শাহ এ এম এস কিবরিয়া: এক নক্ষত্রের অস্বাভাবিক প্রয়াণ
শাহ এ এম এস কিবরিয়া। সাবেক অর্থমন্ত্রী। এটা তাঁর শেষ পরিচয়। তাঁর নামের আগে আরও অনেক পরিচয় আছে। সেগুলো না হয় অন্য এক সময় লিখা যাবে।
তাকে নিয়ে আমার একটা অম্ল-মধুর অভিজ্ঞাতা আছে। আজ শুধু সেই অংশটুকুই স্মৃতির পাতা থেকে তুলে আনতে চাই প্রিয় পাঠকদের জন্য। কিবরিয়া ভক্তদের জন্য।
২০০১ সাল। তখন কাজ করি বিখ্যাত সম্পাদক, বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত চৌধুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ২০০০-এ। সিলেট প্রতিনিধি হিসেবে চষে বেড়াই বৃহত্তর সিলেটের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। আজ হবিগঞ্জের বাল্লা সীমান্তে, কাল হয়ত ছুটে যাই মৌলভীবাজারের বটুলি সীমান্তে। কিংবা পরের সপ্তাহেই সুনামগঞ্জের কালনী পাড়ের দুর্গাপাশা গ্রামে। অথবা সিলেট শহর থেকে ৫০-৬০ কিলোমিটার দূরের তামাবিল সীমান্তে, খাসিয়া পল্লীতে। এই ছুটে চলার পিছনে উদ্দেশ্য খবরের পিছনের খবর নিয়ে আসা। এটাই ছিল আমার এক এবং অদ্বিতীয় কাজ।
তুমুল উৎসাহে আর তীব্র গতি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। এর মধ্যেই চলে আসে ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ওই বছরের ১ অক্টোবর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনকে ঘিরে প্রতি সপ্তাহেই সাপ্তাহিক ২০০০-এ নির্বাচন কেন্দ্রিক রিপোর্ট প্রকাশ হচ্ছে। বৃহত্তর সিলেটের ১৯টি আসন নিয়ে আমিও রিপোর্ট করছি। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আসনগুলোতে যেসব ভিআইপি প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন তাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য সিলেটের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে দৌড়ঝাঁপ করে যাচ্ছি নিয়মিত।
বিশেষ করে হবিগঞ্জ-৩(হবিগঞ্জ সদর-লাখাই), মৌলভীবাজার-১(বড়লেখা), মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া), মৌলভীবাজার-৩(রাজনগর ও মৌলৌভীবাজার সদর), মৌলভীবাজার-৪(শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ), সিলেট-১(সিলেট সদর-কোম্পানিগঞ্জ) এবং সুনামগঞ্জ-৩(জগন্নাথপুর-দক্ষিণ সুনামগঞ্জ) আসনের প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার কাজ ছিল সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ।
২০০১ সালের সেই নির্বাচনে হবিগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছিলেন তৎকালীন সদ্য সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া। তার প্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন বিএনপি তথা চার দলীয় জোটের আবুল লেইছ মো. মুবিন চৌধুরী। সঙ্গত কারণেই এই আসনটি ভিআইপি আসনের মর্যাদা লাভ করে। যেহেতু কিবরিয়া সাহেব প্রার্থী, সে কারণেই এর গুরুত্ত্ব ছিল অন্যরকম। স্থানীয় ভোটার ও জনসাধারণের কাছে যেমন আসনটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, তেমনি গণমাধ্যমের কাছে এটি ছিল অধিক গুরুত্ত্বপূর্ণ আসন। সবার চোখ ছিল কিবরিয়ার আসনের দিকে।
