ও পরিবীক্ষণ কার্যক্রম, প্রশাসনিক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি নদ-নদীর চিহ্নিত সমস্যা ও সমাধানে সুপারিশ, গৃহীত পদক্ষেপ ও অগ্রগতি তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু এই প্রতিবেদনকে বিবেচনায় নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ এখনও দৃশ্যমান হয়নি।
ইতিমধ্যে তুরাগ নদী রক্ষা নিয়ে এক রিট মামলার রায়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ এক ঐতিহাসিক নিদের্শনা দেন। তুরাগ নদকে ‘লিগ্যাল পারসন, জুরিসটিক পারসন ও জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করে হাইকোর্টের্ দেয়া রায়ে দেশের নদ-নদী রক্ষায় প্রতিরোধমূলক বেশ কয়েক দফা নিদের্শনা দেয়া হয়েছে। নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে দেয়া রায় দেশের ইতিহাসে এই প্রথম। এতে একজন মানুষের মতো নদীও আইনগত অধিকার পাওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(ক), ১৯ ও ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জনগণের জানমাল, সম্পদ, স্বাস্থ্য, পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাই রায়ে ডকট্রিন অব পাবলিক ট্রাস্টকে ল অব দ্য ল্যান্ড ঘোষণা করে বেশ কটি সিদ্ধান্ত দিয়েছে আদালত। এতে বলা হয়েছে, দেশের সব নদ-নদী, পাহাড়-পবর্ত, সমুদ্রসৈকত, বন, খাল-বিল, জলাশয়-জলাধারের মালিক হিসেবে ট্রাস্টির দায়িত্ব পালন করবে রাষ্ট্র। নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয় রক্ষার আইনগত অভিভাবক হবে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়ের সুরক্ষা, সংরক্ষণ, অবৈধ দখল উচ্ছেদ, শ্রীবৃদ্ধিসহ সব দায়িত্ব পালন করবে নদী রক্ষা কমিশন। অন্যদিকে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নদী রক্ষা কমিশন যাতে কাযর্কর ভূমিকা রাখতে পারে, তা নিশ্চিত করতে আদালতের রায়ে সরকারকে চার দফা নিদের্শনা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয় দখলকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে এর কঠিন সাজা ও জরিমানা নিধার্রণ করতে হবে। নদ-নদীর পাশে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের অনাপত্তিপত্র নিতে হবে। বিষয়টি সরকারের সব বিভাগকে চিঠি দিয়ে জানাতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নিদের্শ দিয়েছে আদালত। আদালত বলছে, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশের সব নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়ের অবস্থান চিহ্নিত ও নিণর্য় করে একটি ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে। সেই ডাটাবেজ দেশের সব ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা, জেলা ও বিভাগে নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। যে কোনো নাগরিক যেন নিদির্ষ্ট ফি দিয়ে নদ-নদীর ম্যাপ, তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
নদী ও জলাশয়ের দখল বন্ধ করতে কিছু প্রতিরোধমূলক নিদের্শনাও দিয়েছে আদালত। এসব নিদের্শনার মধ্যে রয়েছে প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদকে নিজের এলাকার নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়ের অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিত করে তাদের নামের তালিকা জনসম্মুখে ও পত্রিকায় প্রকাশ করতে হবে। নদী বা জলাশয় দখলকারী বা অবৈধ স্থাপনা নিমার্ণকারীরা ব্যাংক ঋণ পাওয়ার অযোগ্য বিবেচিত হবেন। ঋণ আবেদনকারীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। যে কোনো নিবার্চনে প্রার্থীর বিরুদ্ধে নদী দখলের অভিযোগ থাকলে তাকে নিবার্চনের অযোগ্য ঘোষণা করবে নিবার্চন কমিশন। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতি দুই মাসে কমপক্ষে ১ ঘণ্টা নদী রক্ষা, সুরক্ষা, দূষণ প্রতিরোধ, নদ-নদীর প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সচেতনতামূলক পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ নিদের্শনা বাস্তবায়ন করবে। দেশের সব শিল্প-কারখানার শ্রমিক-কমর্চারীর অংশগ্রহণে প্রতি দুই মাস একদিন ১ ঘণ্টা সচেতনতামূলক সভা বা বৈঠক করতে হবে। শিল্পমন্ত্রণালয় এ নিদের্শনা বাস্তবায়ন করবে। প্রতিটি ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা, জেলা ও বিভাগে তিন মাসে একবার নদী বিষয়ে দিনব্যাপী সভা-সমাবেশ, সেমিনার করতে নিদের্শ দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষ এ নিদের্শনা বাস্তবায়ন করবে। আদালতের আরেক রায়ে বলা হয়েছে, নদীর সীমানার জায়গায় ক্রয়সূত্রে অন্যের মালিকানস্বত্ব সৃষ্টি হয় না। ঢাকার চার নদ-নদীর রিট মামলার রায়, সংবিধানর ১৮(ক) অনুচ্ছেদ, পরিবেশ আইন, ১৯৯৫ ও জলধার আইন, ২০০০-এর বিধান অনুযায়ী নদ-নদীর সীমানা দখল সম্পূণর্ বেআইনি ও পরিবেশ বিরোধী।
দেশে একসময় ২৪ হাজার কিলোমিটার নদীপথ ছিল। দখল, দূষণ ও ভরাটে হারিয়ে গেছে ১৯ হাজার কিলোমিটার নৌপথ। বর্তমানে ৫ হাজার কিলোমিটারেরও কম নদীপথে চলছে নৌযান।
সারাদেশে ৫৩টি রুটের ১২ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খননের জন্য ২০১২ সালে ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প গ্রহণ করে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। প্রাথমিক পর্যায়ে ২৪টি রুটে ১ হাজার ২৪ কিলোমিটার নৌপথ খননের কাজ ২০২১ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল কিন্তু গত ৮ বছরে ৭৫ শতাংশ নদী খনন কাজ শেষ হয়েছে বলে প্রকল্প সূত্র থেকে জানা গেছে।
এ ছাড়া গোমতী ও ব্রহ্মপুত্রসহ আগামী ৪-৫ বছরে প্রায় ১০ হাজার নৌপথ উদ্ধার করা হবে। এ সমস্ত আশাবাদের পাশাপাশি কয়েক দশকে চোখের সামনে নদীগুলো দখল হয়েছে একথা কেউ অস্বীকার করবেন না। সবাই আশাবাদ ব্যক্ত করেন, সমন্বিত প্রচেষ্টা থাকলে দখল মুক্ত করা সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে নদী ও পরিবেশ রক্ষায় আইন হয়েছে। কিন্তু আইন দিয়ে ক্ষমতাসীনদের নদী দখলের অভ্যাস দূর করা যাচ্ছে না। আর্থিক ক্ষমতা আর রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছে নদী আর মানুষ অসহায় হয়ে পড়ছে দিন দিন। একদিকে ভারতের পানি আগ্রাসন অন্যদিকে দেশে দখল দূষণ নদীকে বিপন্ন করে তুলছে।
খাবার পানি, গৃহস্থালি কাজ, মৎস্য সম্পদ আহরণ, কৃষিকাজ, শিল্প কারখানায় ব্যবহার, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বনভুমি রক্ষাসহ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ইত্যাদি সকল কাজে যে পানি লাগে তার প্রধান উৎস নদী। নদী আমাদেরকে বাঁচায় এখন দখল ও দূষণকারীর হাত থেকে নদীকে বাঁচাবে কে?
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)