আকাঙ্ক্ষার আইন কি আশা পূরণ করবে?
সংসদে উঠেছে নির্বাচন কমিশন গঠন সম্পর্কিত আইন। এর আগে মন্ত্রী পরিষদে খসড়া আইন পাস হয়েছে। সংসদে আইন পাস করতে কি সমস্যা হবে? আলোচনার সময় নেই, প্রয়োজনও নেই, উত্থাপিত হলেই পাস। অনেকটা যেন মনোনয়ন পত্র জমা দিলেই পাস। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এই শিরোনাম হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। একপক্ষীয় সংসদে আইন পাস করার ক্ষেত্রেও এমনটাই যে হবে তা নিয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, আওয়ামী লীগের সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে নতুন ইসি গঠনের আগেই যেন আইনটি পাস হয়। তবে আইন পাসের জন্য আওয়ামী লীগের হাতে কোনো ম্যাজিক নেই। এ কথার সহজ অর্থ এই যে, সংসদে উত্থাপিত হলে আইন পাস হয়ে যাবে। আইন পাস করতে কি ম্যাজিক লাগে? না, লাগে মেজরিটি। সেটা তো একপক্ষীয় এই সংসদে বিপুলভাবেই আছে, যাকে বলে একেবারে ব্রুট মেজরিটি।
জাতীয় সংসদ থেকে ইউনিয়ন পরিষদ–নির্বাচনে জিতে যাওয়া মানে ক্ষমতা আর সম্পদ; হেরে যাওয়া মানে নানা ধরনের বিপদ। হেরে যাওয়া প্রার্থীকে নানা ধরনের কথার জ্বালা যেমন–কয়টা ভোট পাইছো, জিততে পারো নাই আবার বড় বড় কথা কও–এসব নিরীহ কথা তো শুনতেই হয় আবার অনেক সহিংস ঘটনার শিকারও হতে হয়। তাই সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচন তো বটেই তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাশা নির্বাচনটা যেন নিরপেক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত হয়। স্বাধীনতার পূর্বের কথা আলোচনা না করলেও স্বাধীনতার পর থেকেই সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে এই অসন্তোষ ও আপত্তি চলেই এসেছে। ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষে বাংলাদেশ এখন ১২তম নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে। এই সময়কালে দেশের জনগণ প্রত্যক্ষ করেছেন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, সামরিক সরকারের অধীনে নির্বাচন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, দলীয় সরকারের অধীনে সার্চ কমিটি প্রণীত নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন। এসব অভিজ্ঞতা থেকেই নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি আরও গ্রহণযোগ্য দাবিতে পরিণত হয়েছে।
এ যাবৎ যারাই ক্ষমতায় ছিলেন, তারা সবাই উচ্চকণ্ঠেই বলতে ভালবাসতেন যে তাঁরা সংবিধান মেনে চলেন। কিন্তু সংবিধানে আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের নির্দেশনা থাকলেও স্বাধীনতার ৫০ বছরে যারা ক্ষমতায় ছিলেন বা যারা ক্ষমতা নিয়েছিলেন, তারা কেউ সে নির্দেশনা মানেননি। অবশেষে সেই আইন করে ইসি গঠন হতে যাচ্ছে। এ জন্য ১৭ জানুয়ারি আইনের খসড়া অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এই খসড়া আইনে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে বাছাই করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২ ’-এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে সভার সিদ্ধান্ত জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। সকালে আইনের খসড়া অনুমোদন করে বিকালে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশগ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। খসড়া অনুমোদনের পর আইনমন্ত্রীর কাছে সংবাদমাধ্যমের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল, আসন্ন নির্বাচন কমিশন এ আইনের মাধ্যমে গঠন হবে কি না। জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ, হবে।
আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান ইসির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। ফলে ১৫ ফেব্রুয়ারি নতুন কমিশনকে দায়িত্ব নিতেই হবে। সে কারণেই ইসি পুনর্গঠন নিয়ে গত ২০ ডিসেম্বর থেকে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে আসছিলেন রাষ্ট্রপতি। সংলাপে যারা গিয়েছেন বা যারা যাননি, তাদের প্রায় সবাই এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, ইসি গঠনে আইন প্রয়োজন। ক্ষমতাসীন বিরোধীদল জাতীয় পার্টি দিয়ে শুরু এবং ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপের মধ্য দিয়ে শেষ হয় রাষ্ট্রপতির এ সংলাপ পর্ব। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বঙ্গভবনে সংলাপে অংশ নেয়। তারাও ইসি গঠনে আইনের প্রয়োজন আছে বলে মত দিয়েছেন।
