রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে নির্মিত কুষ্টিয়ার কুঠিবাড়ি ‘টেগর লজ’
সাংস্কৃতিক রাজধানী কুষ্টিয়ায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে নির্মিত স্মৃতিমাখা ‘টেগর লজ’ আজও কালের সাক্ষী হয়ে কুষ্টিয়া শহরের মিলপাড়ায় কবি আজিজুর রহমান সড়কে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কবির স্মৃতিবিজড়িত শিলাইদহ ‘কুঠিবাড়ি’ সবার কাছে পরিচিত হলেও তার স্মৃতিধন্য ‘টেগর লজ’ এখনও রয়েছে অনেকের কাছেই অজানা।
জমিদারি পরিচালনার সূত্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পূর্ব বাংলার যোগাযোগ। ১৮৯০ সালে শিলাইদহ-শাহাজাদপুর-পতিসরের জমিদারির দায়িত্বভার নিয়ে তিনি এই অঞ্চলে আসেন। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষের নিবাস ছিল পূর্ববঙ্গেই, সেকালের বৃহত্তর যশোর জেলায়। আর রবীন্দ্রনাথের বিয়েও হয় খুলনা জেলার ফুলতলা থানার দক্ষিণডিঙ্গি গ্রামের ভবতারিণীর (মৃণালিনী দেবী) সঙ্গে। ‘পদ্মা-প্রবাহ-চুম্বিত’ শিলাইদহের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল অতি নিবিড়। তার ভাষায়–‘জমিদারি ও আসমানদারি’র দ্বৈতপালার রঙ্গভূমি এই অঞ্চলে। রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত আরেকটি অনাদৃত-অবহেলিত-বিস্মৃত বাড়ি কুষ্টিয়া শহরের পূর্ব সীমান্তের ‘টেগর লজ’। এই বাড়িকে ঘিরে মূলত রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুর পরিবারের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। দ্বারকানাথ ঠাকুর একদিকে জমিদারি-প্রসার, অপরদিকে ব্যবসায়ের প্রতিও মনোযোগী ছিলেন। এ ধারা তার উত্তরপুরুষদের মধ্যেও বজায় ছিল। উনিশ শতকের শেষ দিকে ‘টেগর অ্যান্ড কোম্পানি’র ব্যবসা প্রসার ও পরিচালনার জন্য কুষ্টিয়া শহরের পূর্ব প্রান্তে ‘টেগর লজ’ নামের লাল রঙের দোতলা বাড়িটি কুষ্টিয়ার বড় রেলস্টেশনের দক্ষিণ পাশে নির্মিত হয়।
রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি জমিদারি দেখাশুনা ও ব্যবসা বাণিজ্যের প্রতিও প্রথমদিকে তার বিশেষ মনোযোগ ও আগ্রহ ছিল। জমিদারি পরিচালনায় পুরোনো প্রথা ও পদ্ধতি ভেঙে তিনি প্রজা কল্যাণের সদিচ্ছাপূরণে নতুন ব্যবস্থার প্রচলন করেন। ১৮৯১ সালে শিলাইদহে ব্যবসা পরিচালনার জন্য রবীন্দ্রনাথ ‘টেগর অ্যান্ড কোম্পানি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। পরে ১৮৯৫ সালে ‘টেগর অ্যান্ড কোম্পানি’র অফিস স্থাপন করা হয় ‘টেগর লজে’। এখান থেকেই সমস্ত ব্যবসায়িক কাজ পরিচালনা করতেন। তখন এর সদর দফতর ছিল কলকাতায়। রবীন্দ্রনাথের এই কাজে প্রধান সহযোগী ছিলেন দুই ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ও বলেন্দ্রনাথ। ‘শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ’ (১৩৮০) গ্রন্থের লেখক শচীন্দ্রনাথ অধিকারি লিখেছেন, ‘এই সময় মফস্বল জমিদারি থেকে ভুষো মাল আর পাট কিনে বাঁধাই কারবার চালাবার জন্য শিলাইদহে ঠাকুর কোম্পানির প্রতিষ্ঠা হয়–তার অফিস কুষ্টিয়াতেও ছিল।’ পরে এই কোম্পানির প্রধান অফিস কুষ্টিয়া কুঠিবাড়িতে (কুষ্টিয়া মোহিনী মিলের নিকট) উঠে আসে। ঠাকুরবাবুদের কুষ্টিয়া কুঠিবাড়ির দোতলার ফটকে সাদা পাথরে এখনও লেখা আছে ‘টেগর অ্যান্ড কোং’। ভুষিমালের ব্যবসার পাশাপাশি এখানে জুট বেলিং প্রেসও স্থাপন করেন। এরপর আখমাড়াই কলের ব্যবসা এর সঙ্গে যুক্ত হয়। পরে উইলিয়াম রেণউইকের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘রেনউইক অ্যান্ড কোম্পানি’ আখমাড়াই কল তৈরির কাজে হাত দেয় যার একমাত্র প্রতিযোগী ছিল ‘টেগর অ্যান্ড কোম্পানি’।
প্রথম দিকে ‘টেগর অ্যান্ড কোং’ বেশ ভালোভাবেই চলে এবং কোম্পানির লাভও হয়; কিন্তু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গাফিলতি ও অসাধুতার ফলে কোম্পানি ক্রমাগত ক্ষতি স্বীকার করতে থাকে। শচীন্দ্রনাথ অধিকারীর তথ্যমতে, ‘এই ব্যবসায়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ পাটের কারবারে নিজে লক্ষাধিক টাকা ঋণগ্রস্থ হন।’ কিন্তু কোম্পানি ক্রমাগত লোকসান দিতে থাকে। এইরকম একটা সংকটাপন্ন সময়ে (আষাঢ় ১৩০২, জুন ১৮৯৫) ‘টেগর অ্যান্ড কোং’-এর সঙ্গে যুক্ত হন রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি খুলনার দক্ষিণডিঙ্গি গ্রামের এক উদ্যোগী তরুণ যজ্ঞেশ্বর সর। যজ্ঞেশ্বরের অক্লান্ত চেষ্টায় কোম্পানির কিছুটা উন্নতি হলেও শেষরক্ষা হয়নি। এই ব্যবসায়ের বিপর্যয়ে রবীন্দ্রনাথের উৎকন্ঠার পরিচয় মেলে তাঁর এক চিঠিতে (৬ পৌষ ১৩১৫, ২০ ডিসেম্বর ১৯০৮) সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘যজ্ঞেশ্বর যে প্রস্তাব করিয়াছে তাহাতে আমার অসম্মতি নাই, কিন্তু জিজ্ঞাসা এই যে সে কি উপযুক্ত জামিন দিতে পারিবে? প্রত্যেক বৎসরই সে আমাদিগকে মুনাফা আশা দিয়া কেবলই দেনা বাড়াইয়াছে ইহা দেখিয়া একাজ বন্ধ করিয়া দিবার জন্য আমি ব্যস্ত হইয়াছি। যজ্ঞেশ্বরকে এই কল খাটাইতে দেওয়া যদি নিরাপদ হয় তবে আমার আপত্তি নাই। ...বিশ্বাস বলিয়াছে তাহার মনিব আমাদের কলকারখানা বাদে কুষ্টিয়ার কুঠিবাড়ি ও গুদামঘর প্রভৃতি উপযুক্ত মূল্যে ক্রয় করিতে প্রস্তুত আছে। যদি তাহারা ১৫/২০ হাজার টাকায় খরিদ করে তবে বেচিয়ে ফেলাই সঙ্গত মনে করি। তাহার পরে কলগুলা লইয়া যজ্ঞেশ্বর অন্তত: বাজারের দেনা শোধ করিয়া দেয় তাহা হইলে সেও লাভ, নতুবা কোন সুবিধা দেখিনা।’
সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যে বিশেষ নজর দিলেও একসময় রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, ‘ব্যবসা চালানো আমার কর্ম নয়।’ কোম্পানির ক্ষতি ও দায় ক্রমেই বেড়ে চলতে থাকায় শেষপর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ যজ্ঞেশ্বরকে মাত্র তিন হাজার টাকার বিনিময়ে ‘কলকব্জা ও মালামাল’ দান করে দেন। শুধু তাই নয়, ‘টেগর লজ’ অর্থাৎ কুষ্টিয়া কুঠিবাড়ির পূর্বদিকের ফ্যাক্টরি ও বসতবাড়ি বাবদ দুই বিঘা জমিও বার্ষিক পঞ্চাশ টাকা খাজনার বিনিময়ে বন্দোবস্ত দেন। পরে এই জায়গায় যজ্ঞেশ্বর বিরাট এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন ‘যজ্ঞেশ্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস’ নামে, হাতবদলের পরেও যার অস্তিত্ব এখনো বিলুপ্ত হয়নি।
‘টেগর লজে’র সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রচিত হয়েছিল মূলত ব্যবসায়িক সূত্রে। তিনি নিজেই এই ভবনের নাম দিয়েছিলেন ‘কুষ্টিয়া কুঠিবাড়ি’। অনেক সময় কলকাতা থেকে ট্রেনে কুষ্টিয়ায় নেমে শিলাইদহে যাওয়ার পথে ‘টেগর লজে’ বিশ্রাম নিতেন কিংবা রাত্রিবাস করতেন। ‘টেগর লজে’ রবীন্দ্রনাথের শ্যালক নগেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরীও কিছুকাল বাস করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে কুষ্টিয়ায় এসে আহার-বিশ্রাম করে শিলাইদহে যেতেন তা যজ্ঞেশ্বরকে আগেই জানিয়ে রাখতেন। একদিনের ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় শ্রীশচীন্দ্রনাথ অধিকারীর লেখায়, “যথাসময়ে রবীন্দ্রনাথ এসে কুষ্টিয়া কুঠিবাড়িতে উঠলেন। অভ্যর্থনাদির শেষে স্নান সেরে তিনি খেতে বসলেন। খাবার ঘরে গিয়ে দেখেন, কাঁঠাল কাঠের প্রকাণ্ড একখানা পিঁড়ি, পাকা সোনার মত তার রঙ। আর তার সামনে জুড়ে রকমারি খাবার থালায়, বাটিতে নানান কায়দায় থরে থরে সাজানো। গরম খাবারের সুগন্ধে ঘরখানা ম ম করছে। ঘরখানাতে যজ্ঞেশ্বর বাবু ছাড়া আর কেউ নেই। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘যজ্ঞেশ্বর, এসব করেছ কী? ডালবাটা ভাতে আর আলুভাতেই আমি ভালবাসি। তুমি এসব কি কাণ্ড করে ফেলেছ, বল দেখি।’ ...খেতে বসে রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেলেন রকমারি খাদ্য সম্ভারের মধ্যেও তাঁর ফরমায়েসি ডালবাটা সেদ্ধ ও আলুভাতে আছে। বিপুল খাদ্য সমাবেশের সব রকমই একটু একটু করে মুখে দিয়ে তিনি বললেন, ‘যজ্ঞেশ্বর এসব কি করে খাব, বলে দাও।’ বলেই একটু একটু করে খেতে খেতে কবি দেখেন, একখানা বড় ডিসে এক ফুট লম্বা প্রকাণ্ড দুখানা চিতল মাছের পেট যেন সোনা মেখে হাসছে। আয়োজন দেখে রবীন্দ্রনাথের বোধ হয় বেশ ভাল রকম ক্ষুধার উদ্রেক হয়েছিল। তিনি একখানা মাছই খেয়ে ফেললেন। অন্যান্য অনেক রকমের মাছ মাংস ইত্যাদি একটু একটু মুখে দিয়ে উঠতে যাবেন, এমন সময়ে যজ্ঞেশ্বর বললেন, হুজুর এ ডিস খানায় হাত দিতেই ভুলে গেছেন। এতে আছে কুষ্টিয়ার তৈরি ভাল ‘রাঘবসই’। এর একটা খেতেই হবে। রবীন্দ্রনাথ তার একখানা খেয়ে ফেললেন; বললেন, ‘চমৎকার!’”