১৯৯৬ থেকে-২০০১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ শাসনামলে দেশের মানুষ স্বল্পমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পেরেছিল। বিশেষ করে মোটা চালের দাম ছিল কেজি প্রতি ৮ থেকে ১০ টাকা। আরও নানান কারণে আওয়ামী লীগের অবস্থান বেশ ভালো ছিল। এর বিপরীতে আওয়ামী লীগের ওই মেয়াদেই দেশের সাত-আটটি জেলায় কিছু নেতার বেপরোয়া আধিপত্য আওয়ামী লীগের শাসনকে বেশ বিতর্কিত করে ফেলে। বলা যেতে পারে ওই নেতারা আওয়ামী লীগের জন্য অনেকটা ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে উঠেছিলেন। এসব কারণে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পুনরায় জয়ের সম্ভাবনা যতটুকু ছিল তার চেয়ে বেশি শংকা ছিল পরাজয়ের। আওয়ামী লীগের ওই সময়ের শাসনামলের ভালো কাজগুলো ঢাকা পড়ে গিয়েছিল এসব কারণে। সে আরেক আলোচনা।
যাক, ২০০১ এর সেই নির্বাচনে ভিআইপি আসন হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠা হবিগঞ্জ সদর আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী শাহ এ এম এস কিবরিয়া এবং বিএনপি প্রার্থী আবুল লেইছ মো. মুবিন চৌধুরী'র সাক্ষাৎকার নেওয়ার অ্যাসাইনমেন্ট দিলেন সাপ্তাহিক ২০০০ এর প্রধান প্রতিবেদক গোলাম মোর্তোজা। সেই অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে গেলাম হবিগঞ্জে।
কনকনে শীতের রাত। হবিগঞ্জের একটি আবাসিক হোটেলে সাময়িক বসতি গাড়লাম। প্রথম দিনেই বিএনপি প্রার্থী আবুল লেইছ মো. মুবিন চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নেওয়া শেষ। তারপরই শুরু করলাম কিবরিয়া সাহেবের সাক্ষাৎকার নেয়ার মিশন। কিন্তু কোনভাবেই এই ভিআইপি প্রার্থীকে ধরতে পারছি না।
ওই সময়ে প্রথম আলোর হবিগঞ্জ প্রতিনিধি হাফিজুর রহমান নিয়ন আমাকে যারপরনাই সহযোগিতা করলেন। আশ্বস্ত করে বললেন, কোন সমস্যা নাই। সাক্ষাৎকার নিতে পারবেন। একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে। তার কথায় আশ্বস্ত হলাম। তিনি আমাকে দিনে-রাতে সঙ্গ দিলেন কিবরিয়া সাহেবের নাগাল পর্যন্ত নিয়ে যেতে।
কিবরিয়া সাহেব নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত। ভোর রাত থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চষে বেড়াচ্ছেন হবিগঞ্জ সদর ও লাখাইয়ের গ্রাম থেকে গ্রামে। এক গঞ্জ থেকে আরেক গঞ্জে। উঠান বৈঠক করছেন। মানুষের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন। গণসংযোগ করছেন দিনে রাতে। নিয়ন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে কিবরিয়া সাহেবের অবস্থান জানার চেষ্টা করছেন। সেই অবস্থানে ছুটে যাচ্ছি নিয়নের মোটরবাইকের পিছনে বসে। কিন্তু যখনই একটা স্থানে যাচ্ছি, গিয়ে জানতে পারছি কিবরিয়া সাহেব কিছুক্ষণ আগে তার বহর নিয়ে আরেক গ্রামে চলে গেছেন কিংবা গঞ্জে গেছেন।
শেষ পর্যন্ত তৃতীয় দিন রাত পৌনে চারটার দিকে কিবরিয়া সাহেবের নির্বাচনী প্রচারবহরকে অনুসরণ করে হাজির হলাম তাঁর শহরের বাসায়। তিনি ঢুকলেন। তার পিছনে শত শত নেতাকর্মী। আছেন অনেক সাধারণ মানুষও। তিনি নিজের ড্রয়িং রুমে ঢুকার পর আমি ও নিয়ন গেলাম সেই কক্ষের দিকে।
লোকে ভর্তি সেই কক্ষ। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিয়ন সালাম দিলেন, সঙ্গে আমি। তখনই নিয়ন নিজের পরিচয় দিয়ে আমাকে পরিচয় করে দিয়ে বললেন, বিপুল সাপ্তাহিক ২০০০-এ কাজ করেন। তিনি আপনার একটা সাক্ষাৎকার…
এ কথা শেষ করতে পারেননি নিয়ন। সঙ্গে সঙ্গেই অনেকটা রেগে গিয়ে শাহ এ এম এস কিবরিয়া বললেন, চলে যান আমি সাপ্তাহিক ২০০০ কে কোন সাক্ষাৎকার দেবনা। ওরা আমার বক্তব্য সব সময় বিকৃত করে ছাপে। টুইস্ট করে। আবারও বললেন, চলে যান।
আমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকলাম। পাশে থাকা নিয়ন আমাকে ধীরে ধীরে বললেন, চলেন যাই। সাক্ষাৎকার দিবেন না। আমি তাকে বললাম, আমি সাক্ষাৎকার না নিয়ে যাব না। মিনিট কয়েক পর দরজার সামনে থেকেই আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, স্যার আমি আপনার এই আসনের প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়েছি। আপনার সাক্ষাৎকারটা আমার লাগবে। আপনি যা বলবেন তাই লিখব। একটা শব্দও এদিক সেদিক হবে না। আপনি আমাকে সাক্ষাৎকারটা দেন।
কিছুটা সময় নিরব থেকে এম এস কিবরিয়া বললেন, আমি একটু আগে যা বলেছি সেগুলো ছাপতে পারবেন? যে, 'সাপ্তাহিক ২০০০ কিবরিয়ার বক্তব্য কখনই সঠিকভাবে ছাপে না। সব সময় বিকৃত করে ছাপে।'
কোন কিছু না বুঝেই দায়িত্ব নিয়ে বললাম, জ্বি স্যার, আপনার সাক্ষাৎকারের শুরুতেই এই বক্তব্য ছাপা হবে।
তারপর কিবরিয়া সাহেব তাঁর পাশে বসিয়ে আমাকে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিলেন। প্রথমেই বললেন, আপনি অর্থনীতি বুঝেন? বললাম, স্যার আপনি বুঝিয়ে দিলে বুঝব। অত্যন্ত চমৎকার করে প্রাঞ্জল ভাষায় কথা বলতে থাকলেন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী শাহ এ এম এস কিবরিয়া। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত সেগুলো শুনে গেলাম।
বললেন, জানেন আমি কিভাবে মানুষকে ১০টা কেজি দরে চাল দিতে পারি? কেন মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিবে? হবিগঞ্জের মানুষ কেন তাকে নির্বাচিত করবে? এরকম আরও অনেক বিষয়।
প্রশ্ন করেছিলাম যদি আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয় তাহলে হবিগঞ্জে… প্রশ্নটা শেষ করতে পারিনি। কিবরিয়া সাহেব জবাব দিলেন, বৃহত্তর সিলেটের অন্য তিন জেলায় যদি একটি আসনও আওয়ামী লীগ জিততে না পারলেও হবিগঞ্জের চারটি আসন আওয়ামী লীগ জিতবে। তার সেই কথা সত্য হয়েছিল। হবিগঞ্জে চারটি আসনেই জিতেছিল আওয়ামী লীগ।
ফজরের আযান শেষ হতে চলছে। কিবিরয়া সাহেব একের পর এক কথা বলা যাচ্ছেন। যিনি এক ঘণ্টা আগেও সাপ্তাহিক ২০০০ কে সাক্ষাৎকার দিতে চাননি। তিনি দিব্যি কথা বলে যাচ্ছেন। আর আমি সেই কথা শুনে যাচ্ছি গভীর মনযোগের সঙ্গে।
এতো সুন্দর করে, বিনয়ের সঙ্গে একজন মানুষ কথা বলতে পারেন। কিবরিয়া সাহেবের সঙ্গে দেখা না হলে, তার কাছাকাছি না পৌঁছতে পারলে সেই সুন্দর, ও বিনয় থেকে সত্যিই বঞ্চিত হতাম।
গতকাল ছিল শাহ এ এম এস কিবিরয়ার মৃত্যু বার্ষিকী। ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জের বৈদ্যের বাজারে দলীয় এক সমাবেশে যোগ দিতে গেলে গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব সাবেক এই অর্থমন্ত্রী। তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। কিন্তু রাজধানীতে পৌঁছতে পৌঁছতেই ওপারে পাড়ি জমান দেশের উজ্জ্বল এই নক্ষত্র।
আজও তার হত্যার বিচার শেষ হয়নি। তার এই অস্বাভাবিক প্রয়াণের দিনে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। একই সঙ্গে শুধু একটাই চাওয়া দ্রুত বিচার সম্পন্ন হোক। প্রকৃত অপরাধীদের সাজা হোক।
লেখক- সাংবাদিক
/এএস