আলোচনা শেষ হতে না হতেই আইনের খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। আইনমন্ত্রী বলেন, নতুন ইসি আইন মেনে হবে। আর এ বিষয়ে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব পুরনো কথা নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে একটি বিধান আছে। যেখানে বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিতে পারেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এ আইন করা হচ্ছে। এটি একটি ছোট আইন।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, আইনের খসড়ায় আছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ দিতে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হবে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে এ অনুসন্ধান কমিটি হবে। এ কমিটির দায়িত্ব ও কাজ হবে যোগ্য প্রার্থীদের নাম সুপারিশ করা। ছয় সদস্যের এ অনুসন্ধান কমিটির প্রধান হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি। আর সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত হাইকোর্টের একজন বিচারপতি, মহাহিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতির মনোনীত দুজন বিশিষ্ট নাগরিক। কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কমিটি যোগ্য প্রার্থীদের নাম সুপারিশের পর সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেবেন।
আইনের খসড়ায় কিছু শর্ত আছে। প্রথমত, নির্বাচন কমিশনারদেরকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। দ্বিতীয়ত, ন্যূনতম বয়স ৫০ বছর হতে হবে এবং তৃতীয়ত, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি বা বিচার বিভাগীয় পদে ওই সব ব্যক্তিকে কমপক্ষে ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এসব যোগ্যতা থাকলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার হতে পারবেন। যদিও ২০ বছরের অভিজ্ঞতার মধ্যে কোন পদে কত বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, তা স্পষ্ট করে বলা নেই। নাগরিক প্রতিনিধি বাছাই এর মাপকাঠি কি হবে বা তাদের যোগ্যতা কি হবে তাও বলা হয়নি।
অযোগ্যতা হিসেবে বলা হয়েছে, অপ্রকৃতিস্থ, দেউলিয়া ঘোষণা হওয়া, বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব থাকা বা আনুগত্য প্রকাশ করা (তবে দ্বৈত নাগরিক হলে হওয়া যাবে), নৈতিক স্খলন হলে এবং ফৌজদারি অপরাধে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাজাপ্রাপ্ত হলে এসব পদে নিয়োগ পাওয়া যাবে না। এ ছাড়া কেউ প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে অবসরে গেলে আর সেই পদে নিয়োগ পাবেন না। তবে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে অবসরে গেলে শুধু প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে।
যদিও বলা হচ্ছে এই আইনটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২ তাহলেও বাস্তবে এটি হবে সার্চ কমিটি গঠনের আইনি অনুমোদন। প্রশ্ন উঠছে যে আইনকে ছোট আইন বলা হচ্ছে, সে সম্পর্কে কয়েকদিন আগেই আইনমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল এত অল্প সময়ে আইন করা যাবে না। আর এ কথা সবাই মানবেন যে, নির্বাচনকে আপাত গ্রহণযোগ্য করতে হলেও সকলের মতামতের ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন করতে হবে। একদিকে রাষ্ট্রপতি সংলাপ করছেন অন্যদিকে আইনের খসড়া মন্ত্রী পরিষদে অনুমোদিত হয়ে গেল, ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াল? যত আগ্রহ নিয়ে সংলাপ আহবান করা হয়েছে, তার কিছুটা আগ্রহ যদি আইন কেমন হবে তা নিয়ে মতামত গ্রহণ করার জন্য থাকত তাহলে সংশয়, সন্দেহ আর অভিযোগ হয়তো থাকত না।
আইন দ্রুত বা ধীরে প্রণয়ন করা নিয়ে বিতর্কের চাইতে আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া বিতর্কের সৃষ্টি করে। সরকারের আমলাদের দ্বারা প্রণীত আইনের খসড়া মন্ত্রী পরিষদ অনুমোদন করেছে। কোনো রাজনৈতিক দল, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহল–কারও সঙ্গেই কি খসড়া নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে? প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হয়, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে যারা প্রচারিত, তারাও কি জানতেন, কীভাবে হচ্ছে খসড়া? রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপেও তো আইনের খসড়া একটি বিষয় হিসেবে থাকতে পারত। নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে তার উপর নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নির্ভর করে, এ অভিজ্ঞতা বাংলাদেশে হয় নাই কার?
সংসদে আইন প্রণয়ন হলেই তা গণতান্ত্রিক হয় না বা গ্রহণযোগ্যও হয় না। যে আইনের জন্য এত দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষা সেই আইন প্রণয়নে এত সন্তপর্ণ পদক্ষেপ তো সন্দেহ জাগায়। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় যাওয়া না যাওয়া নিয়ে বিতর্ক, যারা গিয়েছেন তাদের আলোচনার বিষয় ছাপিয়ে এখন সার্চ কমিটির আইনি কাঠামো দেওয়ার আইন প্রণয়ন প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হবে, আপনারাই তো আইন চেয়েছেন। বাকি সবাই বলবেন, এই আইন কি আমরা চেয়েছিলাম?
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)
এসএ/