রবীন্দ্রনাথ শেষবারের মতো ১৯২২ সালের জানুয়ারি মাসে শিলাইদহে আসেন। ‘টেগর লজে’র পাশেই কুষ্টিয়া স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে কলকাতায় যান। যজ্ঞেশ্বর তাকে সামান্য ক্ষণের জন্য হলেও ‘টেগর লজে’ নিয়ে যেতে স্টেশনে আসেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সেই আমন্ত্রণের অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘সেদিন আর নেই যজ্ঞেশ্বর, আজ আমি ভূতের বোঝা বয়ে ক্লান্ত।’ রবীন্দ্রনাথ ‘টেগর লজে’ বসেই কুষ্টিয়া রেলস্টেশন সংলগ্ন্ন বসন্তের ফুলে ভরা একটি কুরচি গাছ নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। ১০ বৈশাখ ১৩৩৪/২৩ এপ্রিল ১৯২৭ এ লেখা ‘কুরচি’ নামে কবিতাটি পরে বনবাণী (১৩৩৮/১৯৩১) গ্রন্থে লিখিত আছে। কবিতা শুরুর ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন, ‘অনেককাল পূর্বে শিলাইদহ থেকে কলকাতায় আসছিলাম। কুষ্টিয়া স্টেশনঘরের পিছনের দেয়ালঘেঁষা এক কুরচিগাছ চোখে পড়ল। সমস্ত গাছটি ফুলের ঐশ্বর্যে মহিমান্বিত। চারদিকে হাটবাজার; একদিকে রেলের লাইন, অন্যদিকে গরুর গাড়ির ভিড়, বাতাস ধুলোয় নিবিড়। এমন অজায়গায় পিডাব্লিউডি স্বরচিত প্রাচীরের গায়ে ঠেস দিয়ে এই কুরচিগাছ তার সমস্ত শক্তিতে বসন্তের জয় ঘোষণা করছে, উপেক্ষিত বসন্তের প্রতি তার অভিবাদন সমস্ত হট্টগোলের উপরে যাতে ছড়িয়ে ওঠে এই যেন তার প্রাণপণ চেষ্টা। কুরচির সঙ্গে এই আমার প্রথম পরিচয়।’ হয়তো রবীন্দ্রনাথের এই কলকাতা গমনের যাত্রাবিরতিতে তার স্পর্শ পেয়েছিল ‘টেগর লজ’। রবীন্দ্রনাথ ‘কুষ্টিয়া কুঠিবাড়ি’ থেকে বেশকিছু চিঠিপত্র লিখেছিলেন তা বেশ জানা যায়। তবে এখানকার জনপদের ইতিহাস নদীর মতোই উদার, মহান ও বিশালতায় পূর্ণ।
শুধু জমিদারিত্বই নয়, এ অঞ্চল ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য সৃষ্টির এক অপূর্ব প্রেরণা। এখানে বসেই তিনি রচনা করেন মানসী, সোনারতরী, চিত্রা, বলাকা, ক্ষণিকা, নৈবদ্য প্রভৃতি কবিতা। তার অনবদ্য সৃষ্টি গল্পগুচ্ছের অধিকাংশ গল্প রচিত হয়েছিল এখানে। এমনকি গীতাঞ্জলির অধিকাংশ গান সৃষ্টি হয় কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। ১৮৯০ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ বিচরণ করেছেন তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান টেগর লজে। জমিদারির কাজে কিংবা ব্যবসার কাজে কখনো স্বল্প কখনো দীর্ঘ সময় থেকেছেন এখানেই। এসেছেন একাকী কিংবা সপরিবারে। ঘুরে বেড়িয়েছেন বোটে, পালকিতে। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কুষ্টিয়ার টেগর লজ ও শিলাইদহে অবস্থানকালেই কবি এ অঞ্চলের বাউল ও বাউল সুরের প্রতি আকৃষ্ট হন।
স্বাধীনতার পর কবির স্মৃতিধন্য বাড়িটিকে রক্ষার উদ্যোগ নেন কুষ্টিয়া পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান ম. আব্দুর রহিম। বাড়িটি পৌরসভার নামে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য তিনি উচ্চমহলে বারবার দেখা করেছেন। এরই একপর্যায়ে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কুষ্টিয়া সফরে এলে তিনি ‘টেগর লজ’ পৌরসভার কাছে হস্তান্তর করার আবেদন জানান। বঙ্গবন্ধু কবিগুরুর স্মৃতিধন্য বাড়িটির মর্যাদা ও গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তৎকালীন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন। কিন্তু বাড়িটির মালিকানা যেহেতু ব্যক্তি পর্যায়ে, তাই পৌরসভাকে হস্তান্তর করা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শহিদ হওয়ার পর ‘টেগর লজ’ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে বাড়িটি আরও জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে পৌরসভার বর্তমান মেয়র আনোয়ার আলী ১৯৮০ সালে আবার বাড়িটি পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেন। কিন্তু আবারও সেই জটিলতা। এক পর্যায়ে মালিক পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ২০০৪ সালে পৌরসভার পক্ষে পাঁচ লাখ টাকায় বাড়িটি কিনে নেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় সংস্কারের কাজ।
বর্তমানে বাড়িটি কুঠিবাড়ির ন্যায় রং করা হয়েছে। দেয়ালে ঝুলানো কবির আঁকা ১২টি ছবির অনুকৃতি। দক্ষিণে সবুজ ঘাসে ঢাকা একচিলতে আঙিনা। সেখানে একটি খোলা মঞ্চ আছে। বাহিরের দেওয়ালে তাঁর কবিতা লেখা আছে। কুষ্টিয়ার প্রবীণদের নিয়ে এখানে গড়ে উঠেছে প্রবীণ সংঘ। প্রবীণরা সকাল-সন্ধ্যা আড্ডা দেয়। মেয়র আনোয়ার আলী বললেন, ‘টেগর লজটি উদ্ধার ও সংস্কার করতে পেরে আমরা আনন্দিত ও গর্বিত। শিলাইদহের কুঠিবাড়ি সুপরিচিত হলেও টেগর লজকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়া শহরের সঙ্গে কবির যে সম্পর্ক তা অনেকেরই অজানা। টেগর লজ উপেক্ষিত ছিল। আমরা কবির স্মৃতি ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। আগামী দিনে টেগর লজকে রবীন্দ্র জাদুঘর ও সংগ্রহশালায় পরিণত করার পরিকল্পনা রয়েছে। ঐতিহ্যবাহী ভবনটিকে কুষ্টিয়ার সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।’ বাড়িটি বর্তমানে কুষ্টিয়া পৌরসভার অধীনে আছে। টেগর লজের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিরীক্ষাধর্মী কবি আখতারুজ্জামান চিরূ। যোগাযোগ করা যাবে ০১৭০০৭২৬৭৭১। প্রতিদিনই বেলা সাড়ে তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকে। স্থানীয় লোকজন এসে পত্র-পত্রিকা পড়েন। দর্শনার্থীরাও আসেন। কবির জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানও হয়। সংস্কারের পর পৌরসভা টেগর লজের একটি পরিচিতি পুস্তিকাও প্রকাশ করেছে। আবেগময় পঙ্ক্তিও লেখা রয়েছে–
‘আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতূহল ভরে, আজি হতে শতবর্ষ পরে!’
পৌর মেয়র আনোয়ার আলী বলেন, “রবীন্দ্রনাথ আমাদের অহংকার। কুষ্টিয়ায় তার অনেক স্মৃতি রয়েছে। আমরা ‘টেগর লজ’ দেখভাল করছি। প্রতিবছর ২৫ বৈশাখ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমরা রবীন্দ্র-বন্দনায় মেতে উঠি। আর ২২ শ্রাবণ প্রয়াণ দিবসে কবিকে স্মরণ করি। দেশ-বিদেশের পর্যটকরা ‘টেগর লজ’ দেখতে আসেন। আমরা তাদেরকে সহযোগিতা করি। আমরা টেগর লজকে একটি পরিপূর্ণ রবীন্দ্র মিউজিয়াম করার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। পাশাপাশি ঐতিহ্যমণ্ডিত এই ভবনটি সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার একটি কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে উঠবে। আমাদের এই প্রয়াসে সুধীজনের আন্তরিক সহায়তা কামনা করি। আমি মনে করি বিশ্ব মানবতার প্রতীক রবীন্দ্রস্মৃতির পীঠস্থান এ টেগর লজ কেন্দ্রিক এখানে একটি সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি হবে- যা আগামীতে হবে বাঙালি সংস্কৃতির তীর্থস্থান।”
প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ কুষ্টিয়াকে কতখানি সমৃদ্ধ করেছিলেন তার লেখাতেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। শিল্প-সাহিত্য, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এখানে সে সময় আবির্ভাব ঘটেছিল বড় বড় প্রভাবশালী সব ব্যক্তিত্বের। যেমন ফকির লালন শাহ্, গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা পত্রিকার সম্পাদক কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার, কথাসাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন ও গগণ হরকরা। তাই কবি আবেগভরা কণ্ঠে বলেছিলেন,
‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই
ছোট সে তরী
আমারই সোনার ধানে গিয়াছে যে ভরি।’
বাঙালি চিরকাল যাদের নিয়ে গর্ব করবে, তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যতম।
লেখক: ইতিহাস গবেষক ও প্রাবন্ধিক
এসএ/