আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিচারপতি ড. রাধাবিনোদ পাল
আজও জাপানিরা যাকে হৃদয়ের মণিকোঠায় রেখেছে
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিচারপতি ড. রাধাবিনোদ পাল ১৮৮৬ সালের ২৭ জানুয়ারি কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ছালিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস কুষ্টিয়ার মিরপুর থানার কাঁকিলাদহে। রাধাবিনোদ যখন তিন বছর বয়সে পৃথিবীর উপর আশ্রয় নির্ভর করতে শুরু করেছেন, তখনই বাবা বিপিনবিহারী সন্ন্যাসব্রত নিয়ে সংসারত্যাগী হন। মা মগ্নোময়ী দেবী তার দুই মেয়ে আর একমাত্র ছেলে রাধাকে নিয়ে অনিশ্চিত জীবনের পথে যাত্রা শুরু করেন। বাবার ভালোবাসা তাকে স্পর্শ না করলেও তিনি বড় হতে থাকেন মায়ের দীর্ঘশ্বাসভরা আত্মবিস্মৃত বুকের ব্যথা চাপা ভাবগাম্ভীর্যে, অনাহূত আদর আর ঠাকুর দাদা ফ্যালান চন্দ্র পালের আশীর্বাদ ও স্নেহের উষ্ণ ছাঁয়াতে। সংসারের অভাব আর দারিদ্র্য মোকাবিলা করতে গিয়ে মমতাময়ী মা অন্যের কাজে শ্রম খেটে যখন দিনাতিপাত করছেন, তখন সেই জোয়ারে পাল তুলতে গরু চরানোর কাজে সময় ব্যয় করতেন রাধা। বাড়ির পাশে পাঠশালা থাকায় প্রতিদিন বিদ্যালয়ের সঙ্গে ঘন অরণ্যে গরুগুলো ছেড়ে দিয়ে রাধা স্কুল ঘরের খোলা জানালা দিয়ে মনোনিবিষ্ট করে ক্লাসের পাঠ্যক্রম শ্রবণ করতেন।
একদিন শহর থেকে স্কুল পরিদর্শক এলেন পাঠশালার লেখাপড়ার অবস্থা দেখতে। ক্লাসে এসে ছাত্রদের কাছে পাঠ্যক্রমের বিষয় সম্পর্কে জানতে একে একে প্রশ্ন করতে লাগলেন ছাত্রদের। কিন্তু ছাত্ররা উত্তর দিতে অপারগ হয়ে নিশ্চুপ ছিল। সে সময় রাধাবিনোদ পাল সে অবস্থা বেশি সময় সহ্য করতে না পেরে স্কুল পরিদর্শককে বলেন, ‘স্যার আমি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর জানি।’ বালকের সাহস দেখে চমকে গেলেন পরিদর্শক। বললেন, তোমার নাম কী? তুমি কী করো? রাধা বলেন, স্যার আমরা খুবই গরিব, তাই পড়ার সময় ও সাধ্য নেই। পরিদর্শক সাহেব বালকের অনর্গল প্রশ্নের উত্তর শুনে আরও আশ্চর্য হলেন। পরিদর্শকের অনুমতি ও ঈমান আলী পণ্ডিতের বদান্যতায় তার পাঠশালার পাঠ শুরু হয়েছিল। কিন্তু এরপর তার লেখাপড়া একতালে চলেনি- নানা কারণে তা বিঘ্নিত-ব্যাহত হয়েছে। এবারে পাঠশালার পাঠ চুকিয়ে নতুন স্কুলে ভর্তির জন্যে যেতে হয় নতুন আশ্রয়ে দূর-গ্রামে মাসির বাড়িতে- সেকালের চুয়াডাঙ্গা মহকুমার আলমডাঙ্গা থানার মোড়ভাঙ্গা গ্রামে। এই কঠিন দুর্যোগে মা মগ্নময়ী রাধাবিনোদকে শুধু আগলেই রাখেননি, তার চোখে বুনে দিয়েছিলেন লেখাপড়া শিখে বড়ো হওয়ার- মানুষের মতো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন। কোথা থেকে যেন এই নিরক্ষর গ্রাম্যরমণী সেকালের স্বনামধন্য বাঙালি-পুরুষ বিচারপতি স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম শুনেছিলেন। ছেলে গুরুদাসের মতো হাইকোর্টের বিচারক হবেন, এই ছিল তার অন্তরের একান্ত বাসনা। তাই নিরক্ষর-নিঃসম্বল জননীই ছিলেন তার একমাত্র ভরসা, প্রেরণা ও দিশারি।
ড. রাধাবিনোদ পাল প্রসঙ্গে ড. আবুল আহসান চৌধুরী যথার্থ বলেছেন, ‘উদ্ধৃতি দীর্ঘ হলো বটে, কিন্তু রাধাবিনোদ কীভাবে কোন পরিবেশ থেকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তা বোঝা ও বোঝানোর জন্যে এই বিবরণ অত্যন্ত জরুরি ও প্রাসঙ্গিক এবং প্রেরণামূলক দৃষ্টান্তও।’ অতএব এরপর কাহিনী বর্ণনায় এমন যে, মোড়ভাঙ্গা গ্রামের আশ্রয়দাতা বড়লোক মেসোমশাই কেদারনাথ পাল তার ছেলে (রাধাবিনোদের চেয়ে বয়সে কিছু ছোট) কৃষ্ণবন্ধুকে ভর্তি করান কুমরি এম ই স্কুলে, তখন রাধাবিনোদের বয়স ১১ বছর। এই স্কুল থেকেই তিনি চার টাকা বৃত্তি পেয়ে এমই পরীক্ষায় পাশ করেন প্রেসিডেন্সি ডিভিশনে প্রথম হয়ে। এরপর ভর্তি হন সেকালের খুব নামকরা শহুরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কুষ্টিয়া হাইস্কুলে। তার অসাধারণ মেধা ও প্রতিভার গুণে তিনি এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক অম্বিকাচরণ মুখোপাখ্যায় এবং প্রেসিডেন্সি ডিভিশনের নদীয়া জেলার ইন্সপেক্টর অব স্কুলস্, বিশিষ্ট লেখক ও ‘জাতক’-এর অনুবাদক ঈশানচন্দ্র ঘোষের বিশেষ মনোযোগ ও আনুকূল্য লাভ করেন। কুষ্টিয়ায় পড়ার সময়ে রাধাবিনোদ কমলাপুর-জিয়ারোখির বিশিষ্ট জমিদার রামচন্দ্র রায়চৌধুরীর বাড়িতে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন, যিনি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অনুজ ঈশানচন্দ্র (ঘোষ) বিদ্যানিধির জামাতা। কিন্তু এখানে বছর দুই পড়ার পর শরীর টিকতে চাইল না। এদিকে কোনো সূত্রে তার অসামান্য মেধার পরিচয় পেয়ে রাজশাহীর দুবলহাটির জমিদার তার লেখাপড়ার সব দায়দায়িত্ব গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিলে, তিনি তখন ভর্তি হন দুবলহাটি রাজা হরনাথ হাইস্কুলে। রাধাবিনোদের এরপরের কলকাতা অংশ শুধুই সম্মুখপানের উচ্চ সফলতার ইতিহাস বর্ণনা- যা সব স্তরেই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণযোগ্য।
১৯০৮ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে রাধা গণিতে সম্মানসহ প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। তার জীবনের আর একটি মোড় ঘুরে ফেরার পর্ব আসে ১৯১১ সালে- এই বছর তিনি ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে মাসিক ১৫০ টাকা বেতনে গণিতের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। প্রায় এক দশক এই কলেজে অধ্যাপনা করেন। শিক্ষক হিসেবে যথেষ্ট নামযশও হয়েছিল। তবে মায়ের বাসনা পূরণের কারণে আদালতের দিকেই ঝুঁকতে হয় তাকে। অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করেন এবং ১৯১৭ সালের ২ মার্চ কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। সুখের কথা মা মগ্নময়ী এই সুসংবাদ শুনে যান, কেননা ওই ১৯১৭ সালের ডিসেম্বর মাসেই তার মৃত্যু হয়। ১৯২০ সালে এম এল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে। ১৯২১ সালে অধ্যাপনার চাকুরি ছেড়ে ময়মনসিংহ থেকে কলকাতায় ফিরে এসে হাইকোর্টে আইনপেশায় যোগ দেন। এরপর শুরু হয় তার কর্মজীবনের ধারাবাহিক সাফল্য ও অর্জনের ইতিহাস। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল অতি নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ। ১৯২৩ সাল থেকে ১৯৩৬- এই দীর্ঘ ১৩ বছর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। ১৯২৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব ল’ উপাধি লাভ করেন। তার গবেষণা-অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল: ‘Hindu Philosophy of Law in the Vedic and Post-Vedic Times prior to the Institutes of Manu’- উচ্চমানের গবেষণাকর্ম হিসেবে অভিসন্দর্ভটি দেশে-বিদেশে প্রশংসিত ও সমাদৃত হয়। রাধাবিনোদ তিনবার- ১৯২৫, ১৯৩০ ও ১৯৩৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘Tagor Professor of Law’ পদে অধিষ্ঠিত হন যা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি অতীব বিরল ঘটনা।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থ ‘Hundred Years of The University of Calcutta’ (1957) এর সূত্রে জানা যায়, ১৯৪৪ সালের ১৩ মার্চ ড. রাধাবিনোদ পাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের স্থলাভিষিক্ত হন এবং ১২ মার্চ ১৯৪৬ পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। প্রগাঢ় আইনজ্ঞান, তীক্ষ্ণ বিচারবুদ্ধি, আন্তরিক নিষ্ঠা ও পেশাগত সততার কারণে অল্পদিনেই তিনি প্রথম সারির আইনজীবী হিসেবে স্থান করে নেন। এই পেশায় ঈর্ষণীয় পসার ছিল তার। বিভিন্ন সময়ে আইন ও বিচারক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একজন খ্যাতিমান আইন বিশারদ হিসেবে ১৯২৭ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত রাধাবিনোদ ভারত সরকারের আয়কর-সংক্রান্ত আইন-উপদেষ্টা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে সফলতা ও প্রজ্ঞার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। ড. রাধাবিনোদ পালের আইন-বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রথম আন্তর্জাতিক যোগাযোগ স্থাপিত হয় ১৯৩৭ সালে ইন্টারন্যাশনাল ল’ অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যপদ লাভের মাধ্যমে। ওই বছর হেগ-এ Congress of Comparative Law-এর দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, ওই অধিবেশনে তিনি যুগ্ম-সভাপতি নির্বাচিত হন International Academy of Comparative Law-এর। আইন-বিষয়টি গভীরভাবে জড়িয়ে ছিল রাধাবিনোদের মনে-মননে- তার অস্তিত্বের সঙ্গে। একমাত্র গর্ভধারিণী মায়ের কারণে আইনকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন, ছিলেন বিচারক, আইন-পঠন-পাঠন-গবেষণা এবং আইন সম্পর্কে গ্রন্থ-রচনায় রেখেছেন মেধা-প্রজ্ঞা-কৃতিত্বের স্বাক্ষর। ড. রাধাবিনোদ পালের পাণ্ডিত্য ও প্রজ্ঞার পরিচয় ছড়িয়ে আছে তার আইনবিষয়ক পুস্তক ও রচনায়। ১৯৪৬ সালে রাধাবিনোদ পাল International Military Tribunal For The Far East-এর অন্যতম বিচারক নিযুক্ত হন, যা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি রচনার সুযোগ করে দেয়। সেই বিষয়টিই তার সম্বন্ধে সম্যক আলোচনার মুখ্য অধ্যায়। ১৯৪৬ সালে তিনি কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করে জন্মস্থান কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ছালিমপুরে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন। ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে রাধাবিনোদ পাল দূরপ্রাচ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারপতি হিসেবে যোগদানের আমন্ত্রণ পান।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে জাপানের আত্মসমর্পণের পর মিত্রশক্তি তাদের বিবেচনায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের যুদ্ধে জাপানের সম্পৃক্ততা এবং বিশ শতকের ত্রিশ এবং চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে জাপানে সমরবাদের উত্থানের জন্য যেসব জাপানি নেতা ও জেনারেল দায়ী ছিলেন তাদের বিচারের আয়োজন করে। মিত্রশক্তির সর্বাধিনায়ক ডগলাস ম্যাক আর্থার পটস-ডাম ঘোষণা দ্বারা অর্পিত ক্ষমতাবলে দূরপ্রাচ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন। পরবর্তী সময়ে এই ট্রাইব্যুনালে জাপানের প্রধান প্রধান অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয় (১৯৪৬-১৯৪৮) এবং তাতে জাপানের আটজন শীর্ষস্থানীয় নেতার মৃত্যুদণ্ড এবং আরও ১৭ জনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ট্রাইব্যুনাল গঠনে সর্বমোট ১১ জন বিচারককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ট্রাইব্যুনালের অধিকাংশ সদস্য যুদ্ধাপরাধের দায়ে জাপানি নেতাদের দোষী সাব্যস্ত করেন এবং আন্তর্জাতিক আইনে তাদের সাজা দেন। কিন্তু এ ট্রাইব্যুনালের ভারতীয় বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল ট্রাইব্যুনালের অধিকাংশের রায়ের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তিনি ভিন্নমত পোষণ করে একটি রায় প্রদান করেন এবং অধিকাংশ বিচারকের রায়ের সঙ্গে একমত পোষণ করতে অস্বীকৃতি জানান। তার দীর্ঘ ৪০০ পৃষ্ঠার রায়ে রাধাবিনোদ পাল দেখিয়েছেন যে, বিবাদী পক্ষের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো আইনের চোখে টেকে না। তিনি আরও মন্তব্য করেন যে, সব সাক্ষ্য প্রমাণাদি খুবই দুর্বল এবং তাতে বিজয়ীদের দৃষ্টিভঙ্গী ও খেয়ালখুশির প্রতিফলন ঘটেছে।
দূরপ্রাচ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালের একজন অন্যতম বিচারপতি রাধাবিনোদ প্রদত্ত ভিন্নমত পোষণকারী রায়টি একদিকে আন্তর্জাতিক আইনের ইতিহাসে এবং অন্যদিকে যুদ্ধ ও শান্তির ইতিহাসে অসাধারণ গুরুত্ব বহন করে। এতে যুদ্ধ ও শান্তির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতিহাসের আইনগত ভিত্তির দালিলিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। ড. রাধাবিনোদের ভিন্নমত পোষণকারী রায়ের মূল প্রশ্ন ছিল, যারা জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তাদের নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল গঠন করার এবং নিজেদের শর্তানুযায়ী পরাজিত শত্রুদের বিচার করার নৈতিক ও আইনগত এখতিয়ার আছে কি না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠনে জাপানের কোনো ভূমিকা ছিল না। বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল বিজয়ী পক্ষের একতরফাভাবে প্রণীত বিচারের দিক নির্দেশনা ও বিধিনিয়ম দ্বারা চালিত হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। নেদারল্যান্ডের একজন এবং ফিলিপাইনের একজন বিচারপতি রাধাবিনোদকে যদিও নৈতিক সমর্থন যুগিয়েছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রদত্ত রায়কে অনেকটা বাধ্য হয়েই মেনে নিয়েছিলেন। ট্রাইব্যুনালের অধিকাংশ বিচারক রাধাবিনোদ পালের ভিন্নমতের রায়কে এশিয়ায় ইউরোপীয় আধিপত্যের বিরোধী একজন ভারতীয় জাতীয়তাবাদীর পাশ্চাত্য বিরোধী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ বলে আখ্যায়িত করেন। রাধাবিনোদ পালের আরও বক্তব্য ছিল এই যে, প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকে বিকাশ লাভ করা আন্তর্জাতিক আইনের বেশিরভাগই টোকিও ট্রাইব্যুনাল আমলে নেয়নি।
বিচারপতি ড. পাল তার বিশাল রায়ে অনুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে জাপানের অভিযুক্ত সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিবর্গকে স্পষ্ট নির্দোষ ঘোষণা এবং তাদের বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ নাকচ করে দেন। সাংবাদিক-লেখক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় ড. পালের রায়ের বরাত দিয়ে উল্লেখ করেছেন, "অবশেষে ড. পাল মন্তব্য করিয়াছেন যে, বিজয়ী পক্ষ কার্যত নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য এই সমস্ত আন্তর্জাতিক আদালত গঠন করিয়াছেন এবং সেই সমস্ত আদালতকে আইন ও বিচারের ছদ্মবেশ পরাইয়াছেন। কিন্তু বিজয়ী পক্ষ কখনও বিজিতকে ন্যায়বিচার দিতে পারেন না। কারণ আদালত যদি রাজনীতির মধ্যে শিকড় গাড়িয়া বসে, তবে ন্যায়বিচারের যতই মুখোশ পরানো হোক না কেন, ‘তখন ন্যায়বিচার শুধু বলশালী পক্ষের স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপারে পরিণত হয় মাত্র’ (‘দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইতিহাস", তৃতীয় খণ্ড, দ্বি-মুদ্রণ: কলকাতা, এপ্রিল ১৯৮২; পৃ. ১২৭৬)।
