মৃত্যুদণ্ড একমাত্র সমাধান নয়
দেশের আইন বিচার করেছে। মুল আসামিদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে। অন্যান্যদের যথোপযুক্ত শাস্তি হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি, মৃত্যুদণ্ড কখনও সমস্যার সমাধান হতে পারে না। যত অপরাধীদের শাস্তি হবে অপরাধীরা ততো বেশি নির্মম হবে এবং সমাজকে আরও বেশি নিশংস বানাবে।
পৃথিবীতে মোট ১৯০ টি দেশ আছে। বাস্তবিক অর্থে ১৩০টি দেশে মৃত্যুদণ্ড উঠে গিয়েছে। ৬০টি দেশে মৃত্যুদণ্ড হয়। গত দুই বছরের হিসেবে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড হয়েছে চীন, ইরান, সৌদি আরব এবং বাংলাদেশে। ইউরোপের কিছু দেশ আছে যেখানে প্রায় দু’শো বছর আগে মৃত্যুদণ্ড তুলে দিয়েছে। এ দেশে বিভিন্ন জেলগুলিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা প্রায় দুই হাজার একশ। অপরাধ কি একটুও কমেছে গত দুই চার পাচ বছরে? কিন্তু আমরা এক একটি মামলায় দশজনের মৃত্যুদণ্ড না দিলে খুশি হই না। আমরা বর্বরতার কোনদিকে যাচ্ছি? আমরা যে ভেতরে ভেতরে নিশংস হয়ে যাচ্ছি ,এর ফলাফল হবে রাস্তাঘাটে কেউ যদি আক্রমণ করে আর আমরা বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করি,কেউ এগিয়ে আসবে না। মেজর সিনহা নিজেও এই বর্বরতার শিকার।
আমদের মধ্যে এখনো সেই মধ্যযুগীয় ধারণা যে, ঠাইসা শাস্তি দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা আসলে সেই মধ্যযুগীয় মন মানসিকতায় আছি। গত দশ পনের বছর আগেও একটা ধারণা ছিল যে, শিক্ষক ছাত্রকে বেত না মারলে সে শিখবে কিভাবে? আমরা সেখান থেকে সরে আসছি। আমাদের এই মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কে বুঝতেই সমাজটা অনেক বেশি সহিংস হয়ে যাবে। আমি জানি বিচারকদেরও অনেক চাপের মুখে থাকতে হয়। মৃত্যুদণ্ড দিতেই হবে আর কোন সমাধান নাই। না দিলে ধরেই নেয়া হবে যে, বিচারক দুর্বল, পক্ষপাতদুষ্ট অথবা টাকা খেয়েছে। আবরার ফাহাদের ঘটনাটি কিন্তু একটি শিক্ষা আমাদের জন্য। একজনের সাথে ২০জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। এধরণের ঘটনা দুশো বছরেও হয় নাই। শাস্তিদানের বিপক্ষে বলছি ভাবার কোন অবকাশ নেই। শাস্তিদানের ভুল ধরণটিতে আমার আপত্তি আছে। ত্রিশ চল্লিশ বছর আগের সেই বেত মারা সরকার তুলে দিয়েছে। মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কে আমরা মধ্যযুগীয় ধারনাতে ফিরে যাচ্ছি। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ সেটি বুঝতে পারছে। অপরাধ এবং শাস্তি অপরাধী বেশি তৈরি করে । যে কারণে মানুষ মানবিক অনুভূতিগুলি হারিয়ে ফেলছে। এর পিছনের বড় কারণ হলো বর্বরতা এবং শাস্তি।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক