গণতন্ত্র বিকিয়ে দেওয়ার রাজনীতি চলছে ভারতবর্ষে
ইংল্যান্ডে প্রায় তিন শ বছর আগে ম্যাগনা কার্টার আমলে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হয়। উদ্দেশ্য একটাই–জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য সরকার কাজ করবে। যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র আছে, সেসব দেশে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আয়ারাম-গায়ারাম হয়ে যায়। ১৯৬৭ সালে লোকসভা এবং বিধানসভাগুলোর নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গিয়েছিল–কংগ্রেস দল পশ্চিমবঙ্গ, বিহার এবং উত্তর প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি।
এই রাজ্যগুলোতে তাই প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার জন্য আঞ্চলিক ছোট দলগুলো কংগ্রেস থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভাঙিয়ে সরকার গঠন করেছিল; কিন্তু এসব সরকার অস্থায়ী হয়নি। বিহারে বিন্দ্যেশ্বরী মন্ডল তো মাত্র একদিনের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। আর কর্পুরী ঠাকুর ও অন্য কয়েকজনের স্থায়িত্ব ছিল অল্প কিছুদিন বা কয়েক মাস। যেহেতু এইসব সরকার স্থায়ী হয়নি, তাই পরবর্তীকালে যখন নির্বাচন হয়, তখন দেখা যায়, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ওইসব রাজ্যে ক্ষমতায় ফিরে এসেছে কংগ্রেস।
১৯৬৭ সালে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে মেদিনীপুরের অজয় মুখার্জি একটি নতুন দল গঠন করেন, যার নাম ছিল বাংলা কংগ্রেস। বাংলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন প্রণব মুখার্জি। বর্তমানে সেই দলের আর কোনো অস্তিত্বই নেই। যা-ই হোক বাংলা কংগ্রেস সেই ১৯৬৭ সালে বাম দলগুলোকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আসে। মুখ্যমন্ত্রী হন অজয় মুখার্জি। তবে সেই সরকারের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ৯ মাস। এরপর পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়। ১৯৬৯ সালে ফের বামদলগুলোর সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় আসে বাংলা কংগ্রেস। ফের মুখ্যমন্ত্রী হন অজয় মুখার্জি। সেই সরকার স্থায়ী হয় ১৩ মাস। ১৯৬৭ ও ১৯৬৯ এই দুই সময়ের জোট সরকারেই অজয় মুখার্জির ডেপুটি, অর্থাৎ উপমুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। এই দ্বিতীয় জোট সরকারও ভেঙে যায় মতপার্থক্যের কারণে।
১৯৭০ সালে অজয় মুখার্জি বামদের ছেড়ে কংগ্রেসের সঙ্গে কোয়ালিশন করেন। তৃতীয় দফায় অজয় মুখার্জি মুখ্যমন্ত্রী হন। এবং উপমুখ্যমন্ত্রী হন কংগ্রেসের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক বিজয় সিং নাহার। এরপর শুরু হয়ে যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেন। এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে এই সরকার সামলাতে পারবে না মনে করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করেন। বাংলাদেশের মানুষদের ঠিকভাবে খাওয়া, পরা ও চিকিৎসার সংস্থান করার জন্য তিনি ত্রাণ শিবির চালু করেন। দায়িত্ব দেওয়া হয় রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম সংঘসহ বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে। এরপর একসময় মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম হয় বাংলাদেশের। এর অব্যবহিত পরই ১৯৭২ সালে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী হন সিদ্ধার্থ শংকর রায়।
এ তো গেল পুরনো ইতিহাস। এবার আমরা চোখ ফেরাব ভারতে আগামী দু মাসে যে পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হতে চলেছে সেদিকে। এই পাঁচটি রাজ্য হলো–গোয়া, মনিপুর, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ড। বঙ্গেশ্বরী মমতা বন্দোপাধ্যায় বিগত নির্বাচনে জয়ের পর থেকেই তার আঞ্চলিক দলটিকে সর্বভারতীয় রূপ দিতে উঠে পড়ে লেগেছেন। তিনি এই উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তিন হাজার কিলোমিটার দূরে গোয়ায় গিয়ে কংগ্রেস এবং বিজেপি থেকে লোক ভাঙিয়ে নিজের দলকে শক্তিশালী করছেন। সে রাজ্যের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের লড়াইয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাকে এ ব্যাপারে পরামর্শ দিচ্ছেন ভোট কুশলী প্রশান্ত কিশোর পাণ্ডে।
সোমবার (২৪ জানুয়ারি) ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির প্রখ্যাত সাংবাদিক শ্রীনিবাস জৈন ৪৫ মিনিট ধরে ইন্টারভিউ করেন প্রশান্ত কিশোরকে। সঞ্চালক শ্রীনিবাস জৈনের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই প্রশান্ত কিশোরের আসল রূপটি বেরিয়ে এসেছে। তিনি বলেছেন, দিদি আমাকে তিন রাজ্য–গোয়া, মেঘালয় ও মনিপুর থেকে কংগ্রেসের লোক ভাঙিয়ে আনার অনুরোধ করেছিলেন। গোয়ার ব্যাপারে বঙ্গেশ্বরী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোনিয়া গান্ধীকে ফোন করে বলেছিলেন, সে রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট চায় তৃণমূল। এ কথা বলার পাশাপাশি তিনি আবার কংগ্রেস থেকে দল ভাঙিয়ে লোক আনার চেষ্টাও করতে থাকেন।
এ ব্যাপারে গোয়ায় কংগ্রেসের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী চিদম্বরম স্পষ্ট করে বলেছেন, তৃণমূল গোয়ায় কংগ্রেস ভাঙানোর খেলায় নেমেছে। চিদম্বরমের বক্তব্য, এ কারণেই গোয়া বিধানসভার ভোটে তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট প্রক্রিয়া এগোয়নি। গত সপ্তাহেই গোয়ায় নির্বাচনী জোট না হওয়ার জন্য কংগ্রেসের দিকে আঙুল তুলেছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিষেকের অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে রোববার (২৩ জানুয়ারি) চিদম্বরম অভিযোগ করেন, তৃণমূল জোটের প্রস্তাব দিয়েছিল ঠিকই; কিন্তু পাশাপাশি কংগ্রেস ভাঙানোর কাজও শুরু করে। কোনো কোনো মহল থেকে শোনা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র বাংলাদেশের এক ব্যবসায়ী তৃণমূলকে কয়েক লাখ ডলার এবং ভারতীয় মুদ্রায় ১৫০ কোটি টাকা দিয়েছেন। বিনিময়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি শিল্প কারখানার অংশীদার হতে চলেছেন। সেই ব্যবসায়ীর টাকাতেই তৃণমূলের এই রমরমা অবস্থা।
যে পাঁচটি রাজ্যে নির্বাচনে হবে, তার মধ্যে বৃহত্তম হলো উত্তরপ্রদেশ। এই রাজ্য বিধানসভার আসনসংখ্যা ৪০৩। উত্তরপ্রদেশের ভারপ্রাপ্ত কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়াঙ্কা গান্ধী কংগ্রেসকে হারানোর জন্য ৮ ফেব্রুয়ারি মমতা উত্তরপ্রদেশে যাচ্ছেন বলে তাঁর অফিস থেকে জানানো হয়েছে। কংগ্রেস মহল থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, অমিত শাহ-নরেন্দ্র মোদির হাত শক্ত করতে তাদের অনুরোধেই মমতা কংগ্রেসকে হারাতে এই উদ্যোগ নিয়েছেন।
শুধু তা-ই নয়, আগামী ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি যদি নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা না পায় তাহলে তৃণমূল তাদের সমর্থন করতে পারে এমন কথাও শোনা যাচ্ছে রাজনৈতিক মহলে। গোয়ায় কংগ্রেস বিধায়ক লুইজিনহো ফেলেইরোকে দলে নিয়ে নেয় তৃণমূল। আরও দুজনকে কংগ্রেস প্রার্থী করার পরেও তাদের নিজেদের দলে টেনে নেয়।
দল ভাঙানোর এই খেলা প্রসঙ্গে একটু অতীতের কথা বলতে হয়। কংগ্রেস ছেড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন নিজের দল গড়েন, সে সময় বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি ২০ কোটি টাকা দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এমন কথাই শোনা যায় বিজেপি মহলে। আর এর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ মমতা বিজেপি বাংলায় জায়গা করে দেন। বিজেপির সঙ্গে জোট করে লোকসভা নির্বাচনে লড়েন। ফলে পশ্চিমবঙ্গে খাতা খোলে বিজেপি। সরাসরি দল না ভাঙিয়েও টাকা দিয়ে গণতন্ত্রকে কিনে নিয়েছিল বিজেপি। আর টাকার লোভেই বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বাংলায় ডেকে এনেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়–এমন অভিযোগও রয়েছে।
আজও সেই টাকার খেলাই চলছে। বিজেপির মতোই এ খেলায় দক্ষ বঙ্গেশ্বরীর দলও। গোয়ার পার্শ্ববর্তী রাজ্য মহারাষ্ট্রে শিবসেনার মুখপত্র ‘সামনা’য় শিবসেনার রাজ্যসভার সাংসদ সঞ্জয় রাউথ প্রশ্ন তুলেছেন, গোয়ায় তৃণমূল এত লোককে কিনছে, এত খরচ করছে কার টাকায়?
এভাবে দল ভাঙিয়ে, টাকা ছড়িয়ে লোক কেনা এবং নীতিহীনতার রাজনীতি চলছে দেশজুড়ে। যার সূচনা করেছিল বিজেপি, আর বর্তমানে সেই ধারা সফলভাবে বহন করে চলেছে বিজেপিরই রাজনৈতিক দোসর মমতার তৃণমূল। এভাবে গণতন্ত্রকে বিকিয়ে দেওয়া রাজনীতি ভারতবর্ষ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো দেশে বোধহয় পাওয়া যাবে না।
লেখক: ভারতের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
এসএ/