ড. রাধাবিনোদ পাল তার এই রায়ে বিবেচনায় এনেছিলেন রাজনৈতিক, মানবিক ও আইনি প্রসঙ্গ। বিশ্বের খ্যাতিমান আইনজ্ঞরা ড. পালের এই রায়ের উচ্চপ্রশংসা করেছিলেন- এদের মধ্যে উল্লেখ করতে হয় Lord Hankey, Professor W Friedmann, Professor Gordon Ireland, R. T. Paget, Justice Douglas প্রমুখের নাম। Professor W Friedmann- এর ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয় ‘An Introduction of World Politics’ বইটি- তাতে তিনি বলেছেন আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে ড. পালের গৃহীত দৃষ্টিভঙ্গি ‘shared by distinguished lawyers of many nations.’ টোকিও ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত American Counsil সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে মন্তব্য করেছেন বিচারপতি ড. রাধাবিনোদ পাল ছিলেন ‘the most qualified best balanced and scholarly of the entire Bench. এই মূল্যায়ন বিচারক হিসেবে ড. পালের উচ্চতা ও আইনি জ্ঞানের গভীরতাকে নির্দেশ করে। সত্তর বছর পরেও ড. পালের রায় একটি জাতিকে আলোড়িত করে চলেছে। তাই বিচারপতি পালের এই রায়কে ইতিহাসের অন্যতম ‘ধ্রুপদি রায়’ বলে গণ্য করা যায়। শ্রদ্ধা-ভক্তি-কৃতজ্ঞতা-ভালোবাসার অর্ঘ্য পরম আন্তরিকতায় জাপান নিবেদন করেছে ড. রাধাবিনোদ পালকে- জীবিতকাল এবং জীবনাবসানের পরেও। জীবনের শেষ পর্বে ড. পালকে তারা নানাভাবে সম্মানিত করে। জাপান সম্রাট হিরোহিতো তাকে জাপানের সর্বোচ্চ রাজকীয় সম্মানে ভূষিত করেন। জাপানিদের কাছে বিচারপতি ড. পালের টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের ঐতিহাসিক রায় ছিল পবিত্র দর্শনগ্রন্থ বাইবেলের সমতুল্য। জাপানের ডিফেন্স কাউন্সিলের পক্ষ থেকে এক চিঠিতে ড. পালের এই রায়ের জাপানি ভাষায় অনুবাদ প্রকাশের অনুমতি চাওয়া হয়। তারা এই বইয়ের নাম ‘The Bible of Peace- by Hon. R. B. Pal’s Verdict at the International Military Tribunal for the Far East’ রাখার প্রস্তাব করেন। ডিফেন্স কাউন্সিল গ্রন্থ-সম্মানী দেওয়ার বিষয়ে যেকোনো শর্তে রাজি বলে জানান। কিন্তু শান্তিকামী ও মানবপ্রেমী ড. পাল এই চিঠির জবাবে সবিনয়ে জানিয়ে দেন, তার প্রাপ্য গ্রন্থ-সম্মানী পারমাণবিক বোমায় আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য ব্যয় করলে তিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন।
ড. বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল টোকিওর যুদ্ধাপরাধ বিচারের পর কয়েকবার জাপান সফর করেন। ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে তিনি জাপানের স্বনামধন্য মানবতাবাদী ইয়াসাবুরো শিমোনাকার আমন্ত্রণে জাপান গমন করেন এবং সে দেশের বিভিন্ন সমাবেশে শান্তির উপর বক্তৃতা প্রদান করেন। ১৯৫২ সালের নভেম্বর মাসে বিশ্ব ফেডারেশন ও ন্যায়বিচার বিষয়ক এশিয়া সম্মেলনে তাকে সম্মেলনের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। সম্মেলন শেষে হিরোশিমা (শান্তি) ঘোষণা গৃহীত হয়। এ সময়ে (১৯৫২-১৯৬৬) বিচারপতি রাধাবিনোদ জাপানি মন্ত্রিসভায় এবং টোকিও ও ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা প্রদান করেন। ১৯৫২ সালের আগস্টে তিনি জাতিসংঘের International Law Commission-এর সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৭-এ আরেক গুরুদায়িত্ব বর্তায় তার ওপর হেগ-এ প্রতিষ্ঠিত Permanent Court of Arbitration-এর বিচারক হিসেবে। ১৯৫৮-তে International Law Commission এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৫৯ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে স্বদেশের সম্মানজনক ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় তাকে। একই বছর শিক্ষাবিদ-আইনবিদ ড. রাধাবিনোদ পালকে ভারত সরকার National Professor of Jurisprudence পদ প্রদান করে সম্মানিত করেন। দ্বিতীয়বারের জন্য তিনি International Law Commission এর চেয়ারম্যান হন ১৯৬২ সালে। আর কোনো বিচারপতি দু’বারের জন্য এই দায়িত্ব পাননি। বেঁচে থাকতে রাধাবিনোদ শেষ সম্মাননা লাভ করেন জাপান থেকে। মৃত্যুর একবছর আগে (অক্টোবর ১৯৬৬) জাপান সম্রাট হিরোহিতো তাকে প্রদান করেন First Order of Sacred Treasure। জাপানের এই সর্বোচ্চ সম্মান এবং সাথে ‘Purple Ribon’। জাপানের রাজধানী টোকিও অন্যতম বৃহৎ এভিনিউ এর নামকরণ করা হয় তার নামে। জাপানের Nihon University তাকে সম্মানিত LL.D. উপাধিতে ভূষিত করে। Freedom of the City of Tokyo ও Freedom of the City of Kyoto এই সম্মান জানিয়ে Tokyo I Kyoto এর Metropolis Government তাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। কৃতজ্ঞ ও গুণগ্রাহী জাপানি জাতি ড. পালের মৃত্যুর পর তার নামে একটি স্মৃতি-মিলনায়তন ও দুটি স্মারক ম্যুরাল প্রতিষ্ঠা করে জাপানিদের অন্তরে তার স্মৃতি অম্লান করে রেখেছে। এ সবই হয়েছে টোকিও ট্রাইব্যুনালে ড. রাধাবিনোদ পালের যথার্থ নিরপেক্ষ-যৌক্তিক ও দৃঢ় আইনি ভূমিকার জন্য।
ড. পালের অক্ষরগুরু, জ্ঞানদাতা এবং পথপ্রদর্শক পণ্ডিত ঈমান আলীকে তিনি ভুলে যায়নি। বুক ভরে আসে, তেমনি পণ্ডিতজি’র আদর্শমাখা অবয়বটাকে চোখে ও মনে আলিঙ্গনে শ্রদ্ধার স্পর্শে ধন্য মনে হতো রাধাবিনোদ পালের। প্রাণের রাধাকে একনজর দেখতে পণ্ডিতের বড়ই ইচ্ছে জাগ্রত হতে থাকে। হঠাৎ একদিন মনের অজান্তে পণ্ডিত ঈমান আলী বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লেন। খুঁজতে খুঁজতে কলকাতা, তারপরে হাইকোর্টে গিয়ে হাজির। তিনি জানেন এখানে তার রাধা আছেন। রাধা কোথায় বসেন? লোকটা পাগল নাকি? কেউ কেউ আড় দৃষ্টে মন্তব্য করে। কোথায় যেন হারিয়ে যান অনেক মানুষের মাঝে। আবার লোকের কাছে জিজ্ঞাসা করেন পণ্ডিতজি। একসময় সন্ধান মেলে রাধার। ঈমান আলীর রাধা বিশাল বিচারলয়ে উঁচু চেয়ারে বসে আদালত পরিচালনা করে চলেছেন। তার চেয়ারের পেছনে বাতাস দিচ্ছেন পাঙ্খাপুলার। কালো কোট পরিহিত অনেক নামিদামি উকিল-মোক্তারেরা এজলাসের সম্মুখে ‘মে লর্ড’ বলে রাধাকে বয়ান দিচ্ছেন। নির্বিঘ্ন চিত্তে রাধা সে বয়ান শ্রবণ করে চলেছেন। ‘আমি রাধার কাছে যাব বলেই’ পণ্ডিতজি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। বিচারপতি রাধার কর্ণগোচর হলো। ‘যেন আমার পণ্ডিতজি ঈমান আলীর মতো মনে হচ্ছে।’ তাইতো! বিচক্ষণ বিচারক রাধাবিনোদ আদালত মুলতবি করে নেমে এলেন এজলাস থেকে। ঈমান আলীর কাছে গিয়ে লুটিয়ে পড়া পণ্ডিতজিকে তুলে দাঁড় করালেন। কী হতে যাচ্ছে! করতে যাচ্ছেন তাদের প্রধান বিচারপতি! কে এই আগন্তুক? ঈমান আলী পণ্ডিতকে সামনে দাঁড় করিয়ে হাঁটু গেড়ে নিজের মাথা ভূমিতে ছেকিয়ে ঈমান আলীর পা তার নিজ কপালে স্পর্শ করে প্রণাম ও প্রণতি জানালেন বিচারপতি রাধা বিনোদপাল। এরপর সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছেন, আমার শিক্ষক পণ্ডিতজি ঈমান আলী। যিনি আমাকে এই আসনে বসতে ভিত সৃষ্টি করে দিয়েছেন। একে একে অনেকে তখন পণ্ডিতজিকে প্রণাম ও শ্রদ্ধা জানাতে লাগলেন। রাধাবিনোদ পাল তার শিক্ষাগুরুকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন তার বাসস্থানের উদ্দেশ্যে। আবেগপ্লুত গুরু-শিষ্য কেউই তখন চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের এমন ভক্তি ও শ্রদ্ধার নিদর্শন আজ একেবারেই হারিয়ে গেছে।
টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে ভিন্নমতের রায় প্রদান করে বিশ্বখ্যাত হয়েছেন। বাঙালি বা তার স্বদেশবাসী তার স্মৃতিরক্ষার জন্যে কিছু প্রত্যাশিত উদ্যোগ গ্রহণ করলে তা শোভন হতো। যেমন- তার নামে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘চেয়ার’ প্রতিষ্ঠা, তার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে উচ্চতর গবেষণা, তার নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের নামকরণ, তার কর্মস্থল বা বাসস্থানের কাছাকাছি তার নামে কোনো সড়কের নামকরণ। তবে বাংলাদেশের কিছু মানুষ তাকে স্মরণে রেখেছেন। কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলার অন্তর্গত তার পূর্বপুরুষের গ্রাম কাঁকিলাদহে ড. রাধাবিনোদ পাল বসবাসের জন্য তিরিশের দশকে যে বাড়ি তৈরি করেছিলেন, তা এখন নিশ্চিহ্ন। আমরা গৌরববোধ করতে পারি এমন একজন মানুষের জন্য যিনি আজ থেকে ১৩৬ বছর আগে আমাদের এই বাংলাদেশ ভূখণ্ডেরই এক প্রান্তে জন্ম নিয়েছিলেন।
সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদ-আধিপত্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ-পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের যে একক লড়াই- তা শুধু আইনের ছিল না, শান্তি-মানবতা-ন্যায়নীতি-গণতন্ত্র-বিশ্বসম্প্রীতি প্রতিষ্ঠারও লড়াই ছিল। ড. পালের একক কণ্ঠস্বর সেদিন এত জোরালো ছিল যে, পৃথিবীর মানুষ তা অবাক বিস্ময়ে শুনেছিল- উপনিবেশের মুক্তিকামী মানুষের কাছে তা ছিল শেকল-ছেড়ার গান।
১৯৬৭-এর ১০ জানুয়ারি ড. পালের মৃত্যুতে জাপানে শোকের ছায়া নেমে আসে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আরও অনেক বিশিষ্ট জাপানি তাদের গভীর শোক প্রকাশ করেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী Kisaku Sato তার শোকবাণীতে উল্লেখ করেন, ‘I have learnt with deep sorrow of the passing of Dr. Radha Binod Pal. Dr. Pal will not only be remembered as an eminent jurist from India who has so ably served humanity, but the memory of his noble personality and warm felling of friendship will long remain in the hearts of all the Japanese people.’ বিচারপতি সুশান্ত চট্টোপাধ্যায় তার ‘Dr. Radha Binod Pal: A Law Person, A Judge and A Jurist’ শীর্ষক প্রবন্ধে ড. পালকে 'পথপ্রদর্শক তারকা' হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, ‘He earned many distinctions and he had distinguished himself as a very bright star whose presence could hardly be missed. Generally a night journey is begun in the desert by looking at the guiding stars above head. Stars and stars alone can guide the travellers moving across the desert to reach the destination. Amongst thousands of stars in the dark blue sky, there are few bright stars and a very few guiding stars to lead the travellers to find their proper directions. Dr. Pal was undoubtedly a guiding star.’
