বায়ুদূষণে ঢাকা
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈশ্বিক বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’-এর বায়ুমান সূচক (একিউআই) থেকে সর্বশেষ তথ্যমতে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরী হচ্ছে ঢাকা। এয়ার ভিজ্যুয়াল প্রতি ঘণ্টায় বিশ্বের প্রধান প্রধান শহরগুলোর বায়ুদূষণের তথ্য প্রদান করে থাকে। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী গত ২০ জানুয়ারি, ২০২২ সালে ঢাকা শহর ছিল বায়ুদূষণের শীর্ষস্থানের শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইতিপূর্বে ২১ জানুয়ারি, ২০২১ সালে (সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা) চার ঘণ্টা জরিপে বেরিয়ে এসেছিল বিশ্বের বায়ু দূষিত শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান প্রথমস্থানে। তার আগের দুই দিনও ঢাকার অবস্থান ছিল বায়ু দূষণে ১ নম্বর। ওই সময় শহরের বায়ুদূষণের পরিমাণ ছিল ৩২৬ পিএম। অপরদিকে গত ১০ জানুয়ারি ২০২০ সালে বায়ু দূষণের মাত্রা ছিল ৫০২ পিএম। বলে রাখা ভালো, বায়ু বিশারদের মতে ৩২৬ মানে হচ্ছে দুর্যোগপূর্ণ অবস্থা। এয়ার ভিজ্যুয়ালের হিসেব মোতাবেক বায়ুর মান ০ থেকে ৫০ পিএম থাকলে ওই এলাকার মান ভালো। অন্যদিকে ২০০ থেকে ৩০০-এর মধ্যে বায়ুর মান থাকার মানে হচ্ছে খুবই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। যা জরুরি অবস্থার মধ্যে পড়ে। ২০ জানুয়ারি ২০২২ সালে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বায়ু সূচকের মান রেকর্ড করা হয় ২৬৯ পিএম। গত বছরের তুলনায় সামান্য মান ভালো হলেও ২৬৯ একিউআই স্কোর মারাত্মক অবস্থানে রয়েছে। যা শিশু এবং প্রবীণ ব্যক্তিদের জন্য মারাত্মক হুমকিই বটে। এমতাবস্থায় মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বায়ুদূষণে ঢাকার পরেই রয়েছে চীনের উহান শহর, সেখানকার স্কোর ২৩১। তৃত্বীয় স্থানে রয়েছে কাজাখস্থানের নূর সুলতান শহর, সেখানকার স্কোর ২২৯।
প্রচার মাধ্যমে বিষয়টি জানাজানি হলে পরিবেশবিদেরা ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তারা ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা, মোটরযানের কালোধোঁয়া, কলকারখানার ধোঁয়া, ধুলাবালি ও নির্মাণ কাজের জন্য খোঁড়াখুঁড়িকে দায়ী করেন। সমীক্ষায় জানা যায়, ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের প্রধান উৎস ইটভাটা থেকে নির্গত কার্বন মনোক্সাইড ও অক্সাইউ অব সালফার। যা নির্গত হওয়ার ফলে রাজধানীর প্রায় ৫৮ শতাংশ বায়ুদূষণ ঘটছে। এছাড়াও রোড ডাস্ট, সয়েল ডাস্ট ১৮ শতাংশ, যানবাহন ১০ শতাংশ, বায়োমাস পোড়ানো ৮ শতাংশ এবং অন্যান্য উৎস ও শিল্প-কারখানার দূষিত ধোঁয়ার মাধ্যমে ঘটছে ৬ শতাংশ।বিশেষ করে ইটভাটা থেকে নির্গত কার্বন মনোক্সাইডের প্রভাবে ঢাকা এবং আশপাশের বনাঞ্চল ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ইটভাটার প্রভাবে ঢাকার আশপাশে তুলনামূলক বৃষ্টিপাতও কমে গেছে। ইটভাটার নির্গত ধোঁয়া আকাশের জলীয় বাষ্পকে দূরে ঠেলে দেওয়ার ফলে এতদ অঞ্চলের বৃষ্টিপাতে বিগ্ন ঘটছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কেন্দ্র ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ পরিচালিত যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার রাস্তার ধুলায় উচ্চমাত্রার ক্যাডমিয়াম, সিসা, দস্তা, ক্রোমিয়াম, নিকেল, ম্যাঙ্গানিজ ও কপারের উপস্থিতি রয়েছে প্রচুর। ফলে ঢাকায় বসবাসরত ২ কোটি মানুষের মধ্যে প্রতিনিয়ত ৬ লাখ মানুষ বায়ুদূষণের শিকার হচ্ছেন। তার মধ্যে শিশু ও বয়স্করা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন রোগে ভোগছেন। অনেকে আবার বেঁচে থাকার লড়াইয়ে হেরেও যাচ্ছেন, তার পরেও রোগের কারণ বুঝতে সক্ষম হননি সর্বসাধারণ। তারা জানেন না, বায়ুদূষণের কারণে মানুষ শ্বাসজনিত সমস্যা, নিউমোনিয়া, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। উল্লেখ্য, বড়দের তুলনায় শিশুরা ৩০ শতাংশ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। গবেষণায় জানা গেছে, মাটির কাছাকাছি বাতাসের সর্বনিম্ন স্তরে থাকে বিষাক্ত ধোঁয়াশা। শিশুরা উচ্চতায় খাটো বিধায় নিশ্বাসের সঙ্গে ওই ধোঁয়াশা দ্রুত ফুসফুসে প্রবেশ করায় রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে।ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের গবেষণায় জানা যায়, ফুসফুস ক্যান্সারের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী হচ্ছে বায়ুদূষণ। এছাড়াও প্রতিনিয়ত লিভার ক্যন্সারের ঝুঁকিও বাড়ছে বায়ুদূষণের কারণে। ২০১০ সালের এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে জানা গেছে, বায়ুদূষণের ফলে ফুসফুস ক্যান্সারে প্রায় ২ লাখ ২৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
শুধু ঢাকা নয়, বিশ্বের অধিকাংশ বড় শহরগুলো বায়ুদূষণের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, যার ফলে বিশ্বব্যাপী বছরে ৫ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুও ঘটছে। এছাড়াও বায়দূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ু ১ বছর কিংবা তারও বেশি কমে যাচ্ছে। সমীক্ষায় জানা গেছে, প্রতিদিন ঢাকা শহরে ৪৩৬ টন ধূলিকণা গাছ-গাছালির ওপরে জমছে। বিশেষ করে শুষ্কমৌসুমে গাছ-গাছালির ওপর ধূলার আস্তর বেশি জমছে। এ ছাড়াও রাস্তাঘাটে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণে ধূলার আস্তর জমতে দেখা যাচ্ছে। যা শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানব দেহে তাৎক্ষণিক প্রবেশ করে রোগব্যাধি ঘটিয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। যা মানুষ বা ভূক্ষভোগীগণ তাৎক্ষণিক মালুম করতে পারছেন না। যার ফলে বিষয়টি অনেক সময় অগোচরে থেকে যাচ্ছে; অর্থাৎ রোগের উৎস জানতে পারেননি মানুষ। অথবা ধূলিকণার প্রভাবে যে মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে তা অনেকেই আমলেই নেননি। বিষয়টি না জানায় তিনি সর্তক চলাফেরাও করেননি, করেননি মাস্কের ব্যবহারও। যার ফলে জটিল রোগে ভোগে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছেন অনেকেই।
উপরোক্ত বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হচ্ছে, সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে এই দূষণ থেকে উত্তরণের পদক্ষেপ নিতে হবে দ্রুত। ঢাকার আশপাশের অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে দিতে হবে দ্রুততার সাথে। শহরের রাস্তাগুলোকে শুষ্কমৌসুমে দিনে অন্তত ১/২ বার পানি ছিটিয়ে ধুলিদূষণ কমাতে হবে। সম্ভব হলে সপ্তাহে একদিন, না হলে দুই সপ্তাহ বাদে রাস্তার পাশের গাছপালাকে পানি দিয়ে ধোয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যেটি করা হচ্ছে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতেও। পাশাপাশি দায়ী বিষয়গুলোকে শনাক্ত করে নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে হয়তো শতভাগ সমাধান না হলেও খানিকটা নিয়ন্ত্রণে আসবে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য শহরগুলোর বায়ুদূষণ। বলে রাখা ভালো, ধুলাবালি গাছগাছালিতে জমার কারণে যেন আবার শহরের বৃক্ষরোপন অভিযানে ভাটা না পড়ে সেটিও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। সুতরাং গাছগাছালি রক্ষা করে শহরের পরিচ্ছন্নতায় নজর দিতে হবে। তাহলে বায়ুদূষণ থেকে রক্ষা পাবে আমাদের প্রিয় শহরগুলো, কেটে যাবে ঢাকা শহরের বদনামও। আর বিশ্বের কাছেও আমাদের মুখ উজ্জল হবে। কাজেই আমরা ঢাকা শহরসহ দেশের উল্লেখযোগ্য কিংবা বৃহৎ শহরগুলোকে ধূলিদূষণ মুক্ত রাখার চেষ্টা করব।
লেখক: পরিবেশ ও বন্যপ্রাণীবিষয়ক কলামিস্ট