সূর্যোদয়ের দেশ জাপান বর্তমান পৃথিবীর শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে প্রথম অবস্থানে রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শিল্পে অনেক তাড়াতাড়ি সমৃদ্ধি অর্জন করে দেশটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে জাপান বাংলাদেশের পক্ষ নেয়। এমনকি যুদ্ধপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে জাপানের ভূমিকা ছিল অনেক। বাংলাদেশের প্রতি জাপানের এই ধরনের স্বার্থহীন বন্ধুত্বসুলভ আচরণ আন্তর্জাতিক সম্পর্কে সাধারণত দেখা যায় না। জাপান বাংলাদেশকে এরূপ সাহায্যদানের পেছনে রয়েছে একটি ইতিহাস! জাপানিরা ১৯৩৭ সালে নানকিং (এখন নানজিং) এ চাইনিজদের কচুকাটা করেছিল। খুন, ধর্ষণ মিলিয়ে এমন নৃশংসতা কমই দেখেছে বিশ্ব। The Flowers of War নামে একটি মর্মস্পর্শী মুভি আছে এই গণহত্যা নিয়ে। জাপানিরা এর আগে পরেও লাখে মরেছে এবং মেরেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জব্দ জাপান বাধ্য হয়ে রক্তের নেশা ছেড়ে জাতি গঠনে মনযোগ দিয়েছিল বলেই আজ তারা পৃথিবীর অন্যতম সভ্য জাতিতে পরিণত হতে পেরেছে। এই জাতি গঠনের পেছনে জাপানিরা চিরকৃতজ্ঞ কুষ্টিয়ায় জন্ম নেওয়া ড. রাধাবিনোদ পাল নামের একজন বাঙালির কাছে। মিত্রপক্ষের চাপ সত্ত্বেও ইন্টারন্যাশনাল যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের ‘টোকিও ট্রায়াল’ ফেজে এই বাঙালি বিচারকের দৃঢ় অবস্থানের কারণেই জাপান অনেক কম ক্ষতিপূরণের উপর বেঁচে গিয়েছিল। নয়তো যে ক্ষতিপূরণের বোঝা মিত্রপক্ষ ও অন্য বিচারকরা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তার দায় এখন পর্যন্ত টানতে হতো জাপানকে। সেক্ষেত্রে ঋণের বোঝা টানতে টানতে জাতি গঠনের সুযোগই আর পাওয়া হতো না জাপানের। সেই সময়েই জাপানি সম্রাট হিরোহিতো কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বলেছিলেন, ‘যতদিন জাপান থাকবে, বাঙালি খাদ্যাভাবে, অর্থকষ্টে মরবে না। জাপান হবে বাঙালির চিরকালের নিঃস্বার্থ বন্ধু!’ এটি যে শুধু কথায় ছিল না, তার প্রমাণ আমরা এখনও দেখতে পাই। জাপান এখনও বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নিঃস্বার্থ বন্ধু।
লেখক: ড. মুহম্মদ এমদাদ হাসনায়েন, ইতিহাস গবেষক ও প্রাবন্ধিক।
টিটি/